এক বাবার শেষ পাঠ: বিশ্বাস, প্রেম আর মানুষ হয়ে বাঁচা

চিঠিপ্রতীকী ছবি

প্রিয় পুত্র,
এই চিঠি তোমার হাতে যদি পৌঁছায় তাহলে তুমি দুনিয়ার মানুষের ওপর কিছুটা বিশ্বাস রাখতে পারো। আমার সেলের পাহারাদার, যার হাতে এই চিঠিটা আমি দিয়ে যাচ্ছি, সেই আকমল ভাইয়ের মতো কিছু মানুষকে বিশ্বাস করতে পারো। বিশ্বাস করতে পারো জেল সুপারকেও। ওনার দয়া না হলে এই চিঠির একটা ছেঁড়া অংশও তোমার হাতে যেত না।

তুমি ঠিক কোন বয়সে এই চিঠি পড়ছ, তা আমি জানি না। বলপয়েন্টের কালি এবড়োখেবড়ো হয়ে চিঠিটাকে একেবারেই নষ্ট করে দেয়নি আশা করি। যদি না দিয়ে থাকে, তাহলে বলপয়েন্ট কলম, সাদা অফসেট পেপার, এদের বিশ্বাস করতে পারো।
বিশ্বাস শব্দটা তুমি উচ্চারণ করতে শিখেছ কি না জানি না। কিন্তু ওই যে ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘে ভয় পায়! তাই আমি চাই আমার মাড়ানো পথের ধুলাও যেন তোমার পায়ে না লাগে।

কোনো একটা বিদেশি উক্তি দেখেছিলাম এ রকম—‘সৌভাগ্যবানরা তাদের মৃত্যুর সময় আগে থেকে জেনে যায়।’ আমাকে সৌভাগ্যবান ধরে নিতে পারো। পরশু আমার ফাঁসি হবে। দেশের মানুষ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলবে, আমার লাশে থুতু ছেটাবে হয়তো। কিন্তু আমি জানি, কতখানি অপরাধ আমার ছিল। একটা শিশু জন্মের সময় যতটুকু কলঙ্ক নিয়ে জন্মায়, ঠিক ততটুকু কলঙ্কে আমাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হচ্ছে!

কিন্তু পুত্র, তুমি কোনো আক্রোশ রেখো না। যদিও আমি ভাগ্যে খুব বেশি বিশ্বাস করি না, তবু এ নিশ্চয়ই আমার কর্মফল। কোনো একটা পিঁপড়ের পরিবারকে হয়তো পায়ের তলায় পিষেছিলাম। একবার জোড়ার একটা কবুতর মেরে খেয়েছিলাম ছোটবেলায়, আরেকটা কবুতর দুচোখ ভরে আমাকে অভিশাপ দিয়েছিল।

তোমার মাকে দেখে রেখো। কবুতরের অভিশাপে মানুষ মারা যায়। মানুষের অভিশাপে মানুষের কিছু হয় না! মানুষকে কখনো শুধু নিজের স্বার্থে ব্যবহার কোরো না। কাউকে জীবনে এমন জায়গায় বসাবে না, যেখান থেকে সে সরে গেলে জীবন তাসের ঘরের মতো পড়ে যায়। দুচোখ ভরে দুনিয়া দেখে নিয়ো। এই দেশ, সমাজ, রাষ্ট্র কখন তোমার চোখের জ্যোতি কেড়ে নেবে বলা যায় না।

ভালোবাসতে দ্বিধা কোরো না, বিনিময়ে কিছু না পেলেও জানবে তুমি অনেক কিছু পেয়েছ। ভালোবাসতে পারাটাও বিরাট হিম্মতের বিষয়, কজন পারে? তোমার বাবাকে ভুল যেয়ো অতি সত্বর। অবশ্য আমি জানি তুমি আমাকে মনেই রাখবে না। সন্তান দুনিয়ার আলো দেখার আগে যে পিতা পালিয়ে যায়, সেই কাপুরুষকে মনে রাখার কোনো কারণ নেই। পারলে আমাকে ক্ষমা কোরো, তোমাকে জন্ম দেওয়ার পাপে আমি নিশ্চিন্তে এই চোখ বুজতে পারছি না। আমার ঈশ্বর আমাকে এই পাপের ক্ষমা দেননি, তুমি দেবে কি? তবে বিশ্বাস করো, তোমাকে এক আলোকিত পৃথিবী দেখানোর আশায় আমি আমার বুকপকেটে অজস্র জোনাকি জমিয়েছিলাম। কিন্তু আমার হাত বেঁধে সেই জোনাকিদের মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয়েছে। তাই তোমাকে নিজের পথ নিজেরই আলোকিত করতে হবে। আমি জানি, তুমি পারবে। হোঁচট খাবে, পা মচকাবে, রক্ত ঝরবে, কিন্তু তুমি পারবে। একসময় দেখবে তুমি সত্যি সত্যি আলোর অসীম ঔজ্জ্বল্যে দাঁড়িয়ে অথবা তোমার চোখ একসময় অন্ধকারে সয়ে গেছে। অন্ধকারেই স্পষ্ট মানুষ দেখতে পাচ্ছ।

স্বপ্ন দেখবে—ঘুমিয়ে, জেগে। স্বপ্ন মানুষকে বড় করে। পাহাড়চূড়ায় ওঠার স্বপ্ন দেখবে, তাহলে অন্তত টিলা টপকাতে পারবে। কিন্তু সেই পাহাড়ে ওঠার সরঞ্জাম সবগুলো তোমার ব্যাগে আছে কি না, তা একবার দেখে নিয়ো।

নিজেকে বদলানোর আগে সমাজ বা রাষ্ট্র বদলাতে যেয়ো না। আর এ–ও জেনে নিয়ো, সে বা তারা বদলাতে চায় কি না। মনে রাখবে, পরিবর্তন মানেই ভালো না!

তুমি যদি কারও পাশে থাকায় নিজের ক্ষতি না হয় তাহলে অবশ্যই খুঁটি গেড়ে বসে যেয়ো তার পাশে! দুনিয়াকে জটিল, কঠিন, নিষ্ঠুর মনে হলে হঠাৎ করে প্রেমে পড়ে যেয়ো, নিজের বাঁচার নতুন মানে খুঁজে পাবে। প্রেমের মতো পবিত্র, স্বর্গীয় অনুভূতিকে পায়ে ঠেলার কোনো মানে হয় না।

বেঁচে থেকো। একসময় বুঝবে এর চেয়ে বড় আশীর্বাদ আর হতে পারে না, আবার অভিশাপও। বাবা নিশ্চয়ই অভিশাপটা দিচ্ছে না। অবশ্য এমনি যে অভিশপ্ত জীবন তোমাকে উপঢৌকনের মোড়কে জড়িয়ে তুলে দিচ্ছে হাতে, তার চেয়ে বড় অভিশাপ আর কি কিছু হতে পারত?

মানুষ হয়ো। তোমার মৃত্যু যেন মানুষকে কাঁদায়। সত্যি সত্যি কাঁদায়। যেন বলতে পারে, ‘এই মানুষটা আর কয়েকটা দিন বেঁচে থাকলে কী এমন ক্ষতি হতো!’ কিন্তু মানুষ বাঁচে না, মরে যায়! কারণে, অকারণে মরে যায়। এক বুক দুঃখ, আক্ষেপ আর ভালোবাসার বোঝা নিয়ে গলার কাছের দিকটায় জমাট বাঁধিয়ে মারা যায়। তোমার বাবাও মারা গেল। আচ্ছা, সেদিন কি কেউ কেঁদেছিল? একটা ফোঁটা চোখের জলের ভাগ্য কি তোমার হতভাগ্য এই জন্মদাতার হয়েছিল?

ইতি,
তোমার অনন্ত দুঃখের সাগরের মাঝি

শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়