মাতৃসত্তার অস্তিত্বের লড়াই ‘দাগ’

‘দাগ’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যছবি: সংগৃহীত
মায়ের কোনো জাত হয় না মোকলেস। একজন নারী যখন সন্তান জন্ম দান করে, তখন সে নারীসত্তা থেকে মাতৃসত্তায় উত্তীর্ণ হয়। সে অন্য মানুষ হয়ে ওঠে।

শিল্পী এবং স্রষ্টার কাজ হলো চেনা জগৎ ও চেনা-অচেনা জীবনকে নতুন করে দেখানো। এমনভাবে দেখানো, যাতে সংবেদনশীল মনের অনুভূতিতে দাগ কেটে যায়। তরুণ প্রজন্মের পরিচালক সঞ্জয় সমাদ্দার চেনা জগতের অচেনা ছবিকে, ছবির ভেতরের মুহূর্ত, মুহূর্তের ভাঙা-গড়াকে সুন্দর তুলে আনতে পারেন। তিনি নিজে যেমন তাঁর ছবির বড় একটা খুঁটি, বিশিষ্ট অভিনেতা মোশাররফ করিম অন্য আরেকটি বড় খুঁটি। ভিত শক্ত বলেই ছবি সুন্দর দাঁড়ায়। শিকড় থেকেই বিচার–বিশ্লেষণে অনুভূতিতে নাড়া দিতে পারেন বলেই চলচ্চিত্রটি মনে দাগ কেটে যায়। এ কারণে ‘দাগ’ চলচ্চিত্রের নামকরণটিও সার্থক।

পৃথিবীর প্রত্যেক মানুষের অনুভূতির একটা বড় জায়গা মা। মা গর্ভে ধারণ করেন বলেই আমরা মানুষ হয়ে জন্ম নিই। ছোটবেলায় বাংলাদেশ শিক্ষা বোর্ডের প্রাথমিকের পাঠ্যবইতে কাজী কাদের নেওয়াজের কবিতা পড়তাম, ‘মা কথাটি ছোট্ট অতি কিন্তু যেন ভাই/ ইহার চেয়ে নাম যে মধুর ত্রি-ভুবনে নাই।’ ‘দাগ’ চলচ্চিত্রে আলমগীর নামের পুলিশ অফিসার, মানে মোশাররফ করিম তাঁর সহকারী পুলিশ কর্মীকে বলেন, ‘মায়ের কোনো জাত হয় না মোকলেস। একজন নারী যখন সন্তান জন্ম দান করে, তখন সে নারীসত্তা থেকে মাতৃসত্তায় উত্তীর্ণ হয়। সে অন্য মানুষ হয়ে ওঠে। এসব জাতপাতের ভেদাভেদ আর তার মধ্যে থাকে না।’

মা এমন একটি সত্তা, যিনি সব ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে উঠে ধরিত্রীমাতা, ভূমাতা গোটা একটা পৃথিবী হয়ে ওঠেন। তেমন একজন মায়ের গর্ভে জন্ম নেওয়া সদ্যোজাত শিশুর পুলিশ অফিসার আলমগীর নাম রাখেন ‘স্বচ্ছ’। পৃথিবীর জীবন নাট্যর রঙ্গশালায় আবর্জনার মধ্যে পড়েছিল নিষ্পাপ, নিষ্কলঙ্ক এই শিশু। হিন্দু ঘরে জন্ম নিলে সেই পরিচয় থেকে একটা হিন্দু পদবি পেত। মুসলিম ঘরে জন্ম নিলে একটা মুসলিম নাম হতো। কিন্তু স্বচ্ছর পরিচয় সে শুধু স্বচ্ছ। স্বচ্ছ কোনো ধর্মীয় অনুভূতি যুক্ত নাম নয়। জাতি-ভেদাভেদগত কোনো পদবিও তার নেই। জন্মপরিচয়ও সে হারিয়ে ফেলেছে। ডাস্টবিনে বা উন্মুক্ত অঞ্চলে শিশু খুঁজে পাওয়ার ঘটনা নতুন কিছু নয়। কেন কেউ এভাবে জন্ম দেওয়া শিশুকে ফেলে রেখে চলে যায়, তার কারণও আমরা জানি। আমাদের চেনা-জানার সঙ্গে মোহাম্মদ আবু রাজীনের মূল গল্প ভাবনাও আলাদা কিছু নয়। কল্লোল কবিরের সুন্দর চিত্রনাট্য এবং সঞ্জয়ের যোগ্য পরিচালনায় ব্যাঞ্জনা সৃষ্টি করে ঘটনার বিস্তারে। এখানেই চেনা জগৎ আলাদা হয়ে যায়।

রাতে কাজের সময় আলমগীর ও সহকারী মোকলেস ডাস্টবিনে ফেলে যাওয়া এই শিশুর সন্ধান পায়। আবালের দুই সদস্য বাচ্চাটাকে প্রথম দেখে। ‘আবাল’ হলো আধুনিক বাংলাদেশের লোক নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। তারাই পুলিশকে খবর দেয়। আলমগীর এসে কোলে তুলে নিয়ে গিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করায়। একটু সুস্থ হয়ে ওঠার পর শিশুর ঘটনা নিয়ে যখন চারদিকে তোলপাড়, হাসপাতালের মধ্যেই ২০ মহিলা এগিয়ে এসে স্বেচ্ছায় স্বচ্ছকে দুধ খাওয়াতে চান। এখানেও একটা মস্ত বিড়ম্বনা। আলমগীর ছুটে এসে সমাধান টানেন। মোকলেসকে বলেন, ‘দুনিয়া এক আজব চিড়িয়াখানা মোকলেস। আসল মা-বাবা ডাস্টবিনে ফালাইয়া যায়, আর ২০ জন মা আগাইয়া আসে দুধ খাওয়ানোর জন্য।’

