স্মৃতির পাতায় শারদীয়া

অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

উৎসবপ্রেমী বাঙালি হিন্দুদের সবচেয়ে বড় পার্বণ দুর্গাপূজা। গোটা বছর যে যেখানেই থাকুক না কেন, পূজার সময় ঘরে ফিরতে মুখিয়ে থাকেন সবাই। মা আসছেন—এই শব্দতেই বাঙালির সব আবেগ। ‘অধীর আগ্রহে দিন গুনি’—বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠস্বরের সেই স্তোত্রপাঠ শোনার অপেক্ষায়। যাবতীয় অপেক্ষা শেষে ঢাকের বোলে মা আসেন কৈলাস থেকে ধরাধামে সপরিবার। নির্মল নীল আকাশ আর শিউলির মিষ্টি গন্ধে ভরে যায় ধরাভূমি। ষষ্ঠীর বোধন থেকে সপ্তমী, অষ্টমী পেরিয়ে মহানবমী থেকে শুরু হয়ে যায় মন খারাপের পালা। নবমীর রাত থেকেই আনন্দ মিলেমিশে যায় বিদায়ের সুরে। বিজয়া দশমীর বিষাদমাখা প্রকৃতিতে আবার মায়ের পথ চেয়ে দীর্ঘ এক বছর অপেক্ষায় থাকার আনন্দও দারুণ।

ছোটবেলায় পূজার শুরুটাই হয় মায়ের প্রতিমা বানানো থেকে। খড়মাটিতে মায়ের রূপ যতই স্পষ্ট হতে থাকে, সময় বলে দেয় পূজার আর দেরি নেই। একদিকে চণ্ডীপাঠ, অন্যদিকে প্রতিমাশিল্পীদের হাতের তুলির রঙে স্পষ্ট হতে থাকে মায়ের মুখ। যেই মুখ হাসি ফোটায় সবার মুখে।

তখনকার পূজার আনন্দ ছিল সত্যিই অন্য রকম। নতুন কাপড়ের ঘ্রাণ মনে করিয়ে দেয় সেসব স্মৃতি। মা–বাবার সঙ্গে মন্দিরে মন্দিরে ঠাকুর দেখার আনন্দ—মুড়িমুড়কি, বাতাসা, মাটির খেলনা, হাতি, ঘোড়া, কত কী। এসব স্মৃতি এখন চাপা পড়েছে নানা চাপে। বয়স বাড়ার সঙ্গে বেড়েছে নানা চিন্তা। শৈশবের সাধারণ জীবন হয়ে উঠেছে যান্ত্রিক। আধুনিকতার ছোঁয়ায়, যন্ত্রের ভিড়ে কমেছে পূজার ঐতিহ্যবাহী ঢাক আর কাঁসরের শব্দ। বয়স্কদের কাছে শোনা যায়, পূজা আর আগের মতো নেই।

এখন সময় বদলে গেছে। পরিবর্তন এসেছে জীবনের রং, রুচি আর আবেগে। মন্দিরে এত এত পূজা, উৎসবের এত আমেজ, এত প্রতিযোগিতা—এসব আগে যতটা আনন্দ দিত, এখন সমানেই মনে পড়ে রাস্তায় পড়ে থাকা শিশুদের মুখগুলো। ভেসে ওঠে দীনতায় কাটানো পরিবারের চিত্রগুলো। জীবনের কঠিনতম সময়কে অতিক্রম করতে গিয়ে মাঝেমধ্যেই বিবর্ণ হয়ে যায় জীবনের রং। এই বিবর্ণ জীবন কোথাও আটকায় না, না নতুন কাপড়, না শিউলি ফুলে। জীবনের এতগুলো শারদ কাটিয়েও পূজা এলে আজও নতুন কিছু কেনাকাটা করি; কিন্তু ছোটবেলার সেই নতুন ঘ্রাণ আর পাই না।

এখন চেষ্টা করি পূজা এলে পাশের দুস্থ মানুষগুলোর খোঁজ নিতে। অন্যদেরও বলব, পুরোনো কাপড়ে যাঁদের দেবীপক্ষ কেটে যায়, এবারের শারদে একটি নতুন কাপড় হোক তাঁদেরও। ভালো কিছু রান্না হোক তাঁদের ঘরেও। সবার পূজা কাটুক আনন্দে, সবার জীবনেই ভালো সময় আসুক।

সাধারণ সম্পাদক, দিনাজপুর বন্ধুসভা