হারানো দিনের মামাবাড়ি

অলংকরণ: তুলি
স্বপ্রণোদিত হয়ে মনের খায়েশে যে কয়েকটি কাজ করতে পছন্দ করি, তার একটি বড়শি দিয়ে মাছ ধরা। মামাবাড়ির পেছনের পুকুর, মাছের ঘের সব জায়গা থেকেই মাছ ধরেছি।

বাগেরহাট জেলার রাখালগাছি ইউনিয়নের ভাটপাড়া কাড়াখালী গ্রামটি ছবির মতোই সুন্দর, ছিমছাম। মাছের ঘের, গাছগাছালি ও পাখপাখালি কী নেই সেখানে। মনে পড়ে, মামাবাড়ির সামনের রাস্তায় তখনো ইট বসেনি। যে রাস্তাটা বাজার অভিমুখী, ওই রাস্তাটা শুধু পাকা ছিল। বর্ষার সময়ে গেলে খুব কষ্ট হতো। পাকা রাস্তা থেকে বাড়ি বেশ খানিকটা ভেতরে। মাটির রাস্তা। হাঁটুসমান কাদা হতো। আসা-যাওয়ার জন্য যদিও সাঁকোর ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু সাঁকো পার হতে ভয় পেতাম। জুতা হাতে নিয়ে কাদা ভেঙে যেতাম।

যখনকার কথা বলছি, তখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। আর আজ স্নাতক শেষ করে স্নাতকোত্তর পর্যায়ের পড়ালেখায় যুক্ত হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। চোখ বন্ধ করলে স্পষ্ট সব দেখতে পাই। মুলি বাঁশের বেড়ার দেয়াল, মাটির মেঝে আর গোলপাতার ছাউনির বাড়ি ছিল। তিন কক্ষবিশিষ্ট বাড়ির ঠিক পাশে এক চালার রান্নাঘর; রান্নাঘর থেকে সামান্য একটু দূরে ছিল গোয়ালঘর।

মামাবাড়ির মূল বসতভিটা অনেকটা জায়গা নিয়ে। বাড়ির পেছনে পুকুর। পুকুরের একপাশে বাঁশবন। আর দুই পাশে সুপারি, নারকেলসহ বিবিধ গাছ। পুকুরটা বেশ গভীর। শিগগিরই জল ফুরায় না। মায়ের কাছে শুনেছি, ছোটবেলায় পুকুরে একবার ডুবে গিয়েছিলাম। সেজ মাসি (মায়ের সেজ বোন) আমাকে তুলে আনেন। সৃষ্টিকর্তার অশেষ করুণায় সে যাত্রায় প্রাণে বেঁচে যাই।

স্বপ্রণোদিত হয়ে মনের খায়েশে যে কয়েকটি কাজ করতে পছন্দ করি, তার একটি বড়শি দিয়ে মাছ ধরা। মামাবাড়ির পেছনের পুকুর, মাছের ঘের সব জায়গা থেকেই মাছ ধরেছি। তবে বড়শি জোগাড় করতে বেগ পোহাতে হতো। মামারা মাছ ধরার কাজে বড়শি ব্যবহার করেন না, জাল দিয়ে ধরেন। ইচ্ছা করলেই তখন বাজারে বড়শি কিনতে যেতে পারতাম না। বড় রাস্তা, গাড়ি চলাচল করে, অচেনা জায়গা ইত্যাদি বলে মা বাধা দিতেন। বড়শির জন্য প্রতিবেশী এক দাদু ছিলেন একমাত্র ভরসা। দিদা (মায়ের মা) তাঁর কাছে নিয়ে যেতেন। ভালো-মন্দ কথোপকথন শেষে বড়শি আর চার দিতেন তিনি। একদিনের কথা মনে পড়ছে, কঞ্চির পুরোনো একটি ছিপ দিয়ে মাছ ধরছি, মাছ টোপ গিললে টান দিতেই মাঝ বরাবর ছিপটা ভেঙে যায়। ছিপ নিয়ে মাছ ছুটতে থাকে। অপেক্ষা না করে আমিও নেমে পড়ি জলে, সাঁতরে ছিপসহ মাছটা তুলে আনি।