‘দাগ’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য
ছবি: সংগৃহীত

আলমগীরের সমাধানে দুজনকে দুধ খাওয়ানোর ভার দেওয়া হয়। নাম শুনে বোঝা যায়, ওদের একজন হিন্দু মা, অন্যজন মুসলমান। দুজনেরই বাচ্চা জন্মের পর মারা গিয়েছিল। সন্তানকে বুকে টেনে নিতে পারেনি। তাই ঈশ্বর যেন স্বচ্ছকে তাদের কাছে পাঠিয়েছেন। নার্স মালতী দিদির রুটিন অনুযায়ী পালা করে এই দুজনের মাতৃসত্তা পূর্ণতা লাভ করে। মায়ের দুধের বিষয়ে হিন্দু-মুসলমান কোনো পার্থক্য হয় না। পরিচালক সেই বিষয়ও সুন্দর বুঝিয়ে দিয়েছেন।

অজ্ঞাতপরিচয় শিশু, দেশের প্রশাসন আইন-আদালতের কাঁধে নিয়মমাফিক দায়িত্ব বর্তায় নবজাতকের মাথার ওপর আশ্রয় খুঁজে দেওয়ার। আর সঠিক বাবা-মা খোঁজার যাচাই–বাছাইয়ের পূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয় আলমগীরকে। এখান থেকে ঘটনার পরতে পরতে ওঠে আসে সন্তানহীন দম্পতিদের যন্ত্রণার ছবি। ভাইরাল হয়ে যাওয়া একটি সন্তানকে নিয়ে সমাজের মনমানসিকতার ছবি। আলমগীরের নিজের জীবনের অতীত ইতিহাস, বুকের ভেতরে দুমড়ানো–মোচড়ানো যন্ত্রণাও এর সঙ্গে এসে যুক্ত হয়। যদিও পেশাগত দায়িত্ব মর্যাদার সঙ্গে পালন করতে গিয়ে এমন হয়ে উঠেছে যে নিজের ভেতরের ভাঙন অন্য কাউকে বিন্দুমাত্র বুঝতে দেয় না।

কাহিনিজুড়ে মাঝেমধ্যে হাসপাতালে এসে এক যুবতী উঁকি দিয়ে গেছে। অনবরত হাসপাতালে এসে বাচ্চার পাশে ঘুরে বেরিয়েছে। দূর থেকে মায়াভরা দৃষ্টিতে বাচ্চাকে দেখেছে। কাছে গিয়ে বাচ্চাকে কোলে নিতে চেয়েছে, কিন্তু পারেনি। শেষ পর্যন্ত ঘটনা খোলসা হয়, এই যুবতীই শিশুটির প্রকৃত মা। এক যুবকের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে সুশিক্ষিত এই নারীর গর্ভে সন্তান আসে। যুবক প্রতারণা করে পালিয়ে যায়। সন্তানকে নষ্ট করতে পারেনি। ১০ মাস ১০ দিন পেটে ধরে জন্ম দিয়েছে। এরপরই লোকলজ্জা ভয়ে যুবতীর পিতা ভূমিষ্ট শিশুকে ডাস্টবিনে রেখে আসে।

গোটা ঘটনা জানার পর আলমগীর আপ্রাণ চেষ্টা করে প্রকৃত মায়ের পাশে দাঁড়াতে। আইন–কানুন, আদালত সবকিছুকে আলমগীর সামলে নিতে পারত। যুবতীও পারত গর্ভজাত সন্তানকে নিয়ে একা মায়ের লড়াই শুরু করতে। কিন্তু সমাজ কী বলবে? শুধু এই সংশয়ের কাছে মাকে হেরে যেতে হলো। কোর্টের রায়ে সন্তানের ভার পান এক চিকিৎসক।

চোখের সামনে নিজের সন্তানকে চলে যেতে দেখে প্রকৃত মায়ের আর্তনাদ এই ছবির মূল দাগ হয়ে ওঠে। ভেতরে-বাইরে তুমুল ঝড় চলছে। বাইরের ঝড়ের দৃশ্য এবং ভেতরের ভাঙন দুটিই পরিচালক তুলে ধরেন। সন্তানকে গর্ভে ধারণ করা নারী তীব্র যন্ত্রণায় কেঁদে ভাসায় আর আলমগীর সন্তানকে আশ্রয় খুঁজে দেওয়ার পর একটা যুদ্ধ শেষ করে নিজের হারানো সন্তানের কবরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তার ভেতরের ক্ষতবিক্ষত যুদ্ধে কাকভেজা, বৃষ্টিস্নাত হারানোর সন্তানের জন্য ঈশ্বরের কাছে মোনাজাত দোয়া প্রার্থনা করে। এর বাইরে তারও যে আর কিছু করার নেই।

মোশাররফ করিম ছাড়াও এই ছবির কলাকুশলী ও শিল্পীরা হলেন সাবেরি আলম, আইশা খান, আনিসুল হক বরুণ, নিশাত প্রিয়মসহ অনেকে। চিত্রগ্রাহক ছিলেন রাজু রাজ। সম্পাদনা ও রং সংমিশ্রণ সিমিত রায় অন্তরের। আবহ সংগীত করেছেন জাহিদ নিরব। অডিও ফলি মিক্স মাস্টারিং শৈব তালুকদারের। নির্বাহী প্রযোজক ছিলেন শিবির আহমেদ শাওন এবং প্রযোজক রেদওয়ান রনি।

হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত