যেসব লেখকের লেখা পড়তে ভালো লাগে, তাঁদের মধ্যে অন্যতম আহমদ ছফা (৩০ জুন ১৯৪৩-২৮ জুলাই ২০০১)। তিনি সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি শাখায় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। গল্প, গান, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, অনুবাদ, ইতিহাস, ভ্রমণকাহিনি মিলিয়ে ত্রিশটিরও বেশি গ্রন্থ রচনা করেছেন। জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক ও সলিমুল্লাহ খানসহ অনেকের মতে, মীর মশাররফ হোসেন ও কাজী নজরুল ইসলামের পরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি মুসলমান লেখক হলেন আহমদ ছফা। তাঁর রচনাবলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘বাঙালি মুসলমানের মন’, ‘ওঙ্কার’, ‘একজন আলী কেনানের উত্থান-পতন’, ‘গাভী বিত্তান্ত’, ‘অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী’ এবং ‘যদ্যপি আমার গুরু’। এসব বইয়ে তাঁর লেখা, গবেষণা ও শব্দচয়ন মনোমুগ্ধকর।
গুণী লেখক অনেকেই আছেন। তবে কালজয়ী লেখক তাঁরা, যাঁরা তাঁদের সৃষ্টিতে একযোগে সমকালীন যুগের বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চিরন্তন চেতনার প্রতিফলন ঘটান। আহমদ ছফা ছিলেন এমনই এক অনন্য সাহিত্যস্রষ্টা। তাঁর লেখাগুলোতে যুগের নির্যাস যেমন স্পষ্ট, তেমনি তা সমাজের অন্তর্নিহিত সত্যকে উদ্ভাসিত করে; যা কাল পেরিয়েও নিজের গভীরতা হারায় না। ‘গাভী বিত্তান্ত’ উপন্যাস এই অসাধারণ ক্ষমতারই এক উজ্জ্বল নিদর্শন। উপস্থাপনায় নতুন রূপের ঝলক থাকলেও বিষয়বস্তু আমাদের চিরচেনা সমাজ ও তার অন্তর্গত দ্বন্দ্বের মূলে আঘাত করে। বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও এই উপন্যাসের তাৎপর্য আজও অক্ষুণ্ণ। যেন এটি আমাদের বর্তমানকেই আবার নতুন চোখে দেখার সুযোগ দেয়।
মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদ—এক নির্জনচারী, বিনয়ী আর গোবেচারা মানুষ। প্রয়োজন না হলে তিনি কিছুই বলেন না। যেন শব্দের অপচয়েও তাঁর অনাগ্রহ। ঝামেলায় জড়ানো তাঁর কাছে যেন দুঃস্বপ্নের মতো। অথচ এমনই একজন মানুষ হঠাৎ নিয়োগ পেলেন দেশের সবচেয়ে পুরোনো ও মর্যাদাপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে। সময়টা ছিল ভয়াল—সমাজ জুড়ে বিভেদের দহন, রাজনীতির নামে রক্তক্ষয়ী বিভাজন, আর ক্যাম্পাসজুড়ে উত্তেজনার বিস্ফোরণ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় তখন প্রতিদিন বয়ে যেত সহিংসতার কালবৈশাখী। মিছিলের স্লোগান, দলীয় সংঘর্ষ আর বন্দুকযুদ্ধ যেন ছিল নিত্যকার ঘটনা। আর ছাত্ররাজনীতি? কোমলমতি ছাত্রদের হাতে চীনা কুড়াল হয়ে উঠেছিল এক ভয়ংকর অস্ত্র। এক মুহূর্তে বন্ধুর শরীর থেকে হাত-পা বিচ্ছিন্ন করার যে নির্মম দক্ষতা তারা অর্জন করেছিল, তা পেশাদার কসাইদেরও স্তম্ভিত করে দেওয়ার মতো।
এই তপ্ত, উত্তাল পরিবেশের ভার নিতে এলেন আবু জুনায়েদ। যাঁর নিঃশব্দ উপস্থিতি কি পারে এই অগ্নিগর্ভ বাস্তবতাকে শীতল করতে? নাকি এই প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে তাঁর অধ্যায় হয়ে উঠবে আরও এক দুঃখগাথা?
