সরুদাসীকে মনে হয় স্বপ্নে কুড়িয়ে পাওয়া কোনো চরিত্র

বই আলোচনা: অনুর পাঠশালা

মাহমুদুল হক রচিত একটি মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস অনুর পাঠশালা। এটি প্রথমে প্রকাশিত হয়েছিল ‘যেখানে খঞ্জনা পাখি’ শিরোনামে। এই নামকরণের মধ্যে একটি কাব্যিক ব্যঞ্জনা আছে। সমগ্র উপন্যাস এই নামকরণের মতোই কাব্য-ভারাক্রান্ত।

উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র অনুর মা-বাবার মধ্যে খুব ভালো সম্পর্ক নেই। তাদের বিশাল দোতলা বাড়িতে নিঃসঙ্গ জীবন কাটায় অনু। রোদঝলসানো দুপুরে যখন একাকিত্ব অসহ্য হয়ে ওঠে, তখন একদা বীভৎস স্বপ্ন দেখতে শুরু করে সে। তারপরই মায়ের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে পাড়ার ভাগ্যাহত কিশোরদের সঙ্গে মিশতে শুরু করে। লেখকের ভাষায়, ‘পরদিন অনু দুপুরের উদ্দেশে নিজেকে অবাক করে নিরুদ্দেশ হলো।’

পাড়ার হাড়হাভাতে টোকাই ছেলেদের সঙ্গে যোগাযোগের সূত্রে অনুর কাছে উচ্চবিত্ত জীবনযাপনের অনেক ফাঁকফোকর উন্মোচিত হয়। নিচু শ্রেণির ছেলেদের অশ্লীল কথাবার্তার মধ্যেও সে সমাজের নিষ্ঠুর রগরগে একটা রূপ দেখতে পায়। স্কুলের বন্ধুদের সম্পর্কে এক জায়গায় তার ভাবনা এ রকম—‘শুধু ইস্তিরি করা দামি কাপড়ের মড়মড়ে ভাঁজ অতি কষ্টে বজায় রাখার জন্যই ওরা এই পৃথিবীতে এসেছে। অন্যকে ঠকানো বোকা বানানো কিংবা চমকে দেওয়াটাই ওদের আনন্দ লুটবার একমাত্র রাস্তা; বিকল্প কোনো রাস্তা ওদের কল্পনারও বাইরে। যখন যতটুকু খিদে থাকে স্বস্তি পায়, ঠিক ততটুকুতেই যারা তুষ্ট সে তাদের ভালোবাসে—কথাটা আজই এই প্রথম তার মনে উঁকি দেয় চকিতে।’

উপন্যাসে সরুদাসীর আবির্ভাব কিছুটা আকস্মিক হলেও তার প্রভাব খুব গুরুত্বপূর্ণ। সরুদাসীর সহজসুলভ প্রগলভতার মধ্যে অনু আনন্দ খুঁজে পায়। ঋষিপাড়ার সরুদাসী তাকে অনেক কিছুই শেখায়, যার অধিকাংশই যৌনতা-সম্পর্কিত। সরুদাসীর অনুপস্থিতি তার নিঃসঙ্গ দুপুরের মতোই অসহ্য মনে হয়। লেখক বলেছেন, ‘সরুদাসী এক নির্জন কষ্টের নাম।’

উপন্যাসে অনুর বাবার উপস্থিতি তুলনামূলক কম হলেও আধুনিক সভ্যতা সম্পর্কে তার একটা কথা আমার ব্যক্তিগতভাবে খুব ভালো লেগেছে—‘এই অতি অগ্রসরমাণ মানুষের কাছে সবকিছু এমন গতানুগতিক এমন সাদামাটা মনে হচ্ছে যে নতুনত্বের খাতিরে অভিনবত্বের প্রয়োজনে কোনো একটা কিছু না করা অবধি সে তার মনের মুক্তি খুঁজে পাচ্ছে না। নিত্যনতুন অপরাধের পেছনে স্বতন্ত্রভাবে মানুষের এই মোটিভ কমবেশি কাজ করছে। এর একটা কারণও আছে, সভ্যতার বিবর্তনের সাথে তাল রেখেই আমাদের ভেতরের সেই অতি পুরোনো পাথুরে বাটিটার আকারও অসম্ভব বেড়ে গিয়েছে। আজ সে আরও বেশি পেতে চায় নিজের মধ্যে, কেননা খোলের ভেতর ধরে রাখবার পরিসরও তার বেড়ে গিয়েছে। আসলে সবকিছুই অতি অগ্রসরমাণ সভ্যতার সেই ষোলোকলায় পূর্ণ বাটির যন্ত্রণা।’

উপন্যাসের সমাপ্তি একেবারে অনাকাঙ্ক্ষিত ও বিস্ময়কর। তখন সরুদাসীকে মনে হয় স্বপ্নে কুড়িয়ে পাওয়া কোনো চরিত্র। উপন্যাসে লেখক কাব্যিক উপমা ও রূপকের সাহায্যে যেসব বাক্যবন্ধ তৈরি করেছেন, তা আসলে অসাধারণ। এ জন্য সংক্ষিপ্ত এ উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের একটি অনন্য সৃষ্টি।

বন্ধু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা