‘হালদা’ চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্র হাসু বা নুসরাত ইমরোজ তিশা যেন প্রকৃতিকন্যা। হাসু একই সঙ্গে প্রকৃতির প্রেমময় জীবনাচরণের প্রতীক, একজন গর্ভধারিণী, মাতৃত্বের উজ্জীবন এবং সে রূপক অর্থে একটি নদীর পরিচয়ও বহন করে চলে। হাসু নামের এই নদীটি হলো সাক্ষাৎ ‘হালদা’।
প্রাণচঞ্চল ও স্বাধীন নদীটি যেমন বয়ে যেতে পারে, প্রকৃতির ডাকে প্রাণপ্রিয় পুরুষের প্রেমে মজে যেতে পারে। আবার প্রকৃতির ওপর আঘাত এলে, নদীর ধারা কেউ রুদ্ধ করতে চাইলে, আত্মরক্ষার মতো তার প্রতিশোধও নিতে পারে। একই সঙ্গে নদী ও নারী এবং নদীকেন্দ্রিক মানুষের জীবনের গল্প বলে ‘হালদা’। এখানে নদী রক্ষার আন্দোলন হয়, আবার বিচিত্র মানবপ্রকৃতির স্বাধীন সত্তারও মুক্তি লাভ ঘটে।
একদিকে লাগাতার পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন থেকে নদীর মুক্তি, অন্যদিকে গৃহযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত হতে হতে নদীকন্যা এক নারীর মুক্তি। পরিচালক আমাদের এক নির্মম সত্যের সামনে এনে দাঁড় করান।
চট্টগ্রামকে সবাই কর্ণফুলীর শহর বলে চেনে। এই কর্ণফুলীর শিরায় শিরায়, শাখা-প্রশাখায় মিশে আছে আরও অনেক ছোট ছোট নদীর জীবনের গল্প। খাগড়াছড়ি, মানিকছড়ি প্রভৃতি অঞ্চলের পাহাড়ি ঝরনাধারা থেকে নেমে আসা, চাটগাঁর বুকের ভেতর আপন তরঙ্গে বহমান হালদা নামের নদীটি মিশেছে কর্ণফুলীর মোহনায়। প্রাকৃতিক কারণে এই নদীতে ডিম ছাড়ে সব মাছ। গর্ভধারিণী মা মাছের প্রসব কেন্দ্র বা আঁতুড়ঘর। নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বৃহত্তর মৎস্য প্রজনন স্থল। আবার আধুনিক যান্ত্রিক গতিশীল জীবনের তাড়নায় প্রতিটি নদী যেমন ক্ষয়ে যাচ্ছে ভেতরে–বাইরে, এই নদীর মৎস্যজীবন এবং মৎস্যকেন্দ্রিক মানবজীবনও আজ বিপর্যস্ত। নদীর পাশে গড়ে ওঠা কারখানার তৈলাক্ত বর্জ্য, ইটভাটার প্রাকৃতিক দূষণ—সবকিছুর কবলে পড়ে মা মাছ আর ডিম ছাড়তে পারে না। পোনা মাছ বেড়ে ওঠে না। দেশের সোনা তবে আসবে কোথা থেকে? জেলেরাই–বা বাঁচবে কী করে? জীবিকার তাড়নায় জেলেরা সমুদ্রে গিয়েও হতাশ হয়ে ফিরে আসেন। অভাবের তাড়নায় একটি মা মাছ পেলে তাকেও খুন করে। চাটগাঁইয়া শিক্ষক কাহিনিকার আজাদ বুলবুলের পরিশ্রমী গবেষণায় উঠে এসেছে নদীজীবনের এমনই নানা দিক। নদী ও নারীর, নারী ও প্রকৃতির, প্রকৃতি ও মানুষের এই অবিচ্ছেদ্য বন্ধনের গতিধারাকে চলচ্চিত্রে রূপ দান করেছেন শক্তিশালী অভিনেতা ও মননশীল পরিচালক তৌকীর আহমেদ।
