মাথায় কি কেউ হাত বুলিয়ে দিচ্ছে

ছবি: এআই/বন্ধুসভা

প্রতিদিনের মতো কোচিং শেষে বাসায় ফেরে ফাহিম। দুদিন হলো গায়ে জ্বর। কাশিও আছে। এরই মধ্যে আবার বৃষ্টি শুরু হলো। নীতু বাসায় নেই। বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাড়লে নীতু খুব বকাবকি করবে। এই কালো মেয়েটাকে নিয়ে হয়েছে যন্ত্রণা। চোখের কোথায় যেন হাসি লেগেই থাকে। মন খারাপ হলেই বিপদ। বড় বড় চোখ করে শুধু তাকিয়ে থাকে। শত প্রশ্ন করলেও উত্তর দেয় না। তার চেয়ে চেঁচামেচি করে ঝগড়া করলেও ভালো হতো।

সন্ধ্যার এই সময়ে ছোট্ট শহরের রাস্তায় বেশ ভিড় থাকে। দিন শেষে সবাই আড্ডা দিতে আসে। রাজনীতি নিয়ে বেশ গল্পগুজব হয়। আজ আবহাওয়া ভালো না। রাস্তাঘাট বেশ ফাঁকা। বৃষ্টির লক্ষণ ভালো না। এ ধরনের বৃষ্টি সাধারণত দীর্ঘ সময়েও ছাড়তে চায় না। অপেক্ষা করাটা মনে হয় বোকামি হবে।

ফাহিম হাঁটতে থাকে। বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে বৃষ্টিতে হাঁটা কষ্টসাধ্য। জায়গায় জায়গায় কাদাপানি জমে আছে। রিকশা পেলে ভালো হতো।
‘স্যার, আসসালামু আলাইকুম।’ ফাহিম মাথা ঝাঁকায়। কলেজের ছোট ভাই সাইফ। সাধারণ শিক্ষার্থী অধিকার আন্দোলনের নেতা। সরকারি দলের ছত্রচ্ছায়ায় ভালো টাকাপয়সা করেছে বোঝা যায়। ‘ভাই, ভাবি কি এসেছেন?’

খুবই বিব্রতকর প্রশ্ন। এই প্রশ্নটা মাঝেমধ্যেই শুনতে হয়। ভাবির প্রতি এদের আগ্রহের কারণটা ফাহিম ঠিক ধরতে পারে না। উত্তর না দিয়েই হাঁটতে থাকে। মনে হচ্ছে বৃষ্টি আরও জোরে আসবে। নীতু জামালপুর থাকতে চায় না। জামালপুরে নাকি দম বন্ধ হয়ে আসে। ফাহিম এখানে একটা কোচিংয়ে পড়ায়। গণিতের শিক্ষক। সে সব সময় চেয়েছে ফাহিম কোনো কলেজে পড়াবে। থাকবে শহরের টিনের ঘরে। কী অদ্ভুত মেয়ে। এ যুগে কেউ এমন কিছু চাইতে পারে, কল্পনাও করা যায় না। প্রথম প্রথম ফাহিম অবাক হতো। এখন হয় না।

সে কাকভেজা হয়ে ঘরে ফেরে। হাতে বাজারের ব্যাগ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। তাড়াতাড়ি গা মুছে ফেলা দরকার। জ্বরের মধ্যে নতুন করে ঠান্ডা লাগলে ঝামেলা হয়ে যাবে। আলনায় ভাঁজ করা গামছা। নীতু যেন জানত ফাহিম আজ বৃষ্টিতে ভিজে বাসায় আসবে। নীতু খুব গোছানো। এমনভাবে জিনিসপত্র রাখে, যাতে হাতের কাছে সব পাওয়া যায়। ফাহিম দ্রুত মাথা মুছতে মুছতে রান্নার আয়োজনে গেল। দুপুরে খাওয়া হয়নি। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে।

রাঁধুনি হিসেবে নিজেকে দশে সাত দেয় ফাহিম। নীতুর মতে ওর দশে নয় পাওয়া উচিত। বারান্দায় ছোট একটা সিলিন্ডার গ্যাসের চুলায় রান্না হচ্ছে। খিচুড়ি রান্না হবে। সবজি খিচুড়ি। টিনের চালে ঝুমবৃষ্টির শব্দ। বাতাসে বৃষ্টির ঝাপটা এসে লাগছে। ফাহিমের গায়ে চাদর। তবু ঠান্ডা লাগছে। নীতু থাকলে ভালো হতো। একটা গান শোনা যেত। নীতুর গানের গলা বেশ ভালো। বেশ মায়া নিয়ে গায়। ফাহিম হঠাৎ খেয়াল করে ঘরে নীতুর কোনো ছবি নেই। ফোনেও নেই। একটা ছবি রাখা উচিত ছিল। এবার এলে কয়েকটা ছবি তুলতে হবে। ফোন বাজছে। বৃষ্টির শব্দে ফাহিম বুঝতেই পারেনি।
‘হ্যালো’ ওপাশে ভারী কণ্ঠ। ফাহিমের বন্ধু সজল। নীতুর বড় ভাই।
‘হ্যাঁ, সজল বল।’
‘ফাহিম, কেমন আছিস?’
‘হুমম ভালো’
‘তুই কি বাসায় আছিস?’
‘হুমম।’
‘তোর কণ্ঠ এমন লাগছে কেন। তোর শরীর কি বেশি খারাপ?’
‘না। তেমন কিছু না।’
‘অনেক দিন হয়ে গেছে। তুই ময়মনসিংহে ফিরে আয়। আঙ্কেল আন্টির কথাও তো ভাবা উচিত।’
‘কথা বলিস না কেন?’ ফাহিম ফোন কেটে দেয়।

স্কুলের মিজান স্যার কল করেছিলেন কয়েকবার। কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। চুলার পাশে বসে ফাহিম বৃষ্টি দেখছে। আকাশ উজাড় করে বৃষ্টি পড়ছে। মনে হয় জ্বর বেড়ে চলেছে। কোথা থেকে যেন চুড়ির আওয়াজ আসছে। খারাপ লক্ষণ। নীতু বাসায় নেই। চুড়ির শব্দ আসার কোনো কারণ নেই। ফাহিম কি ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছে? রাত প্রায় শেষের দিকে।

অনেক কষ্টে একটা অ্যাম্বুলেন্স আনা হয়েছে। ফাহিমকে ময়মনসিংহে নেওয়া হবে। চারদিকে জৈষ্ঠ্যের কাদাপানি। মিজান স্যার বিরক্ত মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। সজল এসেছে। তার বিষয়টা মিজান স্যার পরিষ্কার হতে পারছেন না। এই লোক এখানে কীভাবে এল? ওনার জন্য দেরি হচ্ছে। ফাহিমকে দ্রুত ময়মনসিংহে নেওয়া দরকার। মিজান স্যার বিরক্ত মুখে এগিয়ে এলেন।
‘দেরি হচ্ছে। রওনা হওয়া দরকার।’
‘জি অবশ্যই।’
‘ভাই আপনার বোন কই? এত বছরে কখনোই দেখলাম না। বোন জামাইকে এভাবে কেউ একা রাখে?’
সজল চুপ করে থাকে। বেশ অপ্রস্তত হয়ে গেছে। কাঁপা গলায় বলল, ‘স্যার, আমার বোন পাঁচ বছর আগে মারা গেছে।’

মেঘ ডাকছে। মিজান স্যার হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। বেশ গতিতে অ্যাম্বুলেন্স ছুটে চলছে। ফাহিমকে অক্সিজেন দেওয়া হয়েছে। সঙ্গে নেওয়া ডা. রবিউল বেশ চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে আছেন। রবিউলের ধারণা ফাহিমের নিউমোনিয়া বেশ জটিল আকার ধারণ করেছে। অ্যাম্বুলেন্সের সামনের আসনে মিজান স্যার বসা। সজল জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখছে। ফাহিম আধো আলোয় সবাইকে আবছা দেখতে পাচ্ছে। বৃষ্টির শব্দ আসছে। মাথায় কি কেউ হাত বুলিয়ে দিচ্ছে? চুড়ির আওয়াজ আসছে। নীতু মনে হয় আজ কালো চুড়ি পরেছে। আওয়াজ শুনে ফাহিম কীভাবে যেন চুড়ির রং বলে দিতে পারে। খুব পরিচিত একটা গানের সুর কানে আসছে। প্রচুর ঘুম পাচ্ছে। গানের কথাগুলো কিছুতেই মনে আসছে না। ফাহিম চোখ বন্ধ করে।

সভাপতি, ময়মনসিংহ বন্ধুসভা