রহস্য উন্মোচনের তাগিদে পলাশ সাহেব এসেছেন রূপসা নগরে। দেশের প্রথম শ্রেণির একটি পত্রিকার সাংবাদিক। বয়স ত্রিশের মতো। সরকারি অনুমতি নিয়ে পরিত্যক্ত জমিদার বাড়ির একটি রুম পরিষ্কার করে সেখানেই উঠেছেন। এ বাড়ির মানুষগুলো নিরুদ্দেশ। শোনা যায়, যুদ্ধের সময় সনাতন ধর্মের জমিদার পরিবারসহ সীমান্ত পার হয়েছেন। আবার কেউ কেউ বলে, হানাদারদের আক্রমণে পরিবারসহ লেকের জলে আত্মাহুতি দিয়েছেন। তখন থেকেই বাড়িটি সুনসান। পাহারার জন্য যতীন কাকা সরকার থেকে মাসিক কিছু টাকা পায়। দুকূলে কেউ না থাকায় এ দিয়েই জীবন চলে। বাড়িটির তৃতীয় তলার বারান্দায় দাঁড়ালে বিস্মৃত চারপাশ নজর কাড়ে। শীতল হাওয়া গায়ে এসে লাগে। পাশের জঙ্গলে পাখিদের কিচিরমিচির আর জ্যোৎস্নার আলোয় লেকের পানিতে তাকালে চোখ ঝলমলিয়ে ওঠে।
লেকটি যেমন সুন্দর, তেমন ভয়ংকর। লোকমুখে প্রচলিত আছে, লেকটির খাবারে পরিণত হয়েছে বেশ কয়েকজন জীবন্ত মানুষ। এখানকার সবাই এটিকে ‘মানুষখেকো লেক’ বলেই সম্বোধন করে। কিন্তু কী আছে এর জলে, সে কথা এখনো অজানা। এ অজানা রহস্য উন্মোচনের জন্যই পলাশ সাহেবের পোস্টিং রূপসা নগরে। গোসলের জন্য গামছা হাতে পলাশ সাহেব লেকের দিকে এগোতেই যতীন কাকার বাধার মুখে পড়ে।
-ওদিকে যাবেন না সাহেব, আমি আপনাকে গোসলের পানি এনে দিচ্ছি। এই ছোট্ট জীবন অকালে হারাবেন না।
-কিছু হবে না কাকা। তা ছাড়া অনেকেই তো গোসল করছে।
-এ গায়ে আপনি নতুন। রাক্ষসী লেকের নজর পড়তে পারে।
-চিন্তা নাই কাকা। আমি অত সুন্দর না যে নজর লাগবে! হা হা হা।
লেকের পাশে দুজনে ঘণ্টাখানেক বসে থাকেন। হঠাৎ কী এক অজানা কারণে উঠে দাঁড়ান পলাশ সাহেব। চলতে থাকেন বাংলোর অভিমুখে। বিচলিত চেহারা, চোখ জলে ছলছল করছে।
হাসতে হাসতে পলাশ সাহেব যায় লেকের দিকে। অকুতোভয়ে নেমে পড়েন পানিতে। গোসলের ফাঁকে মুহিত নামের এক যুবকের সঙ্গে পরিচয় হয়। মুহিত এখানকার স্থানীয় নয়। সে একটি এনজিওতে চাকরি করে। পলাশ সাহেব মুহিতের কাছে লেক সম্পর্কে জানতে চায়। মুহিত বলে, ‘নিজের চোখে দেখিনি। তবে দেড় বছর আগে একটি ছেলের লাশ ভেসে উঠেছিল। এলাকাবাসী নাকি এমন অনেকের লাশ ভাসতে দেখেছে, যাদের বেশির ভাগই যুবক। অবাক করা বিষয় হলো তারা সবাই অবিবাহিত।’
-তো আপনার ভয় হয় না? আপনি তো যুবক।
-আমি বিবাহিত। তা ছাড়া একসঙ্গে অনেকেই গোসল করে, তাই ভয় লাগে না।
মুহিতকে সঙ্গে নিয়ে নানা গবেষণা চালায় পলাশ সাহেব। গ্রামের প্রবীণদের কাছে লেকের পুরোনো ঘটনাগুলো শোনেন। কীভাবে তারা মারা গেল? কোন কোন সময় লাশগুলো নজরে এসেছে? লাশ তোলার পর শরীরে কেমন ক্ষত ছিল? এই সব নিয়েই তার ব্যস্ততার কমতি নেই। একদিন বিকেলে পলাশ সাহেব বারান্দার ভাঙা চেয়ারে বসে পত্রিকা হাতে লেকের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। হঠাৎ চোখে পড়ে কয়েকজন যুবতী। পলাশ সাহেবের দৃষ্টি কাড়ে সেই দলে থাকা এক মায়াবতী। নাম তার চারু। শ্যামলা মেয়েটির গায়ে লাল পাড়ের সাদা শাড়ি, ছেড়ে দেওয়া লম্বা ঘন চুল, পায়ে আলতা। সিঁড়ি বেয়ে নেমে যান পলাশ সাহেব। গিয়ে লেক পাড়ে বসেন। তাকিয়ে থাকেন মেয়েটির দিকে। বেশ কয়েকবার দুজনের দৃষ্টি এক হয়।
