আশরাফ শিশির বাংলাদেশের একজন জীবনমুখী ভিন্ন ধারার মননশীল পরিচালক। মানুষের জীবনের মধ্যে নিয়মিত সৃষ্টির রসদ খুঁজে বেড়ান। তাঁর মুক্তি পাওয়া প্রথম চলচ্চিত্র ‘গাড়িওয়ালা’-এর মধ্যে বেশ কয়েকটি বিষয়ে নিজেকে খুঁজে পেলাম। পরিচালকের নিজের লেখা গল্পটি আবর্তিত হয়েছে ছোটদের বিয়ারিংয়ের গাড়ি নিয়ে। বাবার বিয়ারিংয়ের ব্যবসা থাকাতে ছোটবেলায় আমরাও বিয়ারিং ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খেলতাম। এ ধরনের বিয়ারিংয়ের গাড়ি কত দেখেছি। গ্রামবাংলার শৈশব যেভাবে পায়ে পায়ে ডাব নিয়ে ছুটতে ছুটতে ফুটবল খেলতে শিখেছে, ডাংগুলি খেলতে খেলতে লাকড়ি দিয়ে ব্যাট বানিয়ে ক্রিকেট খেলতে শিখেছে, সুপারিগাছের পাতায় বা খোলে এক বন্ধু অন্য বন্ধুকে বসিয়ে গাড়ির মতো টেনে নিয়ে গেছে, সেভাবেই তাদের হাতে উঠে এসেছে বিয়ারিং লাগানো ছোট চাকার ছোট ছোট কাঠের গাড়ি।
বিয়ারিং সভ্যতার বিবর্তনের একটি অংশ। কাল্পনিক কাহিনির কৃষ্ণের সুদর্শন চক্রের মতো। বিয়ারিং না থাকলে কলকারখানার মেশিন চলে না, রাস্তার ছোট–বড় কোনো গাড়ি চলে না, প্রত্যেকের ঘরের পাখাটি পর্যন্ত ঘোরে না। ছোটবেলা থেকে আমাদের মনের মধ্যে যেমন জাগিয়ে দেওয়া হয়, পড়াশোনা করে যে গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে। পড়াশোনা করে জ্ঞান–বিজ্ঞানের পথ ধরে স্বপ্নের পথে উড়াল দেওয়া। জীবনকে গতির স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া। আশরাফ শিশিরের গল্পের হতদরিদ্র পরিবারের দুই শিশু হাবিল আর কাবিলও নিজেদের সীমিত ক্ষমতার মধ্যে নিজেদের মতো করে স্বপ্নের গতিপথ তৈরি করেছে। প্রথাগত শিক্ষার বাইরেও যে প্রতিটি মানুষের জীবন অনেক বড় শিক্ষক, হাবিল-কাবিলও সেই শিক্ষায় শিক্ষিত।
পরিচালক এভাবে শুধু শৈশবের স্বপ্নের উড়াল নির্মাণ করেন না, বিচ্ছিন্ন বারেবারে পরাজিত, লড়াকু মানুষের জীবনের কাছে হেরে যেতে যেতেও জয়ের স্বপ্ন বুনে দিয়ে যান।
হাবিল আর কাবিলের বাবা রিকশা চালাতেন। দুই ভাই মিলে সেই রিকশায় চড়ে কত আনন্দ করেছে। হঠাৎ সেই বাবা একদিন দুই শিশুসন্তানকে ফেলে, স্ত্রীকে ফেলে উধাও হয়ে যান। শৈশব হয়ে পড়ে বিচ্ছিন্ন। সংসার সামলাতে মাকে ধান ভাঙার কলে গিয়ে কাজ করতে হয়। সমবয়সী ছেলেরা স্কুলে গেলেও ওরা স্কুলে যেতে পারে না। সবাই যেভাবে জাতীয় পতাকাকে সালাম জানায়, ওরাও চুপিচুপি স্কুলের সামনে গিয়ে জাতীয় পতাকাকে সালাম জানিয়ে আসে। পরিচালক আসলে বুঝিয়ে দিতে চান, বহু লড়াই সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত একটা দেশ, একটা রাষ্ট্র সমাজের বৈষম্য কিন্তু দূর করতে পারেনি। এ ধরনের বিচ্ছিন্ন শিশুদের শৈশব যে তিমিরে ছিল, এখনো সেই তিমিরেই। ওদেরও ইচ্ছা জাগে সবার মতো করে মূলধারার একটা জীবন পাওয়ার।
ঘরে মা না থাকাতে হাবিল-কাবিল সারা দিন মাঠে-ঘাটে ছুটে বেড়ায়। গ্রামের শৈশব জীবন, শৈশবের সব ধরনের খেলাধুলা, দুষ্টুমি, হইচই পরিচালক একেবারে বাস্তবের মাটি থেকে অসাধারণ রূপে তুলে এনেছেন। পল্লিবাংলার সৌন্দর্য ক্যামেরার ভাষায় এই চলচ্চিত্রে অনবদ্য রূপ পেয়েছে। গ্রামীণ জীবন, দিগন্তবিস্তৃত খেতখামার, চাষবাস, হস্তশিল্প, গ্রামীণ হলের সিনেমার প্রচার ইত্যাদিও ভাস্বর হয়ে থাকবে এই নান্দনিক চলচ্চিত্রে। দশ বছরের দুরন্ত শৈশব হঠাৎ একদিন জানতে পারল, তাদের হারিয়ে যাওয়া বাবা অনত্র গিয়ে সংসার পেতেছেন। সেখানে একটি শিশুসন্তানও আছে। মানসিক ধাক্কায় হঠাৎ সে অনেকটা বড় হয়ে গেল।