ওই সময়ে একটা বড় আমগাছ ছিল উঠানে। আম-কাঁঠালের সময় গেলে খুব মজা হতো। দাদুর সঙ্গে আম-কাঁঠাল কিনতে বাজারে যেতাম। বাড়ির গাছের আমও সুস্বাদু ছিল। গাছে পেকে সিঁদুরের মতো লাল হয়ে থাকত। ঢিল ছুড়ে পাড়তাম। তা ছাড়া জ্যৈষ্ঠ মাসে গ্রামে একটা পূজা হয়। এই পূজা উপলক্ষে মেলা বসত। কবিগানের আসর হতো। নির্দিষ্ট বিষয়ে দুজন মানুষ গানে গানে কথার লড়াই করতেন। হরেক রকম খেলনার দোকান বসত। এটা কিনে দাও, ওটা কিনে দাও বলে মামা-মাসিদের নাজেহাল করতাম।

‘পান খেলে কেন গাল লাল হয়?’ মামা বাড়ি গেলে তখন প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতাম। উঠানসংলগ্ন বড় দুটি জমির একটিতে পানের বরজ আর অন্যটিতে আঁখ লাগাতেন দাদু। গোটা গোটা পান বরজ থেকে তুলে মাকে লুকিয়ে খেয়ে গাল লাল করে সবাইকে দেখাতাম। পাশের বাড়ির দিদারা (মায়ের কাকি সম্পর্কের প্রতিবেশী) বলতেন, ‘ভাই পান খেলেই গাল টকটকে লাল হয়ে যায়। ওর বউ খুব ভালো দেখতে হবে। ওকে ভীষণ ভালোবাসবে।’ শিয়ালের উৎপাত ঠেকাতে কত দিন যে দাদুর সঙ্গে রাত জেগে আঁখবন পাহারা দিয়েছি, হিসাব নেই।

সারা বছর ঘটা করে মামাবাড়ি যাওয়ার সুযোগ খুব কমই হতো। বিভিন্ন অনুষ্ঠান আর বার্ষিক পরীক্ষার পরের ছুটিতেই যেতাম বেশি। ডিসেম্বরের শেষে গেলে কত ধরনের পিঠা বানিয়ে খাওয়াতেন দিদা, নাম বলে শেষ করা যাবে না। তবে দিদার হাতের রসে ভেজানো পিঠার স্বাদ কখনো ভুলে যাওয়ার নয়।

দিনে দিনে সব বদলে গেছে, কোনো কিছুই আর আগের মতো নেই। মামাবাড়ির সামনের রাস্তায় এখন আর আগের মতো কাদা হয় না। ইট বসেছে। বাড়িটিও এখন পাকা। শহুরে বাড়ির মতো প্রায় সব ব্যবস্থা আছে। ছয় বছর হলো দাদু মারা গেছেন। প্রাত্যহিক জীবনের ঘনঘটা নিয়ে আমিও দারুণ ব্যস্ত। আগের মতো অনুষ্ঠান উপলক্ষেও সব সময় যাওয়া হয়ে ওঠে না। তারপরও মামাবাড়ির উঠানের বড় আমগাছ, রান্নাঘরের পাশের লম্বা বরইগাছ, পুকুরে নুয়ে পড়া শিশুগাছ, আঁখবন, বড়শিতে মাছ ধরা, দাদুর পেছনে লাগার অকৃত্রিম সুন্দর মুহূর্তগুলোর ছবি চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই। কোনো কোনো দিন হারানো মামাবাড়ির দিনগুলোর কথা ভাবতেই দুই চোখ জলে ভরে ওঠে।

বন্ধু, ঢাকা মহানগর বন্ধুসভা