এসব কি তাহলে মিথ্যা গল্প ছিল! হলুদ রঙের মাকড়সা উঠল তার গায়ে, আর সেই রঙের জামা পেল বোন। কিন্তু সেখানে আরেক চমক ঘটল।
পিকলু বসে আছে পড়ার টেবিলে। পেনসিল নিয়ে এদিক–সেদিক ঘোরাচ্ছে। কখনো আবার কাটারের মধ্যে ফেলে মাথাটা আরও সূক্ষ্ণ করছে। ড্রয়িংয়ে মন বসছে না আজ। সকালে মায়ের হাতে পিটুনি খেয়েছে। একজগ পানি ফেলে ঘরের মেঝে ভিজিয়েছিল। দোষ ঠিক তারও না। দোষ তার বোনের। বোন দৌড়ানি না দিলে পিকলু হোঁচট খেয়ে পড়ত না। না পড়লে এমন কিছুই ঘটত না। কিন্তু যা হওয়ার হয়ে গেছে। মায়ের পিটুনি তার ওপরই পড়েছে। এ নিয়ে সে ভাবছে না। সে ভাবছে অন্য কিছু নিয়ে।
একটু আগেই পিকলু টেবিলের এককোনায় একটা মাকড়সা দেখল। তিরতির করে সেটা হেঁটে বেড়াচ্ছে টেবিলে। একেবারে হলুদ রঙের মাকড়সা। বেশ সুন্দর, চিকচিক করছে। তার বোন হলে এতক্ষণে চিৎকার করে বাড়িসুদ্ধ সবাইকে চমকে দিত। তেলাপোকার মতো মাকড়সাকেও সে ভয় পায়। কিন্তু পিকলু ভয় পায় না। সে তার হাতটা মাকড়সার দিকে বাড়িয়ে দিল। যদি এটা হাতে উঠে যায়, তার একটা নতুন জামা হবে। হলুদ রঙের। যদিও রংটা তার খুব একটা পছন্দ নয়। তার পছন্দ টকটকে লাল। তবু তো নতুন।
গত ডিসেম্বরে যখন স্কুলের ছুটিতে দাদাবাড়িতে গিয়েছিল, তখন সে শুনে এসেছিল এই ঘটনা। শরীরে মাকড়সা উঠলে সেই মাকড়সার রঙে নতুন কাপড় হয়। সমবয়সী এক বন্ধু সেই গল্প শুনিয়েছিল। সঙ্গে যারা ছিল, তারাও বলেছিল যে এমন হয়। কেউ কখনো না দেখে থাকলেও সবাই সত্যি বলেই জানে। এমনিতে শরীরে মাকড়সা ওঠে না। উঠলে সৌভাগ্যবান বলতেই হবে। পিকলুর রঙিন হলুদ জামার ভাবনায় ছেদ ঘটাল বোন এসে—
‘এই পিকলু চল খেলতে যাই।’
‘তুই যা আমি যাব না।’
‘চল না, পাশের বাসার নতুন ছেলেটাও এসেছে।’
‘না, আমি যাব না। তুই একাই যা।’
‘গেলাম আমি, পরে এলে কিন্তু খেলায় নেব না। মনে রাখিস।’
বোন মুখে বিরক্তি নিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। কিন্তু মাকড়সা! সেটা কোথায় গেল? হারিয়ে ফেলল পিকলু। সে টেবিলের চারপাশ ভালো করে খুঁজতে শুরু করল। বই–খাতা উল্টেপাল্টে হযবরল অবস্থা করে ফেলেছে এর মধ্যেই। কিন্তু মাকড়সাটাকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না। একটু পর আবার তার বোন এবং পাশের বাসার নতুন ছেলেটা এসে হাজির। দুজন মিলে খেলাও শুরু করতে পারছে না। আজকের খেলায় পিকলুকেও লাগবে। কিন্তু ঘরে ঢুকে তারা দেখে, পিকলু ঘরের বারোটা বাজিয়ে রেখেছে। কী যেন খুঁজছে! পিকলু শর্ত দিল, তারা যদি খুঁজে বের করে দিতে পারে, তাহলে সে খেলতে যাবে। কিন্তু বোন রাজি নয়। সে এই ভয়ংকর প্রাণী খুঁজতে সাহায্য করতে পারবে না। পিকলু এটা না পেলে যে খেলায় যাবে না, সেটাও জানে ভালো করে। তা ছাড়া সে তো আর ধরছে না; দূর থেকে সন্ধান দিলেই হবে। বাধ্য হয়ে তিনজন মিলে খুঁজতে শুরু করল হলুদ মাকড়সা।
