মখমলের বৃত্ত

লেখক বন্ধু উৎসবে লেখকছবি: আশরাফুল আলম

মাটির সিন্দুকের মুখের ওপর হাত দিয়ে তার চোখ স্পর্শের চেষ্টা করলে সে বুঝে যায় আমার জেগে ওঠার সময় হয়েছে। পাঁজরের ঢাকনা খুলে দিল নীরবে। সে চায় না, আজকের দিনে আমি মখমলের বৃত্তে পৌঁছানোর জন্য রওনা হই। তার চাওয়া আজ সে সিন্দুক থেকে মানুষ হবে—হবে প্রেমিক! এতগুলো জীবন তার মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা সত্ত্বেও কখনো পুরুষ হওয়ার ইচ্ছা দেখিনি—দেখেছি অস্থির মানুষ হওয়ার।

তার নীরব চোখ, বুকের আঙিনা, আঙুল ছেড়ে বেরিয়ে পড়ি মখমলের বৃত্তের পথে। সূর্য যেন পুরোনো শত্রুতায় ঢেলে দিচ্ছে উত্তাপ জনজীবন নগরের নুনভাতে। লোকাল বাসের উদ্ভট গন্ধ, ভাঙা কাচের জানালা আমাকে ডাকতে থাকে। আমার কাছে মূল্য আরোপিত কাগজের সংখ্যা খুব কম। ফিরে আসতে হবে আবার মাটির সিন্দুকে; হিসাব করতে করতে বাসে উঠে বসি।

বাসের মধ্যে থাকা চারপাশের চোখগুলো কেমন অদ্ভুত! নীল রঙের আধা পুরোনো শার্ট পরা ভদ্রলোকের চোখ থেকে ভাঙা পিয়ানোর সুর আসে। পেছনের সিটের বয়স্ক স্বল্পশিক্ষিত ভদ্রমহিলার চোখ দুটো সাদাকালো টেলিভিশনের পর্দার মতো চার কোণ হয়ে আছে! মুখে সিগারেট থাকা লোকটার চোখ স্মার্টফোনের স্ক্রিন স্ক্রল করার মতো ওপর-নিচ হতে থাকে এবং সেখানে নানা চিত্র ফুটে ওঠে।

আমার পাশে বসা শিশুটির চোখে ক্লান্তি, মুগ্ধতা আর গন্তব্যে যাওয়ার অপেক্ষা! মুগ্ধতার নিমিষেই শিশুটি আকাশে পৌঁছে যায়, যে আকাশে জলরঙের মেঘের পোশাক পরা একটা সোর্ড লিলি তারই পাশে আকাশপথে বসে আছে লোকাল বাসে! হঠাৎ করে শিশুটি বমি করে দেয় আমার ওপর। বিব্রত হয়ে পড়ি।

বাস চলছে-থামছে, কেউ উঠছে-নামছে। আমার হার্টবিট বেড়েই চলছে। বাস গাবতলী এলে নেমে পড়লাম। হাঁটতে থাকি টেকনিক্যাল মোড় যাওয়ার জন্য। সেখানে দেখলাম, একটা মেয়ে আমার বয়সের থেকে একটু বেশি বা কম হবে, মাথায় ঘা। পিরিয়ডের চিহ্ন সালোয়ারজুড়ে শুকিয়ে দাগ রেখে গেছে। মাথা থেকে আসা রক্ত গায়ে–হাতে লেগে আছে মেহেদির রঙের মতো। আমি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে দেখছি তাকে। ভুলে গেছি মখমলের বৃত্তের কথা। একটা ফুটপাতের দোকান থেকে কলা–পাউরুটি নিয়ে খাওয়ার জন্য বসতে গেলে মেয়েটিকে দোকানি বলল, এখানে নয়, দূরে যা!

