লাহিড়ী হাটের ইতিহাস ও ঐতিহ্য

শহীদ কমরেড কম্পরাম সিংহ স্মৃতি কমপ্লেক্সছবি: লেখকের সৌজন্যে

নহনা নদীর কোল ঘেঁষে ছোট্ট বাজার, লাহিড়ী বাজার। যে বাজারের ধূলিকণায় মিশে আছে নহনা নদীর মিঠাপানি। বাজারটি মানুষের মুখে প্রচলিত লাহিড়ী হাট নামে। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা ঠাকুরগাঁও হতে ২৮ কিলোমিটার দূরে বালিয়াডাঙ্গী উপজেলায় অবস্থিত এটি। তিনটি ইউনিয়নের মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা পরিচালিত হয় লাহিড়ী হাট ঘিরে। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে লাহিড়ী হাটের সম্পর্ক যেন একই সূত্রে গাঁথা। তেভাগা আন্দোলন, ভবানী বাবুর জমিদারবাড়ি এবং ব্রিটিশ আমল থেকে শিক্ষা প্রসারের ইতিহাস লাহিড়ী হাটের ধূলিকণার সঙ্গে মিশে আছে যুগ যুগ ধরে।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত আন্তনদী নাগর। নাগর নদের শাখা নদী তীরনই। তীরনই নদের বাঁ তীরে এসে মিশে যাওয়া সার্পিলাকার প্রবাহিত উপশাখা নদী নহনা। ছোট নহনা নদীর কোল ঘেঁষে দুই পাশে বিস্তৃত ফসলের মাঠের মাঝ বরাবর কংক্রিটের সোজা রাস্তা চলে গেছে লাহিড়ী হাটে। আশপাশের তিন ইউনিয়ন ও ছোট ছোট কয়েকটি গ্রামের মানুষের নিত্যদিনের জীবনযাত্রা পরিচালিত হয় বাজারটি ঘিরে। এই হাটে প্রতি সপ্তাহে বসে ঐতিহাসিক গরুর হাট, ছাগলের হাট ও বিখ্যাত বাঁশের হাট। যেটি আবার অনেকের কাছে ঠাকুরগাঁও জেলার সবচেয়ে বড় বাঁশের হাট বলে পরিচিত। এই বাঁশ ঘিরে গড়ে ওঠে ছোট ছোট কুটিরশিল্প। যদিও দিনে দিনে এখন তা বিলুপ্তির পথে। নিত্যপ্রয়োজনীয় সব জিনিসের জন্য এই হাটে সব সময় মানুষের সমাগম লেগেই থাকে।

ঠাকুরগাঁওয়ের মানুষের কাছে খুবই পরিচিত এই বাজার কিছুটা আধুনিক, কিছুটা গ্রামীণ সংস্কৃতি নিয়ে আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

১৯৪০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে লাহিড়ী হাটে জমিদারদের স্বেচ্ছাচারমূলক তোলা আদায়ের বিরুদ্ধে কৃষকদের সংগঠিত করে শহীদ কমরেড কম্পরাম সিংহ যে আন্দোলন করেছিলেন, সেটি রাজনৈতিক ইতিহাসে ‘তোলাবাটি আন্দোলন’ নামে পরিচিত। তোলাবাটি আন্দোলন পরে আরও বৃহৎ পরিসরে সুগঠিতভাবে রূপ লাভ করে তেভাগা আন্দোলনে। তোলা শব্দটির শাব্দিক অর্থ ‘সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে কিছু তুলে রাখা’। যেটি ভারতীয় উপমহাদেশে ওজনের একক হিসেবে প্রচলিত ছিল। বাজারভিত্তিক ব্রিটিশ ভারতে খাজনা আদায়ের পদ্ধতি ছিল এই তোলাবাটি। জমিদার, জেতদার, সমাজতান্ত্রিক, বুর্জোয়া শ্রেণির সমাজব্যবস্থায় তোলাবাটি ছিল নিপীড়িত কৃষকের শোষণের হাতিয়ার। তোলাবাটি আন্দোলনের নেতৃত্ব প্রদানের দায়ে কমরেড কম্পরাম সিংহ গ্রেফতার হন এবং তিন মাসের কারাবন্দী জীবন কাটান। তিনি ১৯৪৭ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হন। তখন তোলাবাটি আন্দোলন শেষ না হতেই উত্তরবঙ্গের বর্গাচাষিরা তেভাগা আন্দোলন সংঘটিত করেন। কমরেড কম্পরাম সিংহ তেভাগা আন্দোলনে বালিয়াডাঙ্গী, রানীশংকৈল ও আটোয়ারি থানায় নেতৃত্ব দেন। সেই সময় তাঁর ওপর সরকারি হুলিয়া থাকায় দুই বছর তাঁকে আত্মগোপন করতে হয়েছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ১৯৪৯ সালে মুসলিম লীগ শাসনামলে পুনরায় কম্পরাম সিংহকে গ্রেফতার করা হয় এবং অনার্য কৃষক নেতা–কর্মীদের সঙ্গে রাজবন্দী হিসেবে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের খাপড়া ওয়ার্ডে অন্তরীণ করা হয়। মুসলিম লীগ সরকারের সময়ে রাজবন্দীদের ওপর অমানবিক অত্যাচার–উৎপীড়নের প্রতিবাদে এবং তাঁদের মানবেতর পরিবেশ থেকে মানবিক পরিবেশে উন্নীত করার দাবিতে রাজশাহী কারাগারে রাজবন্দিরা যে আন্দোলন করেন, সেখানে তিনি নেতৃত্ব দেন। রাজশাহী খাপড়া ওয়ার্ডে ১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল গণহত্যায় ছয় রাজবন্দীর সঙ্গে তাঁকেও হত্যা করা হয়।

লাহিড়ী বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়
ছবি: সংগৃহীত

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের আন্দোলন, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ তথা বর্তমান বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রথম সভাপতি দবিরুল ইসলামের জন্ম এই লাহিড়ীর মাটিতে। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন।

ইতিহাসের পাশাপাশি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা এ এলাকাতে শিক্ষার বিকাশ ঘটে ব্রিটিশ আমল থেকেই। ১৮৬৬ সালে ব্রিটিশ সরকার দিনাজপুর অঞ্চলের একমাত্র গুরু ট্রেনিং স্কুল নির্মাণ করেছিল এই লাহিড়ী হাটে। পরে সেটি ঠাকুরগাঁও শহরে স্থানান্তর করা হয়; যেটি বর্তমানে পিটিআই নামে পরিচিত। এ ছাড়া ১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠিত লাহিড়ী বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয় ব্রিটিশ আমল থেকেই শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে এসেছে এ অঞ্চলে। ১৯২০ সালে লাহিড়ী এমই স্কুল নামে যাত্রা শুরু করা স্কুলটি ২০২০ সালে শতবর্ষ পার করার মাধ্যমে শিক্ষার হার আরও বিস্তার করে চলেছে।

হিন্দু, মুসলিম, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ সব ধর্মের মানুষ এখানে মিলেমিশে একত্রে বসবাস করেন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ছাড়াও এখানের নারীরা পুরুষের সঙ্গে সমানতালে কাজ করতে বেশ পটু। কখনো হাঁটুপানিতে নেমে পাট পরিষ্কার করা, কখনো পুরুষের পাশাপাশি মাঠে কাজ করা, ধান কাটা, ধান মাড়াই ও ফসল উৎপাদনের মতো কাজ তাঁরা আনায়াসে করতে পারেন। কিরিং কিরিং শব্দে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও সাইকেল চালিয়ে স্কুল, কলেজ ও কর্মক্ষেত্রে যেতে বেশ পারদর্শী।

ধান, গম, আম, কাঁঠাল, সবজি, পাট ও চা–পাতা, সবুজ শ্যামল সব মিলিয়ে পরিপূর্ণ আমার গ্রাম। আঞ্চলিক ভাষার ভিন্নতা, তীব্র শীতে অতিথি পাখির আগমনের কলতান, কখনো কখনো শীতকালে বাড়ির উঠোন থেকে দেখতে পাওয়া কাঞ্চনজঙ্ঘা অপূর্ব সৌন্দর্যের মুগ্ধতায় ডুবে থাকে ছোট্ট এলাকার আশপাশ। কখনো কখনো হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় আধুনিকতার ছোঁয়া। আবার কখনো পাওয়া যায় গ্রামীণ জীবনের নির্মল ভূমি, সচ্ছ জল, বিশুদ্ধ বায়ু। লাহিড়ী হাটকে ঘিরে কাটানো শৈশব–কৈশোর এখানেই লুকানো আমার অস্তিত্ব। নিজেকে বারবার খুঁজে পাই এই গ্রামের ভূমিতে, জলে, ঝরে পড়া শিশির কণায়। খুজেঁ পাই নহনা নদীর মোহনায়।

শিক্ষার্থী, ইডেন মহিলা কলেজ, ঢাকা