অনেক খোঁজাখুঁজির পরও কোথাও মাকড়সার হদিস মিলল না। একরকম আশা ছেড়ে দিল সবাই। বোন মনে মনে খুশিই হলো, এই ভয়ংকর প্রাণীর সম্মুখীন হতে হয়নি। গায়ে কেমন খসখসে চামড়া। দেখলেই ভয় করে। তেলাপোকা তো আরও ভয়ংকর। কথা নেই বার্তা নেই, গায়ের ওপর উঠে বসে। কেমন বিচ্ছিরি দানবীয় পা। মনে হতেই তার শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যায়। কথায় আছে, যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়। সে পিকলুর কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘চল এবার খেলতে যাই’। তখনই ঘটল ঘটনাটা। দেখল একটা হলুদ রঙের মাকড়সা তার হাতের দিকেই ছুটে আসছে। হাতটা একঝটকায় সরিয়ে চিৎকার দিতে যাবে, তখন পিকলু কোনোমতে তাকে আটকায়। ভয়ের চোটে কিছুটা তোতলিয়ে বলে, ‘এএএএএএটা এখানে’। পিকলু ও ছেলেটা দুজনই তখন দেখে যে মাকড়সাটা পিকলুর ঘাড়ের ওপর হাঁটছে।
মাকড়সাটাকে পেয়ে পিকলু বেশ খুশি হয় এবার। তাও আবার তার শরীরে। এটাই তো সে চাচ্ছিল। মাকড়সাটা গায়ের ওপর উঠলেই তো হবে নতুন কাপড়। সে খুশিমনেই খেলতে যায়। মাকড়সাটাও গায়ের ওপরই ঘুরে বেড়ায়। খেলার সময় কখন গা থেকে পড়ে যায়, সেটা আর কেউ লক্ষ করে না। সেটা দেখার বিষয়ও নয়। খেলা শেষ করে বাসায় এসে শুধু নতুন কাপড়ের অপেক্ষা। কখন তার সেই মাকড়সার রঙের একটা জামা আসবে। সত্যি হলে এই ঘটনা সে–ও সবাইকে বলতে পারবে। কিন্তু দিন যায়। সেই হলুদ জামা তো আর আসে না।
তখন ভালোই শীত পড়েছে। কয়েক দিন পর বাবা তাদের দুই ভাই–বোনের জন্যই নতুন কাপড় আনেন। তার জন্য একটা টকটকে লাল জ্যাকেট আর বোনের জন্য হলুদ। সে কিছুটা নিরাশই হলো। এসব কি তাহলে মিথ্যা গল্প ছিল! হলুদ রঙের মাকড়সা উঠল তার গায়ে, আর সেই রঙের জামা পেল বোন। কিন্তু সেখানে আরেক চমক ঘটল। পিকলু বয়সে ছোট হলেও তার বোনের চেয়ে সে একটু বেশি লম্বা। আর হলুদ জ্যাকেটটা তার বোনের গায়ে ঠিকঠাক হচ্ছিল না। বড় হচ্ছিল একটু। অন্যদিকে লালটা তার গায়ে ঠিকমতো লেগেছে। ফলে দুজনের মধ্যে অদলবদল করে দিল মা। পিকলুর ভাগে এল হলুদ জ্যাকেট। ছয় বছরের পিকলু তখন মনে মনে সেই মাকড়সার ঘটনাই সত্যি বলে মনে করল। মাকড়সার জন্যই সে হলুদ জামাটা পেয়েছিল সেবার!
নেত্রকোনা