সুলতানা রাজিয়া: ত্রিভুজ প্রেমের এক করুণ উপাখ্যান

শিল্পীর চোখে সুলতানা রাজিয়াছবি: তারাঙ্গাবার্তা ডটকম

সুলতানা রাজিয়া, ইতিহাসে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টিকারী একটি নাম। ভারতবর্ষের ইতিহাসে দিল্লির সিংহাসনে বসা প্রথম এবং একমাত্র নারী। তিনি সুলতান ইলতুৎমিশের কন্যা ও ভারতবর্ষের প্রথম নারী শাসক। রাজিয়া সুলতানার পর নারী হিসেবে একেবারে ইন্দিরা গান্ধীই দিল্লির প্রথম সর্বেসর্বা হন। তবু সেটা ৭০০ বছরের অধিক সময়ের ব্যবধানের পর। একজন যোগ্য সুলতান ও যুদ্ধক্ষেত্রে একজন দক্ষ সৈনিক হিসেবে ছিল তাঁর সুখ্যাতি। তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে পরিচালনা করেছেন রাজকার্য।

সুলতান ইলতুৎমিশ থেকে সুলতানা রাজিয়া
১২১১ সালে আরম শাহকে পরাজিত করে সিংহাসনে আরোহণ করেন ইলতুৎমিশ। তাঁর পূর্বপুরুষেরা ছিলেন তুর্কি সেলজুক ক্রীতদাস এবং তাঁদের বংশকে স্লেভ রাজবংশ বলা হতো। ইলতুৎমিশের ভাগ্যের উত্থানে স্লেভ রাজবংশের অন্যতম প্রধান শাসক হিসেবে তাঁর রাজত্ব সামাজিক শ্রেণির ভিত্তিটিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল এবং শক্তিকাঠামোর ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল।

১২১১ থেকে ১২৩৬ সাল পর্যন্ত তিনি দিল্লি শাসন করেছিলেন। এ সময় তাঁকে বেশ কিছু বিদ্রোহের মুখে পড়তে হয়েছিল, তিনি দক্ষতার সঙ্গে সেসব প্রতিহত করেন। এমনকি কুখ্যাত মোঙ্গল বাহিনীর সঙ্গেও কয়েকবার লড়াই করতে হয়েছিল।

২৫ বছরের দীর্ঘ ও সফল শাসনের পর ইলতুৎমিশ ১২৩৬ সালে মারা যান। তাঁর মৃত্যুর ফলে দিল্লির সুলতানিতে কয়েক বছরের রাজনৈতিক অশান্তি ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর যোগ্য উত্তরাধিকারী কেউ ছিল না। কারণ, সবচেয়ে বড় ছেলে নাসির-উদ-দ্বীন মাহমুদ ১২২২ সালে বাংলায় শাসনকালে মারা গিয়েছিল। মারা যাওয়ার সময় সুলতান তাঁর বেঁচে থাকা কোনো পুত্রকেই যোগ্য শাসক হিসেবে বিবেচনা করেননি।

চার সন্তানের মধ্যে একমাত্র মেয়ে রাজিয়া সুলতানা ছিল ইলতুৎমিশের অত্যন্ত প্রিয়। ছোটবেলা থেকেই রাজিয়া সুলতানা ভবিষ্যতের সুবিবেচক সম্রাজ্ঞীর পরিচয় দিতে থাকেন। রাজিয়া তাঁর বাবাকে রাষ্ট্রীয় কাজ পরিচালনায় সরাসরি সহযোগিতা করতেন। তাঁর মেধা, প্রজ্ঞা ও রাষ্ট্রীয় কাজে দক্ষতা দিয়ে বাবা ইলতুৎমিশের প্রিয় হয়ে ওঠেন। মৃত্যুর আগে সুলতান তাঁর মেয়ে রাজিয়াকে উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করে পুনরায় ইতিহাস সৃষ্টি করে যান।

মেয়ে হয়ে দিল্লির মসনদে বসার পথটা কতটা মসৃণ ছিল
সুলতান ইলতুৎমিশের মৃত্যুকালে তিনি মেয়ে রাজিয়া সুলতানাকে নিজ উত্তরসূরি ঘোষণা করে গেলেও তুর্কি সভাসদেরা একজন নারীকে দিল্লির সুলতান হিসেবে মেনে নিতে রাজি ছিলেন না। অনেক তুর্কি অভিজাতদের মধ্যে ঈর্ষা ছড়িয়ে গিয়েছিল যে একজন মহিলা সুলতান পুরুষ যোদ্ধা এবং সম্ভ্রান্ত লোকদের কাছে অপমান। তাই তাঁরা রাজিয়াকে বাদ দিয়ে রাজিয়ার সৎভাই রুকনুদ্দিন ফিরোজকে সিংহাসনে বসান। কিন্তু শাসক হিসেবে ফিরোজ ছিলেন অত্যন্ত অযোগ্য, শাসনকার্য পরিচালনা করার বদলে তিনি বরং বিলাসিতায় দিন কাটানো শুধু করেন। পর্দার আড়াল থেকে দিল্লির রাজকার্যের আসল কলকাঠি নাড়ছিলেন তাঁর মা শাহ তুরকান। ফলে যে সভাসদেরা আগে ফিরোজকে সিংহাসনে বসিয়ে ছিল তাঁরাই এবার ফিরোজের অদক্ষতায় বিরক্ত হয়ে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং তাঁকে ও তাঁর মাকে হত্যা করেন। ফিরোজকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর আর কোনো উপায় না দেখে এবার সভাসদেরা অনিচ্ছা সত্ত্বেও সুলতান ইলতুৎমিশের ইচ্ছা রাখেন এবং রাজিয়াকে দিল্লির শাসনকর্তা ঘোষণা করে।

