এসডিজি রচনা প্রতিযোগিতা (তৃতীয় স্থান)

টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট
ছবি: সংগৃহীত

শোভন কাজ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি

ভূমিকা

‘আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি
তাঁর পিঠে রক্তজবার মতো ক্ষত ছিল
কারণ তিনি ক্রীতদাস ছিলেন।’...

কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ তাঁর এই কবিতার মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রাচীন শ্রমব্যবস্থার কথা তুলে ধরেছেন। ভূস্বামীরা একসময় নামমাত্র মজুরির বিনিময়ে দরিদ্র মানুষকে কৃষিকাজে বাধ্য করেছেন। মাঠভরা সোনালি ফসল ফলিয়েও দিনের পর দিন অভুক্ত থেকেছে কৃষক। উপরন্তু দুর্বল শরীরে উপযুক্ত পরিশ্রম করতে না পারায় অমানুষিক নির্যাতন সইতে হয়েছে। প্রহারের কঠিন আঘাতে দুর্বল কৃষকের শরীর রক্তজবার মতো রক্তাক্ত হয়েছে। ভূমিহীন দিনমজুর কৃষককে হতে হয়েছে ক্রীতদাস। এ উপমহাদেশে ইংরেজ শাসনামলে নীলকর সাহেবদের অত্যাচারও ছিল সীমাহীন। তাঁরা দরিদ্র কৃষককে তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে খাদ্যশস্যের পরিবর্তে জমিতে নীল চাষে বাধ্য করে। এরপর পরিস্থিতি বদলায়। পুঁজিপতি অনেকেই শিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হন। কিন্তু শ্রম ছাড়া কোনো উৎপাদনই সম্ভব নয়। তাই মাঠের অনেক কৃষককে কারখানার শ্রমিক হতে হয়। এখানেও পুঁজিপতিরা শ্রমিকের সঙ্গে ক্রীতদাসের মতো আচরণ করেন। নামমাত্র মজুরির বিনিময়ে শ্রমিককে তার সর্বশক্তি দিয়ে কারখানার চাকা সচল রাখতে হয়। অথচ শ্রমিকের জীবনের নিরাপত্তা ছাড়া উৎপাদনশীল মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় পুঁজিপতিরা তা ভুলে যান। শ্রম এবং মেধা দিয়ে যে উৎপাদন, তা থেকেই মূলত সমাজ বিকশিত হয়, পুঁজি বিকশিত হয়।

১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকেরা দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলন করেছিলেন। সে সময় তাঁদের নির্দিষ্ট কোনো কর্মঘণ্টা ছিল না। নামমাত্র মজুরিতে তারা মালিকদের ইচ্ছানুযায়ী কাজ করতে বাধ্য হতেন। হে মার্কেটে ধর্মঘটী শ্রমিক সমাবেশে পুলিশ গুলি চালালে বেশ কজন শ্রমিক নিহত হন। এর প্রতিবাদে ৪ মে হাজার হাজার শ্রমিক বিক্ষোভ করলে সেদিনও পুলিশের গুলিতে শ্রমিকেরা প্রাণ হারান। আন্দোলন করার অপরাধে কয়েকজনকে মৃত্যুদণ্ডও দেওয়া হয়। এভাবে প্রাণের বিনিময়ে শ্রমিকেরা দৈনিক আট ঘণ্টা শ্রমের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অথচ এখনো অনেক বেসরকারি শিল্পকারখানায় আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার নির্ধারিত শ্রমঘণ্টা মানা হয় না। শ্রমিক তাঁর ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হন। একই কাজ করে নারী-পুরুষের পারিশ্রমিকের অনেক ব্যবধান দেখা যায়। তা ছাড়া শ্রমিকেরা যে পরিবেশে কাজ করেন, সেই পরিবেশও অনেক ক্ষেত্রে আশানুরূপ হয় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা মারাত্মক ও ঝুঁকিপূর্ণ। এ ধরনের অস্বাস্থ্যকর ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে বারবার দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু তারপরও কি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বোধোদয় হয়? হয় না। আগুনে পুড়ে ও ভবন ধসে বহু শ্রমিককে প্রাণ দিতে হয়। দুর্ঘটনার পর হয়তো দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানের জন্য তদন্ত হয়। কিন্তু যাঁরা প্রাণ হারান কিংবা মারাত্মকভাবে আহত হন, তাঁদের পরিবার-পরিজনরাই দুর্ভোগে পড়েন। এসব ঘটনা থেকে এটিই প্রমাণিত হয় যে শ্রমিকেরা যেখানে বা যে কাজটি করছেন, সব ক্ষেত্রে তা শোভন নয়। অর্থাৎ কাজের পরিবেশ বা কাজ কোনোটাই হয়তো শোভন নয়।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য