মাঝেমধ্যে মুহিতকে নিয়ে লেকের পাড়ে কবিতা পাঠ করেন পলাশ সাহেব। একটু দূরে বসা চারুর কর্ণদ্বয় দাঁড়িয়ে রয় কবিতার দিকে। একদিন পলাশ সাহেব একগুচ্ছ কৃষ্ণচূড়া নিয়ে চারুকে নিবেদন করেন। চারুও এই কবিতার ভালোবাসা ফেরাতে পারে না। রহস্য অনুসন্ধানের পাশাপাশি ভালোবাসার জোয়ারে ভাসতে থাকেন পলাশ সাহেব। এদিকে সময় গড়িয়ে আসে, ওপরমহল থেকে ডাক আসে ঢাকায় ফিরতে হবে। গবেষণার কাজও শেষের দিকে। এখন সব রিপোর্ট জমা দিলেই একটা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে। দেশ জানতে পারবে রূপসা লেকের আসল কাহিনি। ঢাকায় যাওয়ার দুদিন আগে এলাকাবাসীকে নিয়ে জমিদার বাড়ির প্রাঙ্গণে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। সেখানে পলাশ সাহেব বলেন, রূপসা লেক নিয়ে আপনাদের ভেতর যে ধারণা আছে, তা ভ্রান্ত। এখানে রাক্ষসটাক্ষস কিছুই নেই। আসলে যারা মারা গেছে, তাদের অনেকেই ভালোভাবে সাঁতার জানত না। এ পানির ঘনত্ব অনেক বেশি। তাই খুব ভালো সাঁতার জানা যুবকেরাও হাঁপিয়ে ওঠে। লেকের ভেতরে গিয়ে অতিরিক্ত সাঁতার কাটার ফলে শরীরে ক্লান্তি নেমে আসে। তখন শরীর ছেড়ে দিতে থাকে। ফলে মনে হয়, নিচ থেকে কেউ টানছে আর এই ভয় মানুষকে ডুবিয়ে নিয়ে যায়, যা মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পানির ভেতরে যে বুদ্বুদ দেখা যায়, তা মূলত গ্যাসের জন্য। তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পানিতে দ্রবীভূত গ্যাসের দ্রবণীয়তা হ্রাস পায়। তখন দ্রবীভূত বায়ু বুদ্বুদ আকারে জল থেকে বেরিয়ে যায়…।
আলোচনা শেষে সবার কাছ থেকে বিদায় নেন পলাশ সাহেব। তারপর ছুটে যান অপেক্ষমাণ প্রিয়তমার কাছে। লেকের পাশে দুজনে ঘণ্টাখানেক বসে থাকেন। হঠাৎ কী এক অজানা কারণে উঠে দাঁড়ান পলাশ সাহেব। চলতে থাকেন বাংলোর অভিমুখে। বিচলিত চেহারা, চোখ জলে ছলছল করছে। কিন্তু বাঁধ ভেঙে গড়িয়ে পড়ার জো নেই। যতীন কাকা প্রশ্ন করে, ‘কাঁদছেন কেন সাহেব, কী হয়েছে?’ উত্তর না দিয়ে রুমের দিকে চলে যান তিনি। চোখে ঘুম নেই। গায়ে কালো রঙের একটা চাদর মুড়িয়ে বারান্দায় গিয়ে বসেন। শীতল হাওয়া গায়ে এসে লাগে, লোমগুলো দাঁড়িয়ে যায়। তবু অবিচল চেরাগের নিবু আলোর দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবতে থাকেন পলাশ সাহেব।
ভোর ৪টা ৪৫মিনিট। ঘুটঘুটে অন্ধকার, চারদিক স্তব্ধ। দূর থেকে ভেসে আসে আজানের সুর। যতীন কাকা অজুর পানি নিয়ে আসে। ‘সাহেব এখনো ওঠেননি? দরজাটা সারা রাত খুলে রাখছিলেন নাকি। চোর এলে কিছুই রেখে যেত না।’ বলতে বলতে চেরাগে আগুন জ্বালায় যতীন কাকা। নিবু নিবু আলো নিয়ে এগিয়ে যায় বিছানার দিকে। কিন্তু সাহেব নেই। কই গেল এই অন্ধকারে? পুরো বাংলো খুঁজতে থাকে।‘ সাহেব, ও সাহেব কই গেলেন? নামাজ পড়বেন না?’ দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে শব্দ বুমেরাং হয়। জঙ্গল থেকে বনমোরগের ডাক কানে এসে লাগে। কিন্তু সাহেবের কোনো সাড়াশব্দ নেই। সময় গড়াতে থাকে, সূর্যের কপাল ভেসে ওঠে। বাইরে মানুষের কোলাহল বেড়ে যায়। মুহিতের চিৎকার, ‘কাকা, ও কাকা দৌড়ে এদিকে এসো।’ এর আগে কখনো সে এমন ভাবে ডাকেনি। ছুটে যায় পাহারাদার যতীন। মুহিতের আঙুলের ইশারায় তাকায় লেকের দিকে। চোখে পড়ে রূপসার জলে ভাসমান নিস্তব্ধ পলাশ সাহেব...
বন্ধু, গ্রিন ইউনিভার্সিটি বন্ধুসভা