দিল্লির সুলতান হিসেবে রাজিয়া সুলতানা অনুমিতভাবেই দক্ষতার পরিচয় দিতে থাকেন। তিনি ছিলেন প্রজাদরদি। প্রজাদের থেকে দূরে না থেকে বরং তাদের সঙ্গে মিশতেন এবং নিজ রাজ্যের হিন্দু প্রজাদের সংস্কৃতি এবং জীবনাচরণ রক্ষা করতে সচেতন ছিলেন। তিনি একজন সমরবিশারদ হিসেবেও দক্ষতার পরিচয় দেন।

ত্রিভুজ প্রেমের গল্প ও চূড়ান্ত পরিণতি
দিল্লির সুলতান হিসেবে রাজিয়ার চার বছরের শাসনকাল শুরু হয়। তিনি ছিলেন একই সঙ্গে ইসলামের ইতিহাসের প্রথম সুলতানা এবং দিল্লির মসনদে বসা প্রথম নারী শাসক। এখান থেকেই শুরু হয় ত্রিভুজ প্রেমের উপাখ্যান। একদিকে কথিত প্রেমিক জামাল উদ্দিন ইয়াকুত এবং অন্যদিকে প্রতিশোধপরায়ণ মালিক আলতুনিয়া। বলা হয়ে থাকে, দুই পটের প্রেম, বিরহ ও বিচ্ছেদের প্রতিশোধই সুলতানা রাজিয়ার ক্ষমতাচ্যুত ও মৃত্যুর কারণ। সেই সঙ্গে রাজপরিবার ও সভাসদেরা কূটবুদ্ধির লীলাক্ষেত্র যেন রগরগে তুর্কি সিরিয়ালকেও হার মানিয়ে দেয়।

দিল্লির সুলতান হিসেবে রাজিয়া সুলতানা অনুমিতভাবেই দক্ষতার পরিচয় দিতে থাকেন। তিনি ছিলেন প্রজাদরদি। প্রজাদের থেকে দূরে না থেকে বরং তাদের সঙ্গে মিশতেন এবং নিজ রাজ্যের হিন্দু প্রজাদের সংস্কৃতি এবং জীবনাচরণ রক্ষা করতে সচেতন ছিলেন। তিনি একজন সমরবিশারদ হিসেবেও দক্ষতার পরিচয় দেন। বেশ কটি স্কুল, একাডেমি, গবেষণা কেন্দ্র এবং পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। স্কুল-কলেজের সিলেবাসে কোরআন, জনপ্রিয় প্রাচীন দার্শনিকদের রচনা, রীতিনীতি এবং বিজ্ঞান, দর্শন, জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং সাহিত্যের বিভিন্ন হিন্দু রচনা অন্তর্ভুক্ত ছিল।

চারদিকে প্রসারিত হতে থাকে সুলতানা রাজিয়ার দূরদর্শী শাসনকার্য। যত বিস্তৃত হয়েছে তাঁর শাসনকার্যের প্রজ্ঞা, ততই বেড়েছে চারপাশের ষড়যন্ত্রের অশনিসংকেত।
কিন্তু তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল জামাল উদ্দিন ইয়াকুত নামের একজন অতুর্কি কৃষ্ণাঙ্গকে আস্তাবলের প্রধান থেকে সভাসদের প্রধান করে তোলা। ইয়াকুত নামের এক অতুর্কি তাঁর আনুগত্য এবং যোগ্যতার কারণে হয়ে উঠলেন সুলতানা রাজিয়ার অতি ঘনিষ্ঠ। এর ফলে রাজিয়া তাঁকে আমির প্রধান হিসেবে ঘোষণা করলে তুর্কি সভাসদেরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়। আমিরপ্রধান হওয়ার গৌরব শুধু একজন তুর্কির জন্যই নির্ধারিত ছিল, কোনো আফ্রিকান হাবশি সেই সম্মান পাবেন, তা তুর্কিরা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলেন না।