আমার শৈশব-কৈশোর কেটেছে চট্টগ্রামের জেলে পাড়ায়। এই জেলেরা সারা রাত কর্ণফুলীতে মাছ ধরতেন। ঠেলাভর্তি মাছ নিয়ে যখন পাড়ায় ফিরতেন, সেই দৃশ্য ছিল চোখে পড়ার মতো। জেলেপাড়ার অনেক বউ–ঝি বা আমার বয়সী ছোট ছোট ছেলেমেয়েদেরও দেখতাম, ঠেলা থেকে যে যেদিকে পারে মাছ নিয়ে ছুট লাগাচ্ছে। জেলেপাড়ার কয়েকজন বউ আর মেয়ে দুপুরে আমাদের দোতলার বাসায় এসেও মায়ের সঙ্গে সুখ-দুঃখের গল্প জুড়ে দিতেন। পাড়াতে ঠেলাভর্তি মাছ এলে ওরাই আমার মায়ের কাছে বাজারের চেয়ে কম দামে মাছ দিয়ে যেতেন। আবার সারা বছর অভাব–অনটনও জেলেজীবনের সঙ্গে জুড়ে থাকত। কোনো জেলে পরিবারের সন্তানকে রিকশা কিনে দিয়ে, কাউকে মেয়ের বিয়ের জন্য টাকা দিয়ে আমার বাবা সাহায্য করতেন। মূলত জেলেজীবনের সেই অভাব–অনটনই প্রতিপাদ্য হয়ে উঠেছে তৌকীরের চলচ্চিত্রে।
চলচ্চিত্রে যাঁরা অভিনয় করেছেন, তাঁরা সবাই চট্টগ্রামের মানুষ নন। চাটগাঁইয়া ভাষায় সংলাপ বললেও আঞ্চলিক টান অনেকেই ঠিকমতো ফুটিয়ে তুলতে পারেননি। অনেকের সংলাপ শুনে মনে হয়েছে, তিনি স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী স্পষ্ট, শুদ্ধ চাটগাঁইয়া উচ্চারণ করার চেষ্টা করছেন। আঞ্চলিক টান ঠিকমতো তুলে আনতে না পারলে এই শুদ্ধ উচ্চারণও বিশুদ্ধ হয় না। অনেকের কিছু কিছু সংলাপে চাটগাঁইয়ার সঙ্গে অন্য আঞ্চলিক ভাষার টান যুক্ত হয়েছে। তবে সব শিল্পীরাই অভিনয়ে নিজেদের জানান দিয়েছেন। তিশার মুখে চাটগাঁইয়া কিন্তু অসম্ভব সুন্দর, ভালো। তিশা এখানে গরিব জেলের কন্যা। তাঁর বাবা মনু মিয়ার চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেছেন ফজলুর রহমান বাবু।
মোশাররফ করিম এখানে ঘরছাড়া এক গরিব এতিম সন্তান বদি। তাঁর হতাশ জীবনে আলো হয়ে আসে হাসু। ক্রমেই সে হয়ে ওঠে স্বপ্নের কান্ডারি। ঘরে-বাইরে, বাপের বাড়ি-শ্বশুরবাড়িতে লড়াই করে চলা হাসুর জন্যও হয়ে ওঠে দমকা হাওয়া, উন্মুক্ত বাতাস। এতিম বদিকে মন দিয়ে বসেও হাসুকে অন্যের ঘরে বউ হয়ে যেতে হয়। বদি হাসুকে বলে, ‘স্বপ্ন ছাড়া মানুষ ন বাঁচে, হাসু কনদিন স্বপ্ন দেহা বন্ধ ন গৈরজ্জু।’ শ্বশুরবাড়ির জেলখানা থেকে মায়ের অসুখ হয়েছে মিথ্যা বলে, বদি হাসুকে নিয়ে আসে। নৌকায় হাসুকে তখন বলে, ‘ভালোবাসাত মিছা কইলে পাপ ন হয়…।’ এই প্রেমিক যুগলের বড় ইচ্ছে ছিল, স্বপ্নের একটা ঘর বানাবে। তেমন স্বপ্নের একটা ঘর দুজনে পালিয়ে গিয়ে বানিয়েছিল, কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি।
হাসুর বর নাদেরের চরিত্রে অভিনয় করেছেন জাহিদ হাসান। জাহিদকে আমরা হাসিখুশি অনেক চরিত্রে অভিনয় করতে দেখেছি। এখানে দেখলাম বদমেজাজি ভিলেন হিসেবে। ভালোই অভিনয় করেছেন। হালদা নদীকে যারা ধ্বংস করে চলেছে, তাদেরই এক প্রতিনিধি চরিত্র ইটভাটার মালিক এই নাদের। সরকারি দপ্তরের পরিবেশরক্ষা কর্মীকেও ঘুষ খাইয়ে, ভোজ খাইয়ে সে অনৈতিক ব্যবসা চালিয়ে যায়। তার বাড়িতে বড় মাছ আসে। সেই মাছ দেখে হাসু আর্তনাদ করে বলে উঠে, ‘আঁই মা মাছ কাডিত ন পাইরজ্জুম। ইভা হালদার মা মাছ। মা মাছ মারা মহাপাপ। মা মাছ ন থাকিলে আঁরা মাছ পাইয়ুম কন্ডে?’
