আলোর ম্যাজিক

জোনাকি পোকাপ্রতীকী ছবি

আলোর একধরনের ম্যাজিক আছে, মায়া তৈরির ম্যাজিক; অন্ধকার দেয়ালে জানালা দিয়ে ল্যাম্পপোস্টের আলোতে তৈরি বৃত্তগুলোর দিকে তাকিয়ে রোজ এ কথাই ভাবতাম। মনে হতো, অন্ধকার আলোরই একটা ছায়ামাত্র, এর বেশি কিছু নয়।

আলো নিয়ে এই পাগলামি শুরু ছোটবেলা থেকেই। মনে পড়ে প্রথম রংধনু দেখার উত্তেজনা। ‘বেনীআসহকলা’ বিষয়টা তখন জেনেছিলাম আব্বুর কাছ থেকে। সাতটা রং দেখতে পাচ্ছি না বলে তখন ভীষণ মন খারাপ হয়েছিল! আর সূর্যগ্রহণের দিন চশমা দিয়ে বাড়ির সবাই মিলে গ্রহণ দেখা। সে সময় এক আকাশ অন্ধকারের সন্ধ্যায় জোনাকিরা নেমে আসত। সংগ্রহে থাকা একটি পুরোনো কাচের বোতলে কয়েকটি জোনাকি পোকা বন্দী করে টেবিলে রেখে পড়ার মাঝেমধ্যে আলোর খেলা দেখতাম। কী ভালোই না ছিল দিনগুলো!

আজকাল সব রং কেমন যেন ফিকে লাগে। আলো কি কমে যাচ্ছে তবে? ডান চোখটা কেমন যেন ঝাপসা, অন্ধকার। বাঁ চোখটাও খুব যে পরিষ্কার, তেমনটা নয়। কাজ চালিয়ে নেওয়ার মতো। সময় বড় বদলায়। আগে অন্ধকারকে তেমন একটা গুরুত্ব দিইনি। আলোর মধ্যে থেকে আলোকে ধরার চেষ্টা করে গেছি। এখন আলোর বাইরে বেরিয়ে রোজ আরও একটু বেশি করে, আরও একটু আকুল হয়ে আলোর কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করতে করতে অন্ধকারকেও কীভাবে যেন অনুভব করে ফেলি, ছুঁয়ে ফেলি তাকে, না চাইতেও। হোক না অন্ধকার, অন্ধকারেও ছোঁয়া যায় সমবেত বেহালার সুর।

বাইরে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। অনুভব করে দেখলাম কৃত্রিম আলোবিহীন আজকের সন্ধ্যাটাও তেমনই এল। যদিও কিছুই নেই আগের মতো। আমার দুই ভাগনে মিলে উঠানে দৌড়াদৌড়ি, চিল্লাচিল্লি করল কিছুক্ষণ। মোবাইল গেমসে পটু ওদের হয়তো আলোর কোনো ম্যাজিক খেলা জানা নেই। তাই অল্পতেই খেলা সাঙ্গ হলো। উঠানেও নেমে এল না কোনো জোনাকি। আলো বিলানো পতঙ্গটাকে আজকাল দেখিও না তেমন। কোন নিবন্ধে যেন পড়েছিলাম, দূষণে বিলুপ্তির পথে জোনাকি। প্রতি বেলা শেষে এই শহরের বুকে সন্ধ্যা নামে। আকাশের ক্যানভাসজুড়ে রঙের তুলির ছোঁয়া লাগে। কিন্তু জোনাকিরা আসবে বলে শুধু ঘরে ফিরে আসে পাখিরা। নিয়ন আলো গল্প কথক এখনো গল্প বলে—ইলেকট্রিকের তারে চাঁদ কীভাবে আটকে যায় অন্তর্জালে। এই সময়, সেই সময় চিন্তা করে আমি পুরোনোতেই স্বস্তি পাই বারবার।

সব জানালা খুলে ঘুমিয়েছিলাম। চোখটা কখন যেন লেগে এসেছিল! হঠাৎ চারটি জোনাকি ঘরে ঢুকেছে। উড়ে বেড়াচ্ছে জানালার আশপাশে। সাহস করে আমার কাছাকাছিও এসেছে দু–একবার। অদ্ভুত তো, জোনাকিরা টিকে আছে এখনো? নাকি ভিন্ন বেশে পরি এল! কিছু বলতে চায় আমায়? বল রে। দুঃসংবাদ হলেও বল। মিথ্যার জৌলুশে বাস্তবতা না গোনা লোক আমি। এই সাজানো শহরে সফল জীবন কেবল পরিসংখ্যানের অঙ্কে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আলোর জটলায় আর এত মাপজোখের দুনিয়ায় অন্ধকারে বয়ে বেড়াবার মানুষ বোধ হয় কেবল আমিই একজন। ভাবতে ভাবতে নির্ঘুম রাত কেটে গেল। নীলাভ আলো আমার ছোট্ট বারান্দায় বিষণ্ন মায়া তৈরি করে। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। কোথাও কেউ নেই। অদ্ভুত নীরবতা!

চট্টগ্রাম