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ তখন যেন এক নাট্যমঞ্চ। অবসরপ্রাপ্ত কোনো শিক্ষকের ছোট্ট বাসাটি কে দখল করবে, তা নিয়ে শুরু হয় কৌশলের লড়াই। কে কাকে ল্যাং মেরে আগে তালা খুলতে পারবে, সেটাই যেন রীতিমতো গবেষণার বিষয় হয়ে ওঠে। সাধারণ শিক্ষকদের কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা যেখানে প্রায় শূন্য, সেখানে আবু জুনায়েদের মতো এক রদ্দিমার্কা মানুষ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদে আসীন হওয়া যেন এক অলীক কল্পনার মতো। অথচ ঘটনাগুলো দেশের সমকালীন প্রেক্ষাপটের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়।
এদিকে আবু জুনায়েদের স্ত্রী নুরুন্নাহার বানু, যিনি এখন উপাচার্যের বেগম; খুশিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন। যার পড়ালেখার খরচ পর্যন্ত তার বাবা জুগিয়েছিলেন, যার জীবনে দায়িত্ববোধের ছিটেফোঁটাও ছিল না, এমনকি ঘরের চার দেয়ালের ভেতরও যার গুরুত্ব ছিল সামান্য, সেই মানুষটিই যখন হঠাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়ে গেলেন, তখন নুরুন্নাহার বানু মনে মনে ভাবলেন—এ তো সতীর ভাগ্যে পতির মহিমা। এ ছাড়া আর কী হতে পারে!
তবে বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের যিনি উপাচার্য ছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষোভ ছিল অন্য দলীয় শিক্ষকদের, এমনকি নিজের দলেরও কিছু অংশের। সেই ক্ষোভের আগুনে সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন প্রবীণ শিক্ষকেরা—কে কার ভুল তুলে ধরে এক ধাপ এগিয়ে যাবেন, সেই প্রতিযোগিতা চলছিল সভার পর সভায়। সেইসব বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন এক সুন্দরী অবিবাহিতা শিক্ষিকা, দিলরুবা খানম।
এই অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েন আর গোপন ষড়যন্ত্রের ফলেই আবু জুনায়েদকে হঠাৎ করে উপাচার্যের আসনে বসিয়ে দেওয়া হয়। অথচ এই পদোন্নতির আড়ালে লুকিয়ে ছিল এক গভীর অসন্তোষ। প্রবীণ শিক্ষকেরা ভেতরে ভেতরে ক্রমশ ক্ষোভের পাহাড় গড়ে তুলছিলেন, যেন কোনো একদিন সেই পাহাড় ধসে আবু জুনায়েদের সাম্রাজ্য ভেঙে যাবে।
ব্রিটিশ স্থাপত্যের সুন্দর নিদর্শন উপাচার্য ভবনটিতে জুনায়েদ পরিবার উঠে আসার পর নুরুন্নাহার বানু সেখানে থাকা অন্যান্য সরকারী কর্মচারীদের ওপর কর্তৃত্ব ফলানোর চেষ্টা করতে গিয়ে তাদের ওপর অযথা বিরূপ মন্তব্য করতে লাগলেন। স্বামীর সহকর্মীদেরকেও ছাড় দিলেন না। উপাচার্য-স্ত্রী হিসেবে কথার দমক একটু বেশিই ছোটালেন। তাই উপাচার্য হওয়ার পরে আবু জুনায়েদের মধ্যে দ্রুত যা পরিবর্তন আসছিল তাতে ছেদ পড়তে লাগল।
পরিবারে যেকোনো ব্যাপার নিয়ে স্ত্রীর অশান্তি, বিশ্ববিদ্যালয়ে তার দুর্বলতার সুযোগে দিন দিন রাজনীতি-খুন বেড়ে যাওয়া, সময়ের আগেই তহবিলের অর্থ ফুরিয়ে যাওয়া। এ নিয়ে আবু জুনায়েদের চিন্তার শেষ ছিল না।
গরিব কৃষক পরিবারে জন্ম আবু জুনায়েদের। গৃহপালিত পশু-পাখির প্রতি সেই ছোটবেলা থেকেই টান। বাবার মাটি কাটা দেখে বড় হয়েছেন, নিজের বানানো গোয়ালঘরে গরু পালনের শখ ছিল বরাবরই। সেই শখ পূর্ণ হয় তার। এক ঠিকাদার চাচা-শ্বশুরের কাছ থেকে উপহার পান খুবই দামি এক গাভী। সঙ্গে নানা জাতের পাখিও উপহার পান এক সহকর্মীর কাছ থেকে। তার পর থেকে সেই গাভীকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মহলে নানা আলোচনা-সমালোচনা চলতে থাকে।
‘গাভী বিত্তান্ত’তে যে গাভীর বৃত্তান্ত আছে, সেটি সাভার ডেইরী ফার্মে অস্ট্রেলিয়ান ষাঁড় ও সুইডিশ গাভীর ক্রসে উৎপাদিত; ছিপনৌকার মত গড়ন, সুন্দর চোখ, উন্নত গ্রীবাবিশিষ্ঠ একটি গাভী ‘তরনী’। এই নোংরামি আরও বেশি প্রকাশ পায় যখন দেখা যায় উপাচার্য সাহেবের প্রিয় গাভী তরনীকে নিয়ে ক্যাম্পাসে গল্প শুরু হয়। দেখা যায় কে বা কারা যেন আবু জুনায়েদ সাহেবকে ‘গো আচার্য’ সম্বোধন করে লিফলেট বিতরণ করে তার বিরুদ্ধে সবাইকে উস্কে দেয়। অন্যদিকে প্রিয় গাভীর জন্য বাসভবনের সঙ্গে একটা ‘প্রাসাদোপম’ গোয়াল তৈরি করা হয়। তার নিজ পরিবারে একের পর এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতে থাকে গাভীকে কেন্দ্র করে। আবু জুনায়েদ সাহেবের গাভী-প্রীতি দেখে তার স্ত্রী পর্যন্ত তাকে সন্দেহ করে বসেন।
গাভীটি নিয়ে মূলত বাঁধ সাধলেন আবু জুনায়েদের স্ত্রী। তার ধারণা হয় এই গাভী ঘরে আসার পর থেকে স্বামী তার প্রতি আগের চেয়েও নিস্পৃহ হয়ে পড়েছেন। যে কারণে পরে গাভীটির খড়কুটোর সঙ্গে বিষ মিশিয়ে নির্দ্বিধায় হত্যা করেন।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধীদলীয় শিক্ষদের তাক লাগিয়ে দিয়ে আবু জুনায়েদ প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে সমগ্র বিশ্বের একান্নটি দেশে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করার একটি সুযোগ পেয়ে যান। যার জন্য মোটা অংকের সম্মাননাও ঘোষণা করা হয়।
জ্ঞানচর্চার নামে আমাদের দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যা হয়, তার একটা নমুনা হিসেবে এই উপন্যাস আজও প্রাসঙ্গিক বলেই মনে হয়। উপন্যাসের চরিত্রগুলোর নামের আড়ালে সত্যিকার অনেক চরিত্রই উঠে এসেছে, অনেক পাঠকই তা ধরতে পারবেন। ধরতে পারবেন আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কী চলছে!
‘গাভী বিত্তান্ত’ বহু বছর আগে লেখা হলেও, এর বিষয়বস্তু এবং বিশ্লেষণ এখনো বর্তমান সমাজের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, শিক্ষকদের মধ্যে দুর্নীতি, ছাত্র আন্দোলন এবং ক্ষমতার চর্চা এখনো চলমান। এই উপন্যাসে ছফা যে ভাষা ব্যবহার করেছেন, তা আজকের সময়ে এসে আরও বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। যেখানে প্রতিদিনের রাজনৈতিক পরিবর্তন ও সামাজিক দ্বন্দ্ব তুলে ধরা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙ্গিনায় এখনো রাজনীতি এবং ক্ষমতার লড়াই চলে। যদিও পরিবেশ অনেকটাই পাল্টে গেছে। কিন্তু একসময়কার পরিস্থিতি আজও আমাদের সমাজের অন্তর্নিহিত এক অংশ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ছফার লেখায় সেই সত্ত্বার চিত্র অমলিন হয়ে আছে। আজকের বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা, বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি, অবস্থা—এগুলো পাঠককে এই উপন্যাসের সঙ্গে সম্পর্কিত করতে সাহায্য করে।
মার্জিত ভাষা ব্যবহার করে কীভাবে স্যাটায়ার বা বিদ্রূপধর্মী উপন্যাস লেখা যায়, ‘গাভী বিত্তান্ত’ তারই স্বচ্ছ উদাহরণ। নাম দেখে যে কেউই ভাবতে পারেন, বইটি গাভী প্রজাতির সূক্ষ্ম বিচার-বিশ্লেষণ নিয়ে লেখা। কিন্তু পড়লেই বোঝা যায়, আজকের মানব সমাজের চাইতে পশুসমাজ অনেকগুণে উন্নত। তারা নিরীহ, কিন্তু এখনকার জগৎ-সংসারের মতো কুটিল নয়।