হাসুর ব্যক্তিজীবনেও সেই মা হয়ে বেঁচে থাকার লড়াই উঠে আসে। নাদেরের প্রথম স্ত্রী জুঁই চরিত্রে অভিনয় করেছেন রুনা খান। জুঁইয়ের গর্ভে সন্তান আসে না। হাসুর গর্ভে সন্তান এলে নাদের নিজেও সন্দেহের চোখে দেখে। কারণ, বাপের বাড়ি থেকে বদির সঙ্গে গিয়ে, ফিরে আসার পরেই তার গর্ভে সন্তান এসেছে। নাদের গর্ভবতী বউকেও বেধড়ক পেটায়। জুঁই কাজের মেয়ের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে দুধের সঙ্গে বিষ খাইয়ে হাসুকে মেরে ফেলতে চায়। ধরা পড়ে তাকে স্বামীর ঘর ছাড়তে হয়। হাসুকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার অপরাধে বদিকে হত্যা করে নাদের। ইটভাটায় লাশ গুম হয়ে যায়। বদিকে হত্যার প্রতিশোধ নিতে হাসু সুন্দর করে সেজেগুজে এসে মদ্যপানরত কামমোহিত নাদেরকে পেছন থেকে ছুরি মেরে হত্যা করে।
একদিকে লাগাতার পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন থেকে নদীর মুক্তি, অন্যদিকে গৃহযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত হতে হতে নদীকন্যা এক নারীর মুক্তি। পরিচালক আমাদের এক নির্মম সত্যের সামনে এনে দাঁড় করান। একলা মায়ের লড়াই শুরু হয় এরপর। হাসুর হাতে বৈঠা, হাসুর নৌকা মুক্তির হাতছানির ডাক দিয়ে যায়। এই ছবির সেট নির্মাণ, শিল্প নির্দেশনা, ক্যামেরার ভাষা অনবদ্য। সবার অভিনয় চমৎকার। এ ধরনের ছবির এটাই বৈশিষ্ট্য, কেউ নায়ক হিসেবে বেশি জায়গা পান না, কেউ সাধারণ হিসেবে কম জায়গা পান না। শিল্পী হিসেবে সবারই নিজেকে ফুটিয়ে তোলার জায়গা রয়েছে। কিংবদন্তি দিলারা জামান এই বয়সে এসেও যেমন নজর কেড়ে যান। অন্যদের প্রেরণা হয়ে দাঁড়ান।
পিন্টু ঘোষ, সুকন্যা ঘোষ মজুমদারের গানগুলো বেশ ভালো লাগে। তবে মাঝিদের জীবনকেন্দ্রিক কিছু চিরাচরিত গান বা চাটগাঁইয়া গান ব্যবহারেরও সুযোগ ছিল। একটি গবেষণামূলক চলচ্চিত্রে তা অহেতুক হতো না। নদীকে রক্ষা করার এই দাবি হালদার মাধ্যমে পরিচালক ধ্বংস হতে বসা প্রতিটি নদীর জন্য বার্তা দিয়ে যান। নদী না বাঁচলে মানুষ বাঁচবে না। যেভাবে নারীর প্রেম ছাড়াও পৃথিবী বাঁচে না।
হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত