সমালোচকই নেতার বন্ধু

লেখাটি ২০২৪ সালের জুনে প্রকাশিত বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের ‘তারুণ্য’ ম্যাগাজিনের দশম সংখ্যা থেকে নেওয়া।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

পারস্য রূপকথার বীর রুস্তম বলেছেন, ‘অভিজাত ও ভদ্রলোকেরা অন্যের সমালোচনার মধ্যেও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি খুঁজে দেখার চেষ্টা করে।’ আমরা যাঁরা বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও স্বেচ্ছাসেবামূলক সংগঠনে যুক্ত রয়েছি, সেখানে আলোচনা-সমালোচনা থাকবেই। নেতার কাজ হচ্ছে নীরবে সেগুলো শুনে যাওয়া ও নিজেকে শুধরে নেওয়া। কোনোভাবেই নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখানো ঠিক হবে না। সহ্য করে নেওয়ার মাধ্যমে নেতা আরও বেশি উৎকর্ষ সাধনে সক্ষম হবেন।

বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট ও সমাজ-সংস্কৃতির ধারণা অনুযায়ী এ দেশের প্রতিটি পরিবার সন্তানের আয়রোজগারের ওপর নির্ভরশীল। ফলে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও স্বেচ্ছাসেবামূলক সংগঠনে নেতৃত্ব দিলেও দিন শেষে কর্মীকে তাঁর পরিবারের কথাও চিন্তা করতে হয়। নিজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভাবতে হয়।

সংগঠনে নেতৃত্ব দেওয়ার পাশাপাশি ক্যারিয়ারকেও সুন্দর একটি স্থানে নেওয়ার চিন্তা করতে হয়। ফলে একটি ছেলে বা মেয়ে যে উদ্দেশ্য নিয়ে সংগঠন করতে আসে, একটা সময় পর দ্রুত সে নিজেকে সরিয়ে নেয়। পরবর্তী সময়ে সংগঠনের ধারে-কাছেও ভেড়ে না। নিজের ক্যারিয়ার গঠন করে পরিবার-পরিজন নিয়ে ভোগ-বিলাসে মত্ত হয়ে যায়। সমাজ-সংসার ও বাইরের বাস্তবিক জগৎ তাঁর নিকট তুচ্ছ হয়ে যায়। আমাদের বড় একটি সমস্যা হচ্ছে যখন সংগঠন করি, তখন অতি আবেগে সবকিছু উদার হস্তে দান করি। এখানে সবকিছু বলতে ক্যারিয়ার ও ব্যক্তিগত জীবন বোঝানো হয়েছে; যা পক্ষান্তরে ওই কর্মীর জনাই বড় একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। নিজের ক্যারিয়ার ও জীবনবোধ সবকিছু বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়। একসময় প্রচণ্ড হতাশা নেমে আসে। আমাদের সংগঠনে যুক্ত হওয়া থেকে প্রতিটি ধাপে ধাপে যদি নিম্নোক্ত কথাগুলো মনেপ্রাণে ধারণ করি, তাহলে কেউ আমাকে ছুড়ে ফেলার সাহস পাবে না। আমার নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় থাকবে, স্বতন্ত্র একটি সত্তাও তৈরি হবে।

— অতীতকে ধারণ করো, যতটা ধারণ না করলে অন্যেরা তোমাকে আহাম্মক ভাববে।

—দয়ালু হও, তবে সেটি তোমার শরীরের ওপর দিয়ে অতিক্রম করার আগপর্যন্ত।

—উপদেশ দাও, তবে তোমাকে বিরক্তিকর মনে করার আগপর্যন্ত।

—নিজের ভান্ডার থেকে দান করো, তবে অবশ্যই নিজের ভান্ডারে যেন কিছুটা গম

অবশিষ্ট থাকে।

—অন্যের ভুলত্রুটিগুলো এড়িয়ে যাও, তবে অবশ্যই অন্যরা যেন না ভাবে যে তার কোনো

দোষ নেই বা নিষ্পাপ।

—নিজেকে গড়ো, নয়তো একসময় সবাই তোমাকে পিছু ফেলে দিবে। সবার পেছনে তোমার স্থান হবে, উঠে দাঁড়ানোর শক্তিও পাবে না।

—কাউকে যদি ভালোবাসো, তার জন্য সর্বোচ্চ লড়াই করো। তবে সেটি নিজে ভেঙে

পড়ার আগপর্যন্ত।

—শেষ পর্যন্ত নিজের ওপর বিশ্বাস রাখো। যতক্ষণ পর্যন্ত না পৃথিবীর ভালো মানুষগুলোর কেউ না কেউ তোমাকে বিশ্বাস করে।

এ দেশের আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে কোনো নেতা যদি পূর্বে একবার ভুল করেন, তবে সেটি তাঁকে সারা জীবন বহন করতে হয়। যত ভালো কাজই করুন না কেন, শেষ দিন পর্যন্ত স্বার্থান্বেষী মহল তাঁর গালমন্দে ব্যস্ত থাকে। তাই এখানে ভালো মানের নেতা পাওয়া দুষ্কর। ভালো হতে চাওয়া বা ভালোভাবে সংগঠনকে নেতৃত্ব দিতে চাওয়া মানুষগুলো ধীরে ধীরে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। পক্ষান্তরে সংগঠনের জন্য এটি একটি বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যায়। কবি ফরিদউদ্দিন আত্তার বলেছেন:

এমনকি যদি আকাশের ফেরেশতাও হও,

সব সময় এমন একজনকে খুঁজে পাবে,

যে তোমার ডানা ঝাপটানোও পছন্দ করবে না।

অতএব সফল নেতা হতে হলে সকল সমালোচনা এড়িয়ে যেতে হবে। নিবিষ্ট মনে কাজ করে যেতে হবে। তবেই দেশ ও জাতির কল্যাণ সাধিত হবে।

 উপদেষ্টা (২০২২-২০২৩), বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