হাতঘড়ি

ছবি: এআই/বন্ধুসভা
বৃদ্ধ শিক্ষক কিছুটা কৌতূহল নিয়ে যুবকের শিক্ষক হওয়ার নেপথ্যের কারণ জানতে চাইলে, সে ছোটবেলায় তার স্কুলে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার কথা তুলে ধরে—

স্যার, আমাকে চিনতে পেরেছেন?
না বাবা, চিনতে পারিনি। তুমি কে?
আমি একসময় আপনার ছাত্র ছিলাম।
ও আচ্ছা! এখন তুমি কী করছ?
আমি একজন শিক্ষক।

প্রাক্তন ছাত্রের মুখ থেকে এই কথা শুনে বৃদ্ধ শিক্ষক অত্যন্ত খুশি হয়ে বললেন, ‘বাহ্! খুব ভালো! খুব ভালো! আমার পেশা বেছে নিয়েছ তাহলে!’
যুবক মৃদু হেসে বলল, ‘আপনার মতো একজন শিক্ষক হতে পেরেছি বলে নিজেকে ধন্য মনে করছি। আপনি আমাকে আপনার মতো হতে ভীষণ অনুপ্রাণিত করেছেন স্যার!’

বৃদ্ধ শিক্ষক কিছুটা কৌতূহল নিয়ে যুবকের শিক্ষক হওয়ার নেপথ্যের কারণ জানতে চাইলে, সে ছোটবেলায় তার স্কুলে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার কথা তুলে ধরে—

মনে আছে স্যার, একদিন আমার এক সহপাঠী বন্ধু একটি নতুন হাতঘড়ি নিয়ে ক্লাসে এসেছিল। তার ঘড়িটি এতটাই সুন্দর ছিল যে কোনোভাবেই লোভ সামলাতে পারিনি। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, যেভাবেই হোক ঘড়িটি আমার চাই। সুযোগমতো তার পকেট থেকে ঘড়িটি চুরি করি। কিছুক্ষণ পর আমার সেই বন্ধু তার ঘড়ির অনুপস্থিতি লক্ষ করে এবং তখনই আপনার কাছে অভিযোগ করে। তার এই অভিযোগ শুনে আপনি ক্লাসের সবার উদ্দেশে বলেছিলেন, আজ ক্লাস চলাকালে এই ছাত্রের ঘড়িটি চুরি হয়েছে। যে–ই চুরি করে থাকো, ঘড়িটি ফিরিয়ে দাও।

আপনার নির্দেশ শুনেও ঘড়িটি ফেরত দিতে পারিনি। কারণ, ঘড়িটি ছিল আমার কাছে খুবই আকর্ষণীয়। তা ছাড়া আমরা খুবই গরিব ছিলাম, এমন ঘড়ি কেনার সামর্থ্যও আমাদের ছিল না।

যাহোক, সেদিন আপনি দরজা বন্ধ করে সবাইকে বেঞ্চ ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ক্লাসরুমের ফ্লোরের মধ্যে একটি গোলাকার বৃত্ত তৈরি করতে বললেন এবং সবাইকে চোখ বন্ধ করার নির্দেশ দিলেন। অতঃপর ঘড়ি উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত আপনি পর্যায়ক্রমে সবার পকেট ও ব্যাগ খুঁজতে লাগলেন। সবাই আপনার নির্দেশনা মোতাবেক নীরবে দাঁড়িয়ে রইলাম।

একেক করে পকেট ও ব্যাগ চেক করতে করতে একটা সময় আপনি যখন আমার ব্যাগে হাত দিয়ে ঘড়িটি খুঁজে পেলেন, তখন ভয়ে ও লজ্জায় আমার শরীর কাঁপছিল। কিন্তু সেই মুহূর্তে ঘড়িটি আমার কাছ থেকে উদ্ধার হওয়ার পরও আপনি কিছু বলেননি এবং শেষ পর্যন্ত সব ছাত্রকেই চেক করেছিলেন। শেষে আপনি আমাদের উদ্দেশে বললেন, ‘ঘড়ি পাওয়া গেছে, এবার তোমরা সবাই চোখ খুলতে পারো।’

ঘড়িটি পাওয়ার পর সেই বন্ধু আপনার কাছে জানতে চেয়েছিল, ঘড়িটি কার কাছে পাওয়া গিয়েছিল? আপনি তাকে বলেছিলেন, ঘড়িটি কার কাছে পাওয়া গেছে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। তোমার ঘড়ি যে পাওয়া গেছে, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।

সেই দিনের ঘটনা নিয়ে পরবর্তী সময় আপনি আমার সঙ্গে আর কোনো কথা বলেননি। এমনকি সেই গর্হিত কাজের জন্য আমাকে তিরস্কার পর্যন্ত করেননি। নৈতিক শিক্ষা দেওয়ার জন্য আপনি আমাকে স্কুলের কোনো কামরায়ও নিয়ে যাননি। ঘটনাটি ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায়, অথচ আপনি অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে চুরি হওয়া ঘড়িটি উদ্ধার করলেন এবং সবার সামনে আমার সম্মান রক্ষা করলেন।

সেই ঘটনার পর বহুদিন অনুশোচনায় ভুগেছি। ক্লাসে ঘটে যাওয়া সেই ঘটনা ওই দিনই শেষ হয়ে গেলেও এর রেশ রয়ে যায় মনের মধ্যে। বিবেকের সঙ্গে যুদ্ধে বার বার দংশিত হয়েছি। নীরবে অনুশোচনার আগুনে পুড়েছি। তারপর সিদ্ধান্ত নিলাম, এসব অনৈতিক কাজ জীবনে আর কখনো করব না। একজন ভালো মানুষ হব, একজন শিক্ষক হব। সত্যিকার অর্থে মানুষ গড়ার কারিগর হব। আপনার কাছ থেকে সেদিন স্পষ্ট বার্তা পেয়েছিলাম, একজন শিক্ষকের কেমন হওয়া উচিত। অপমান ছাড়া মানুষকে সংশোধন করা যায়, সেটি আপনার কাছ থেকেই শিখেছি। আপনার উদারতা ও মহানুভবতা আজ আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে স্যার।

প্রাক্তন ছাত্রের কথাগুলো শুনতে শুনতে বৃদ্ধ শিক্ষকের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল! চোখের জল মুছতে মুছতে মৃদু হেসে বললেন, ‘ঘটনাটি আমার দিব্যি মনে আছে। কিন্তু তোমাকে মনে রাখিনি। কারণ, সে সময় শুধু তোমাদের নয়, আমার চোখও বন্ধ ছিল।’

তারপর শিক্ষক দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বললেন, ‘তুমিই বলো বাবা, কোনো শিক্ষক কি সন্তানতুল্য ছাত্রদের চোরের বেশে দেখতে পারে? আমি চাই, আমার ছাত্রদের বীরের বেশে দেখে গর্ব করতে।’