তা ছাড়া সুলতানা রাজিয়া সব ক্ষেত্রে ইয়াকুতের পরামর্শ গ্রহণ করতেন এবং সেই অনুযায়ীই রাজকার্য পরিচালনা করতেন। তখন গুঞ্জন উঠতে শুরু করে যে ইয়াকুত শুধু সভাসদের প্রধানই নন, সুলতানা রাজিয়ার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কও ছিল। এমন গুঞ্জনই তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সূত্রপাত করেছিল। চারদিক থেকে বিদ্রোহের খবর আসতে থাকে। প্রথমেই বিদ্রোহ করেন লাহোরের গভর্নর। অবশ্য রাজিয়া এই বিদ্রোহ শক্ত হাতে দমন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

অন্যদিকে মালিক আলতুনিয়া ছিলেন রাজিয়া সুলতানার বাল্যবন্ধু এবং কারও কারও মতে তাঁর বাল্য প্রেমিকও। রাজিয়া সুলতানা দিল্লির ক্ষমতায় বসার পরপর তিনি তাঁর কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। কিন্তু রাজিয়া দিল্লির শাসক হিসেবে ব্যস্ততার কারণে প্রস্তাবগুলো বারবার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। যখন মালিক শুনতে পান হাবশি ইয়াকুত রাজিয়ার এত ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন, তখন তিনি সংগত কারণেই অত্যন্ত ক্রুদ্ধ এবং ঈর্ষান্বিত হন। আলতুনিয়া মেনে নিতে পারেনি যে সুলতানা রাজিয়া তাঁকে প্রত্যাখ্যান করে ইয়াকুত তাঁর ঘনিষ্ঠ হতে পারে।

ফলস্বরূপ, রাজিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা শুরু করেন। যুদ্ধে সুলতানা রাজিয়া ইয়াকুতকে সঙ্গে নিয়ে আলতুনিয়ার বাহিনীকে প্রতিহত করতে রওনা দেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত যুদ্ধে রাজিয়া পরাজিত হন। পরাজিত ইয়াকুতকে বন্দী করে পরবর্তী সময়ে হত্যা করা হয়। অতঃপর মালিক আলতুনিয়া রাজিয়াকে বন্দী করে বাতিন্দাতে ফেরত যান। বন্দী করা হলেও তাঁকে রাজকীয় কায়দায় রাখা হয় এবং রোজ শুক্রবারে মসজিদে নামাজ পড়তে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। তাঁর সঙ্গে এমন অভূতপূর্ণ আচরণ ধীরে ধীরে রাজিয়াকে আবার আলতুনিয়ার প্রতি অনুরক্ত করে তুলে এবং দুজন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এদিকে রাজিয়ার অনুপস্থিতিতে তাঁর সৎভাই মুজউদ্দিন বাহরাম দিল্লির ক্ষমতা দখল করেন। বলা হয়ে থাকে, এই বিয়ের নেপথ্যে ছিল মূলত দিল্লির সিংহাসন পুনরুদ্ধার করার ফন্দি।

রাজিয়া যে শুধু জীবন রক্ষার জন্য বা অনুরক্ত হয়ে আলতুনিয়াকে বিয়ে করেননি, তা সহজেই বোঝা যায়। কারণ, শিগগিরই তিনি আলতুনিয়াকে দিল্লি আক্রমণের জন্য প্ররোচনা দিয়ে সফল হন। অতঃপর দিল্লির সিংহাসন পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্যে দুজন একত্রে সৈন্য জড়ো করে দিল্লির অভিমুখে রওনা দেয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে বাহারাম তাদের যুদ্ধে পরাজিত করে। বাহরাম নিজ সিংহাসন শক্ত করার জন্য রাজিয়া এবং তাঁর স্বামী মালিক আলতুনিয়া উভয়কেই হত্যা করেন। এভাবেই ত্রিভুজ প্রেমের এক উপাখ্যানে শেষ হয় ক্ষণজন্মা ভারতবর্ষের প্রথম বীর নারী শাসক সুলতানা রাজিয়ার শাসনের অধ্যায়।

তবে তাঁর মৃত্যু নিয়ে কথিত আছে যে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে ক্লান্ত আর ক্ষুধার্ত অবস্থায় রাজিয়া এক কৃষকের বাড়িতে আশ্রয় নেন। খাওয়াদাওয়ার পর তিনি ঘুমালে কৃষক তাঁর শরীরে রাজকীয় পোশাক দেখতে পায়। পোশাকে প্রচুর রত্ন লাগানো ছিল। কৃষক সহজেই বুঝে যায় তাঁর সামনে ঘুমিয়ে থাকা নারী সাধারণ কেউ নন। কৃষকটি ধন-সম্পদের লোভে পড়ে ঘুমন্ত সুলতানা রাজিয়াকে হত্যা করেন এবং রত্ন নিয়ে পালিয়ে যান।

শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়