মানসিক ট্রমা থেকে উত্তরণের উপায়

যেকোনো বয়সেই ট্রমা হতে পারে। এটি স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি হতে পারেপ্রতীকী ছবি

একটা অস্থির পরিস্থিতি শেষ না হতেই আরেকটি দুর্যোগ আমাদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে—ভয়াবহ বন্যা। আমাদের প্রায় সবারই ঘুমাতে, খেতে ও দৈনন্দিন কাজকর্ম করতে ব্যাঘাত ঘটছে। চোখ বন্ধ আর খোলা—সব অবস্থাতেই বন্যায় ভেসে যাওয়া মানুষ, শিশু, বৃদ্ধ ও পশুপাখির দৃশ্য দেখতে হচ্ছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় চোখের সামনে মেরে ফেলা ভাই ও সন্তানদের ছবি ভেসে ওঠে। আজও কানে শুনতে পাই ‘পানি লাগবে, পানি...’ মুগ্ধর সেই কণ্ঠ, সঙ্গে মৌমিতাকে নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। কেউ ভালো নেই আমরা।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও সাম্প্রতিক বন্যার পরিপ্রেক্ষিতে বাস্তবে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় নৃশংসতার নানা ছবি ও ভিডিও দেখতে দেখতে আমরা অনেকেই ট্রমাটাইজ হয়ে আছি। কিন্তু এই ট্রমা আসলে কী এবং কীভাবে এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়া যায়! চলুন জেনে নিই—

মানসিক ট্রমা: ট্রমা এমন একটি মানসিক অবস্থা, যা কোনো নেতিবাচক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ঘটে থাকে। এটি কষ্টদায়ক, চাপমূলক ও ভীতিকর ঘটনা, যা স্বাভাবিকের বাইরে চলে যায়। এটি একটি মানসিক শক বা ক্ষত।

মানসিক ট্রমা এমন একটি অবস্থা, যেখানে একজন ব্যক্তির জীবনে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনার কারণে সেই ব্যক্তি অনেক চাপ অনুভব করেন। এটি একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে হতে পারে, আবার কোনো পরিস্থিতির কারণেও হতে পারে। কোনো সহিংসতা বা কোনো দুর্ঘটনার কারণে যখন আমাদের মধ্যে চাপমূলক, ভীতিকর ও কষ্টকর অবস্থার তৈরি হয়, সেটাকে কেন্দ্র করে আমাদের মানসিক পরিস্থিতি যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তখন আমরা বলতে পারি আমি ট্রমাটিক অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।

ট্রমায় সবাই কি আক্রান্ত হই
ট্রমায় সবাই একইভাবে আক্রান্ত হয় না। ব্যক্তিভেদে আবেগপ্রবণ অবস্থার ব্যবস্থাপনা ও গ্রহণ করার ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে ভিন্ন হতে পারে। ট্রমার কোনো বয়সসীমা নেই। যেকোনো বয়সেই ট্রমা হতে পারে। এটি স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে।

কীভাবে বুঝব
* দৈনন্দিন জীবনের কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে।
* অসহায়ত্ব ও পৃথিবীটাকে ভয়ানক মনে হতে পারে।
* ঘটনাটা বারবার মনে পড়বে।
* দুঃস্বপ্ন দেখতে পারি।
* ফ্ল্যাশব্যাক হতে পারে।
* ব্রিদিং ওঠানামা করতে পারে।
* নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে পারি।
* নাকে গন্ধ অনুভব ও শব্দ শুনতে পারি।
* বিশ্বাসে পরিবর্তন আসতে পারে।
* অমনোযোগী হওয়া।
* ঘুম কমে যাওয়া বা বেড়ে যাওয়া।
* খাওয়া বেড়ে যাওয়া বা কমে যাওয়া।
* মাথাব্যথা হতে পারে।

যে অনুভূতিগুলো অনুভব করতে পারি
* ভয়, আতঙ্ক, দুঃখবোধ, অস্থিরতা, উৎকণ্ঠা, অশান্তি, চমকে ওঠা, বিচ্ছিন্নতা, অসহায়ত্ব, অপরাধবোধ, রাগ ও ক্লান্তিবোধ।

কারণ:
* সহিংসতা।
* সরাসরি ঘটনাস্থলে থেকে দেখা বা অভিজ্ঞতা হওয়া।
* কারও কাছ থেকে জানা।
* টেলিভিশন ও মিডিয়ায় দেখা।
* কোথাও পড়া এবং তা যদি কল্পনা করা।
* প্রাকৃতিক বিপর্যয়।
* ধর্ষণ।
* গুরুতর অসুস্থতা বা আঘাত।
* অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু।

ট্রমা কীভাবে ব্যবস্থাপনা করতে পারি

আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য:
* এই লক্ষণগুলো যখন দেখব বা অনুভব করব, ওই মুহূর্তে নিজেকে অ্যাপ্রিশিয়েট করব যে আমি চিহ্নিত করতে পেরেছি, আমার কী হয়েছে।
* নিশ্বাসের ব্যায়াম করা (গভীরভাবে নিশ্বাস ভেতরে টেনে নিয়ে নাক দিয়ে ছেড়ে দেব)। এক থেকে পাঁচবার, রিলাক্স না হওয়া পর্যন্ত।
* যে অনুভূতিটা আমার মধ্যে হবে, তা গ্রহণ করব। নিজেকে বলব, এমন পরিস্থিতিতে আমার এমন অনুভব করাই স্বাভাবিক। কান্না এলে কান্না করব।
* নিজের প্রতি জাজমেন্টাল না হয়ে একটু যত্ন করব। এমন প্রশ্ন না করা ‘আমার কেন এমন অনুভব হচ্ছে?’
* যাকে বিশ্বস্ত লাগে, এমন কারও সঙ্গে শেয়ার করতে পারি। পরিস্থিতি নিয়ে বিতর্ক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, এমন কারও সঙ্গে কথা বলব না।
* আপাতত যে খবরগুলো নিজের ভেতর স্ট্রেস তৈরি করে, ভয় বা আতঙ্ক তৈরি করে, সেগুলো দেখা, পড়া বা শোনা বাদ দেব।
* নিজেকে বলা, যা ঘটেছে তা আমার হাতে নেই। সবকিছু আমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না।
* কেউ আমার খারাপ লাগা ঘটনাটি নিয়ে কথা বলতে এলে শান্ত ভাষায় বলব, এ বিষয়ে আপাতত কোনো কথা বলতে চাচ্ছি না।
* নিজের যত্নের দিকে নজর দেব। পুষ্টিকর খাবার, ঘুম ও শারীরিক ব্যায়াম করব।
* যেকোনো কাজ করার সময় সে কাজের দিকেই মনোযোগ রাখব। যেমন হতে পারে কিছু খাচ্ছি। কী খাচ্ছি, তার স্বাদ নেব।
* ভালো লাগে বা আরাম দেয়, এমন কোনো কাজ করব।
* সারা দিনের জন্য নতুন করে একটি রুটিন তৈরি করব।
* মদ্যপান ও ধূমপানে বিরত থাকব।
* ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতে পারে, তাই চা ও কফি এড়িয়ে চলব।
* শখের কাজগুলো পুনরায় শুরু করতে পারি।
* পরিবর্তন ধীরে ধীরে আসবে। তাড়াহুড়া না করা। এ চিন্তাটা মাথায় রাখব।
* প্রতিটি কাজের শেষে নিজেকে স্বীকৃতি দেব।
* ট্রমা নিয়ে কাজ করেন, এমন অভিজ্ঞ সাইকিয়াট্রিস্ট ও প্রফেশনাল সাইকোথেরাপিস্টের কাছে যত দ্রুত সম্ভব বসব।

পরিবারের করণীয়
* ট্রমায় আক্রান্ত ব্যক্তিকে সহানুভূতির জায়গা থেকে দেখব।
* ঘটনাটি নিয়ে বারবার প্রশ্ন করব না।
* জাজমেন্টাল হব না।
* শেয়ার করতে চাইলে কোনো ব্যাঘাত না ঘটিয়ে শুনব।
* সাহস ও ভরসা দেব।
* আপনি তার কষ্টটা অনুভব করতে পারছেন, সেটা যেন সে অনুভব করতে পারে। সে জায়গাটা চিন্তা করে কথা বলব।
* দোষ দেব না।
* তাকে আশ্বস্ত করা, সে আপনার কাছে নিরাপদ।
* তার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা শোনার ক্ষেত্রে সম্মান প্রদর্শন করব।
* পরিবর্তন ঘটছে না কেন, তার জন্য চাপ দেব না।
* ছোট ছোট পরিবর্তনগুলোর স্বীকৃতি দেব।

সাইকোথেরাপিস্ট ও ট্রেইনার, মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক কনসালট্যান্ট, সিটি হাসপাতাল লিমিটেড