মেয়েটির অপরিষ্কার হাত ধরে তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি, অপরিচ্ছন্ন পোশাক, নেশার ছাপ! আশপাশেই থাকে। আমার মাথায় তখন চিনচিনে ব্যথা উঠল। ভাবনার ধারালো থাবা থেকে নিজেকে সরিয়ে মেয়েটির দুটো ছবি তুলি, টেকনিক্যাল মোড় ঢাকা লোকেশন লিখে টাইমলাইনে পোস্ট করে সামাজিক সংগঠনগুলোকে এগিয়ে আসতে বলি। অন্তত মেয়েটি সুস্থ হয়ে বাঁচুক।

নিজের দিকে তাকিয়ে দেখি ঘামের আদরে স্নান দিয়ে উঠেছি। হাঁটতে হাঁটতে কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করি, কারওয়ান বাজার কীভাবে যাব? তাঁরা কয়েকটি বাস দেখিয়ে দিলেন। আবারও লোকাল বাস। হরেকরকম মানুষ। কেউ লেওনার্দোর মোনালিসার মতো, কেউ চার্লি চ্যাপলিনের বৃষ্টিতে হাঁটা চোখের জল লুকানো কৌশলধারী। কেউ আবার হ্যানিম্যানের মতো নীতিতে অটল! ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের মতো কেউ। কেউ নিজাম উদ্দিন আউলিয়া, জালাল উদ্দিন রুমির মতো। কেউ মিসরের পিরামিডের মতো রহস্যময়। দীর্ঘশ্বাস আমার ক্লান্তি বাড়িয়ে দিল!

চোখ পড়ল কিছু মানুষের দিকে। হাতে রাখা ফাইলে দেখলাম বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরির পরীক্ষার প্রশ্ন। ভেতর থেকে বুকের দরজায় দেওয়া খিল ভেঙে হেঁয়ালির হাসি হেসে নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী করলি জীবনে? সবাই চাকরির পরীক্ষা দিয়ে ফিরছে, আর তুই? সামান্য কবিতার জন্য, লেখালেখির জন্য ছুটে চলেছিস জীবনের শুরু থেকে। আজ আবার মখমলের বৃত্তে যাচ্ছিস...তোর মূল্য নেই।’

পথ চিনি না; বাস আমাকে তাই কারওয়ান বাজারে না নামিয়ে মৌচাকে নামিয়ে দিল। সেখান থেকে আবার উল্টো পথে অন্য বাসে রওনা হই। প্রচণ্ড উত্তাপ, আগ্নেয়গিরির লাভা যেন টগবগ করছে আমার চোখেমুখে, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। কারওয়ান বাজার নেমে কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলাম, প্রথম আলো অফিসটা কোন দিকে? তাঁদের যদি বলি, মখমলের বৃত্ত কোন দিকে; তাহলে তাঁরা বুঝবেন না। তাই বাধ্য হয়ে আমার দেওয়া সোহাগী নামে ডাকলাম না। লিফটে ওপরের দিকে যাচ্ছিলাম। আমার মতো আরও অনেক প্রাণ এসেছে মখমলের বৃত্তের ডাকে। খাতায় এন্ট্রি করে সভাকক্ষে এলাম। এখানে কৃত্রিম শীতলতা স্বস্তি দিচ্ছে নির্দ্বিধায়। মাটির ঘরের দেয়ালে আঁকা অসম্ভব সুন্দর আলপনার মতো লেখা ‘লেখক বন্ধু উৎসব’।

বুকের বাঁ পাশে হাত রাখি। মনের মুখ দিয়ে মাটির সিন্দুকের কানে কানে বলি, আমি এসেছি...দেখো, কেমন লাল বৃত্ত সূর্যের মতো, প্রথম শব্দের পরে সূর্যের প্রতীক, তারপর আলো লেখা। ওই সূর্যটাই মখমলের বৃত্ত আজকে আমাদের লেখক বন্ধু প্রাণের জন্য।

মাটির সিন্দুক নীরব থাকে। আমার দীর্ঘশ্বাস ১০ তলার কাচের জানালার পর্দা ভেদ করে নিচে থাকা লোকালয়ে তাকিয়ে বিস্মিত হয়! পাশের ট্রেনলাইনে সবাই দেখে ট্রেনের এগিয়ে চলা, আমি দেখি জীবনসম গুরুত্বে হামাগুড়ি দিয়েও সামনে যেতে চাওয়া পরিকল্পিত স্বপ্নের সূক্ষ্ম শরীর!

যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, সিরাজগঞ্জ বন্ধুসভা