জাতিসংঘ বিশ্বের জাতিসমূহের একটি সংগঠন। এই সংগঠনের লক্ষ্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আইন, নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক অগ্রগতি এবং মানবাধিকার বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি করা। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা জাতিসংঘের তেমনই একটি কর্মসূচি। ইতিপূর্বে জাতিসংঘ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা মিলেনিয়াম উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে। এবার এসডিজি কর্মসূচির অন্যতম লক্ষ্য বিশ্বব্যাপী সবার জন্য একটি অভিন্ন টেকসই ভবিষ্যৎ অর্জনের অভিযাত্রা। এ জন্য ২০১৬ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে মোট ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা ও ১৬৯টি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

এসডিজির ১৭টি লক্ষ্যমাত্রার অষ্টম ধাপ হচ্ছে: ‘শোভন কাজ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি’। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ভালো কাজ এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেছে, ‘টেকসই, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, পূর্ণ ও উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান এবং সবার জন্য উপযুক্ত কাজের প্রচার করুন।’ অর্থাৎ একটি টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে সবার জন্য উৎপাদনমুখী ও শোভন কাজ প্রয়োজন। এই যে ভালো কাজ বা শোভন কাজের কথা বারবার বলা হচ্ছে, শোভন কাজটা আসলে কী? মোটা দাগে বিষয়টি এ রকম—শোভন কাজে উৎপাদনশীলতা, সুষ্ঠু আয়, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা, পরিবারের জন্য সামাজিক সুরক্ষা, কথা বলার স্বাধীনতা এবং সব নারী ও পুরুষের জন্য সমান সুযোগ ও চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা থাকা বাঞ্ছনীয়।’

জাতিসংঘের এসডিজির অভীষ্ট ৮-এর লক্ষ্যমাত্রায় বিষয়গুলো আরও স্পষ্ট। সংক্ষেপে এভাবে বলা যায়- (৮.১) মাথাপিছু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বজায় রাখা এবং স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে বার্ষিক ন্যূনতম ৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন, (৮.২) উচ্চমূল্য সংযোজনী ও শ্রমঘন খাতগুলোতে বিশেষ গুরুত্ব প্রদানসহ বহুমুখিতা ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, (৮.৩) অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ক্রমোন্নতিতে উৎসাহিত করা, (৮.৪) ভোগ ও উৎপাদনে বৈশ্বিক সম্পদ-দক্ষতার ক্রমাগত উন্নতি সাধন, (৮.৫) যুবসমাজ ও প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীসহ সকল নারী-পুরুষের জন্য পূর্ণকালীন উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান ও শোভন কর্মসুযোগ সৃষ্টি এবং সমমর্যাদার কাজের জন্য সমান মজুরি প্রদান, (৮.৬) কর্মে, শিক্ষায় বা প্রশিক্ষণে নিয়োজিত নয় এমন যুবকদের অনুপাত কমিয়ে আনা, (৮.৭) জবরদস্তিমূলক শ্রমের উচ্ছেদ, মানব পাচার ও আধুনিক দাসত্বের অবসান এবং শিশুসৈনিক সংগ্রহ ও শিশুশ্রমের অবসান ঘটানো, (৮.৮) প্রবাসী নারী শ্রমিকসহ সব শ্রমিকের জন্য নিরাপদ ও সুরক্ষিত কর্মপরিবেশ প্রদান, (৮.৯) স্থানীয় সংস্কৃতি ও পণ্যসম্ভারের প্রবর্ধন সহায়ক ও কর্মসৃজনমূলক টেকসই পর্যটনশিল্প প্রসারের অনুকূলে নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, (৮.১০) সবার জন্য ব্যাংকিং, বিমা ও আর্থিক সেবায় প্রবেশাধিকার প্রসারণ, (৮.ক) উন্নয়নশীল দেশ বিশেষ করে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য ‘বাণিজ্য-প্রবর্ধন সহায়তা’ সংশ্লিষ্ট সহযোগিতা বৃদ্ধি করা এবং (৮.খ) যুব কর্মসংস্থানের জন্য একটি বৈশ্বিক কৌশল প্রণয়ন।

২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি বাস্তবায়নে ইতোমধ্যে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন বিষয়ে ঐকমতে৵ পৌঁছেছেন। আদ্দিস আবাবা কর্মসূচি এবং প্যারিস জলবায়ু চুক্তি অনুষ্ঠানে সদস্য দেশগুলোকে এই মর্মে আশ্বস্ত করেছেন যে তাঁরা চরম দারিদ্র্যের অবসান ঘটাবেন। এই বিশ্বকে তাঁরা একটি টেকসই উন্নয়নের পথে পরিচালিত করতে চান। টেকসই উন্নয়নে ২০৩০ সালের কর্মসূচি মূলত একটি বৈশ্বিক কর্মসূচি। বিশ্বব্যাপী সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাসহ দারিদ্র্য ও অসমতা মোকাবিলা করে অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থা এর অন্যতম লক্ষ্য। আর এই লক্ষ্যের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, কাউকে পেছনে ফেলে না রাখার অঙ্গীকার। অর্থাৎ কোনো দেশ বা জাতিগোষ্ঠীকে পেছনে রেখে মুষ্টিমেয় কোনো দেশ বা জনগোষ্ঠী এগিয়ে যাবে না।

শ্রমিকের অধিকার ও শোভন কাজ

উন্নত দেশগুলোতে শ্রমজীবী মানুষের কর্ম ও কর্মপরিবেশ উন্নত। এ জন্য তাঁরা তাদের দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেও মূল্যবান অবদান রাখতে সক্ষম হন। সেদিক থেকে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের শ্রমিকেরা অনেক পিছিয়ে আছেন। বাংলাদেশে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের শ্রমিকেরা কিছুটা স্বস্তিতে থাকলেও সব ব্যক্তিমালিকানা খাত শ্রমজীবী মানুষের জন্য স্বস্তিকর নয়। এ ক্ষেত্রে সুস্থ ধারার ট্রেড ইউনিয়নের নেতারাও শ্রমিকদের পক্ষে কথা বলার সুযোগ পান না। ফলে শ্রমিকেরা বঞ্চিত হন। শ্রমিকরা সামাজিক নিরাপত্তার দাবিতে সোচ্চার হলেও দিন শেষে তাদের সে দাবির আওয়াজ পুঁজিপতিদের কানে পৌঁছায় না। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ সিপিডির একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনার প্রথম ধাক্কার সময় চার মাসের মজুরি দিতে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে সরকার। শর্ত ছিল, শ্রমিক ছাঁটাই করা যাবে না। স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। তবে প্রণোদনা তহবিল থেকে ঋণ পাওয়া এক-তৃতীয়াংশ কারখানা শ্রমিক ছাঁটাই করেছে। এর বাইরেও প্রচুর শ্রমিক ছাঁটাইয়ের শিকার হয়েছেন। সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে তিন লাখ শ্রমিক ছাঁটাইয়ের শিকার হন। ছাঁটাইকালে আইনি সুরক্ষার বিষয়গুলোও সেভাবে পরিচালিত হয়নি। এই গবেষণা প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে ছাঁটাই হওয়া শ্রমিকের ৪২ শতাংশ পূর্ণ মজুরি পেয়েছেন। ৩৬ শতাংশ পেয়েছেন আংশিক মজুরি। অর্থাৎ এখানেও তাঁরা তাদের ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।

আর্থসামাজিক বাস্তবতায় আমাদের দেশের একজন শ্রমিক তাঁর হাড়ভাঙা পরিশ্রমের অর্থে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে কি সন্তুষ্ট হতে পারছেন? যদি তা না হয়, তাহলে এটি স্পষ্ট যে শ্রমিকের কাজটি শোভন নয়। এখানে শ্রমিক তাঁর কাজ, পারিশ্রমিক ও কাজের পরিবেশ নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারেন না বলেই তাঁরা নিত্যনতুন প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থানের জন্য ধরনা দেন। বাংলাদেশে ইপিজেডসহ বিভিন্ন স্থানে বহু বিদেশি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থানের আশায় শ্রমিকেরা দিনের পর দিন অপেক্ষা করে থাকেন। কারণ, তাঁরা সেখানকার কাজ, পারিশ্রমিক ও কাজের পরিবেশ সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জেনেছেন। তাঁরা জেনেছেন, সেসব প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকদের বিনা মূল্যে খাবারের ব্যবস্থা রয়েছে। খাবারের মান ঠিক আছে কি না, তা নিশ্চিত করার জন্য সপ্তাহে অন্তত একদিন কর্মকর্তা পর্যায়ের কাউকে শ্রমিকদের মাঝে বসে খেতে হতো। সেখানে খাবার পরীক্ষার জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত পুষ্টিবিদ, চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা রয়েছেন। তাঁরা প্রতিদিনের খাবার কারখানায় পরিবেশনের আগেই পরীক্ষা করে দেখেন। এই যে কারখানা বিনা মূল্যে শ্রমিকদের মধ্যে মানসম্মত খাবার সরবরাহ করছে, এতে কারখানা কি লাভবান হচ্ছে না? নিশ্চয়ই হচ্ছে। খাবারের জন্য শ্রমিককে বাইরে গিয়ে শ্রমঘণ্টা নষ্ট করতে হচ্ছে না। উপরন্তু মানসম্মত খাবারে সুস্বাস্থ্যে শ্রমিক তাঁর কাজে বেশি মনোযোগী হচ্ছেন।

কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবা এবং নিরাপত্তা সুবিধা প্রতিটি শ্রমিকের আইনগত অধিকার। শ্রম আইন ২০০৬–এর অধীনে পেশাগত স্বাস্থ্যসেবা এবং নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিষয়গুলো হচ্ছে পরিচ্ছন্নতা, বায়ু চলাচল এবং তাপমাত্রাব্যবস্থা, কৃত্রিম আর্দ্রকরণ, জনবহুলতা, আলোর ব্যবস্থা, অগ্নিসংক্রান্ত ঘটনা, অতিরিক্ত ওজন, ভবন ও যন্ত্রপাতির সুরক্ষা, বিস্ফোরক বা দাহ্য গ্যাস ও ধুলা, বিপজ্জনক ধোঁয়ার বিরুদ্ধে সতর্কতা, ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষামূলক সরঞ্জাম, ঝুঁকি মূল্যায়ন এবং প্রতিরোধব্যবস্থা। নারী শ্রমিকেরা তাঁদের কর্মপরিবেশে নানা ধরনের অশোভন আচরণ ও হয়রানির শিকার হন। অথচ প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ শোভন হলে নারী শ্রমিকেরা প্রতিষ্ঠানকেই কাজের আদর্শ স্থান বিবেচনা করতেন। একজন শ্রমিকের এই নিশ্চয়তাটুকুর বেশি আর কী প্রত্যাশা থাকে? যে কাজের মাধ্যমে একজন শ্রমিক পরিবার-পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকার আশা খুঁজে পান না, সেটি তাঁর জন্য অশোভন কাজ। এই অশোভন কাজে একজন শ্রমিক কখনো তাঁর মেধা ও মননের পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে পারেন না। ফলে উৎপাদন বিঘ্নিত হয়। আর উৎপাদন বিঘ্নিত হওয়ার অর্থ হচ্ছে, সার্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হওয়া। শোভন কাজ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি একে অন্যের পরিপূরক। একটি বাধাগ্রস্ত হলে অপরটিও মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য।

উত্তরণের চ্যালেঞ্জ

বর্তমানে সারা বিশ্ব এক মারাত্মক অর্থনৈতিক চাপের সম্মুখীন। এ জন্য সাম্প্রতিক বিভিন্ন ঘটনা দায়ী। কিন্তু এ অবস্থা প্রলম্বিত হতে দেওয়া যাবে না। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার যেসব কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, তার মধ্যে রয়েছে ১. কোভিড-১৯–এর নতুন সংক্রমণ ঢেউ, ২. মুদ্রাস্ফীতি, ৩. সরবরাহব্যবস্থায় বিঘ্নতা, ৪. নীতি অনিশ্চয়তা এবং ৫. শ্রমবাজারের চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া অতি সম্প্রতি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এক নতুন অচলাবস্থা সৃষ্টি করেছে। এই সংকটের ফলে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার আরও পিছিয়ে পড়েছে। এদিকে ২০২০ সালে জাতিসংঘের এক জরিপে দেখা যায়, প্রতি ১০ জন শিশুর মধ্যে ১ জন শিশু শ্রমিক। এই হিসাবে বর্তমান বিশ্বে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি। এটিও নিঃসন্দেহে নেতিবাচক দিক।

এদিকে বাংলাদেশ এখন একটি উন্নয়নশীল দেশের যুগে প্রবেশ করেছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশে শ্রম খাতের অসামঞ্জস্যতার কোনো সুযোগ নেই। অসংগঠিত শ্রমিকদের সুরক্ষা দিয়ে তাঁদের স্থায়ী কাজের আওতায় আনতে হবে, যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। এটি উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনেও সহায়ক। বৈশ্বিক করোনাভাইরাসের ক্ষতি থেকে অর্থনীতির দ্রুত পুনরুদ্ধারে উৎপাদনশীলতা বাড়ানো এখন সবচেয়ে জরুরি। এই লক্ষ্য অর্জনে সরকার কাজ করছে। শোভন কর্মপরিবেশ ও কাজের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ সমতা উন্নয়নেও কাজ করছে সরকার। সরকারের এসব লক্ষ্য অর্জনে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত। সরকার, নিয়োগকর্তা ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে এই সংস্থা সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করতে পারে। শোভন কাজ বলতে প্রধানত কাজের পরিবেশ ও নিরাপত্তার কথা বলা হয়েছে। শ্রমিকের অধিকার এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সামাজিক নিরাপত্তাও এই অধিকারের অংশ।

আবার পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও অনানুষ্ঠানিক খাত রয়েছে। এটা কৃষি থেকে শুরু করে ফুটপাতের ফেরিওয়ালা, গাড়ির ড্রাইভার, কাগজের হকারের পেশাও হতে পারে। দেশের জিডিপিতে আত্মকর্মসংস্থানমূলক এ ধরনের কর্মকাণ্ডের অবদান খুব কম নয়। অথচ এই খাতের উদ্যোক্তারা করসহ সব ধরনের আর্থিক নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকেন। তারা প্রচলিত আইনি সুরক্ষা থেকেও বঞ্চিত হন। উন্নয়নশীল বিশ্বে মোট শ্রমশক্তির ৮০ থেকে ৯০ শতাংশই এই খাতে যুক্ত। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার তথ্য মতে, সারা বিশ্বে কর্মরত শ্রমশক্তির ৬০ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মীদের নির্ধারিত কোনো মজুরি কিংবা কাজের কোনো চুক্তিপত্র থাকে না। এদিকে বাংলাদেশে জিডিপিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের অবদান ২৫ শতাংশের মতো। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এসডিজির সফল বাস্তবায়নে সব ধরনের কাজকেই গুরুত্ব দিতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, এসডিজির লক্ষ্য অনুযায়ী শোভন কাজ তৈরির পরিবেশ সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই। অনানুষ্ঠানিক খাতসহ ক্ষুদ্র-মাঝারি এবং সব খাতের সার্বিক উন্নতির মধ্য দিয়েই সামগ্রিক অর্থনীতিরই উন্নতি সম্ভব। অনানুষ্ঠানিক খাতগুলোকে ধীরে ধীরে আনুষ্ঠানিক খাতে রূপান্তর করারও এখন সময় এসেছে। অর্থাৎ আনুষ্ঠানিক খাত বৃদ্ধির পাশাপাশি দেশে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসার সুযোগ সৃষ্টি হবে। উদ্যোক্তারাও ক্রমশ আগ্রহী হয়ে এগিয়ে আসবেন।

২০১৬ সালে ইন্দোনেশিয়ার পর্যটন শহর বালিতে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার ষোড়শ আঞ্চলিক সম্মেলনে ‘ভালো কাজ’ বা শোভন কাজকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। সম্মেলনে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর সরকার, নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ও শ্রমিক প্রতিনিধিরা এ অঞ্চলে শোভন কাজের সংখ্যা বাড়াতে সম্মত হন। সম্মেলন শেষে বালি ঘোষণায় বলা হয়, এ অঞ্চলের দেশগুলো উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক উন্নতি করেছে। দেশগুলোর আয় বেড়েছে, দারিদ্র্য কমেছে, সামাজিক সুরক্ষার আওতা সম্প্রসারিত হয়েছে। কিন্তু তারপরও বহু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। এখনো ১০০ কোটির বেশি শ্রমিক কর্মসংস্থান নিয়ে নানা ধরনের ঝুঁকির মধ্যে আছে। আয়বৈষম্যও বেড়ে গেছে।
শ্রমের ক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা অসম্ভব কিছু নয়। শ্রমিকের দক্ষতা উন্নয়ন, শিশুশ্রম নিরসন, তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো, নারী-পুরুষের বৈষম্য কমানো, অভিবাসী শ্রমিকের অধিকার সুরক্ষা ইত্যাদি বিষয় নিশ্চিত করা এখন বেশি জরুরি। আর এসব উদ্যোগ সফল করার মধ্য দিয়েই শোভন কাজ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব।

শিক্ষার্থী, প্রথম বর্ষ, ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়