ঠিক এই জায়গায় এসে আমিও একটা অন্য রকম জীবনের মিল খুঁজে পেলাম। চট্টগ্রাম শহরে আমরাও দুধে–ভাতে বেড়ে উঠছিলাম। বাবাকে বাধ্য হয়ে দেশ ছেড়ে আসতে হয়েছিল। শহরের বাসা ছেড়ে গ্রামে এর–তার বাড়িতে গিয়ে আমাদের আশ্রয় নিতে হয়েছিল। জীবনের হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনার তোড়ে কৈশোরে আমিও এক ধাক্কায় অনেকটা বড় হয়ে গিয়েছিলাম। এরপর তো দেড়-দুই বছর দেশের মাটিতেও বিচ্ছিন্ন সময় কাটিয়ে, ১৩ বছর বয়সে মা আর ছোট ছোট ভাইবোনের হাত ধরে উদ্বাস্তু হয়ে চলে এসেছি। শুরু হয়েছে শূন্য থেকে বেঁচে থাকার নতুন লড়াই। শিল্প, সাহিত্য, চলচ্চিত্র জীবনের দর্পণ। এভাবেই জীবন খুঁড়ে চলা একজন সৃষ্টিসাধকের দর্শনের সঙ্গে অন্য জীবন পোড়া সৃষ্টিসাধকের দর্শনেরও মিল ঘটে যায়। মিল ঘটে বলেই সৃষ্টি সার্থক হয়।
হাবিল-কাবিল খেলার মাঠে বারবার হেরে যেতে যেতে নিজেদের অর্জিত অর্থে বিয়ারিং কিনে এনে গাছের ডাল কেটে ছোটে নিজেদের গাড়ি তৈরি করতে। সেই বিয়ারিংয়ের গাড়ি ছুটিয়ে জয় ছিনিয়ে আনে। পরিচালক এভাবে শুধু শৈশবের স্বপ্নের উড়াল নির্মাণ করেন না, বিচ্ছিন্ন বারেবারে পরাজিত, লড়াকু মানুষের জীবনের কাছে হেরে যেতে যেতেও জয়ের স্বপ্ন বুনে দিয়ে যান। ধানকলের মালিকের লোভী দৃষ্টি, লালসার শিকার হওয়া নিগৃহীতা অসুস্থ লড়াকু শ্রমিক মাকে বাঁচানোর জন্য, নিজেদের স্বপ্ন উড়ানে বসিয়ে ঝড়ের রাতে দুই শিশু শহরে হাসপাতালের পথে ছুটে চলে। নিম্নবর্গের মানুষের জীবন যন্ত্রণা এখানে যেমন তীব্র অভিঘাত তৈরি করে, একই সঙ্গে লড়াই, লড়াই আর লড়াই, যমে-মানুষে লড়াই করে বেঁচে থাকার মুক্তির পথ ধ্বনিত হয়। এমন দৃশ্য বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে স্থান করে নেওয়ার মতো। গ্রামবাংলার ছবি হলেও চেনা পরিচিত ঘটনা, শৈল্পিক বুনন, সুন্দর চিত্রায়ণ—সব মিলিয়ে এই ছবি তাই হয়ে ওঠে বিশ্বজনীন একটি চলচ্চিত্র।
হাবিল-কাবিল চরিত্রে অভিনয় করে মাতিয়ে দিয়েছেন মারুফ শেখ ও কাব্য। মায়ের চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেছেন রোকেয়া প্রাচী। ধানকলের মালিক মাসুম আজিজ এবং হাবিল–কাবিলের বাবার চরিত্রে ছিলেন রাইসুল ইসলাম আসাদ। এ ছাড়া অভিনয় করেছেন ইমরান ইমু, সানসি ফারুক, মোসলেম উদ্দিন, আর. জে মুকুল, জগন্ময় পাল, সাকি ফারজানা, মুক্তা, সিডর সুমন, হুমাইরা জ্যোতি, ইদ্রিস আলী। সম্পাদনায় ছিলেন সাব্বির মাহমুদ, চিত্রগ্রহণ নির্দেশনায় সোহাগ চৌধুরী, শিল্পনির্দেশনায় সলিল মজুমদার, সংগীত পরিচালনা করেছেন রাফায়েত নেওয়াজ, রূপসজ্জায় ছিলেন আব্দুল হক। কাহিনি, চিত্রনাট্য, পরিচালনায় আশরাফ শিশির।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নিয়ে বহুদিন ধরে লিখছি। এই সুন্দর চলচ্চিত্রটি না দেখলে বৃত্ত অসম্পূর্ণ থেকে যেত।
হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত