জহির রায়হানের ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’

জহির রায়হানের ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’

আমাদের এই জীবনে খুব কাছের মানুষদের অনেক সময় আমরা চিনতে ভুল করি। সচরাচর যে ব্যক্তিটি আমাদের ভালোবাসে, যত্ন নেয়, স্নেহ করে, আগলে রাখে, তাকে আমরা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করি না। অথচ তারাই দেখা যায় দিন শেষে জীবনে থেকে যায়।

রুটিনমাফিক সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা কেরানির চাকরি করা কাসেদকে সালমা ভালোবেসেছিল, যা সে বুঝতে দেরি করে। পরবর্তী সময় জাহানারাকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসলেও মুখ ফুটে বলার মতো সাহস ও পরিস্থিতি আসেনি। অসমাপ্ত থেকে যায়। এর মধ্যে হঠাৎ শিউলির আগমন। সে জাহানারার কাজিন। শিউলি মেয়েটির চাঞ্চল্য আর সরলতা কাসেদকে মুগ্ধ করে, অজান্তে হোক কিংবা অভিনয়, কাসেদ তাকে ভালোবেসে বিয়ে করতে চায়। অথচ সেটা সাময়িক একটা চাওয়া, যা সচরাচর অনেকের মনেই উঁকি দেয়। কিন্তু শিউলি রাজি হয়নি। সে কাসেদকে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে ফিরিয়ে দেয়।

আর অফিসের সহকর্মী মকবুল বুড়োর বাড়িতে যাওয়ার পর, সন্ধ্যার অন্ধকারে জানালার পর্দার আড়ালে পেছন ফিরে বসে থাকা কালো মেয়েটিকে কাসেদ কোনো দিন দেখতে পেল না। মনের মধ্যে একটা আগ্রহের জায়গা সব সময়ই ছিল দেখার, কিন্তু হলো না। সেই মেয়েকে বিয়ে করে ফেলল অফিসের বড় সাহেব। তবু তার চেহারাটা দেখা হলো না কাসেদের, অজানাই রয়ে গেছে সন্ধ্যার আবছা আলোর মেয়েটি।

শেষ মুহূর্তে যখন না বলা কথাগুলো বুকে নিয়ে জাহানারার সঙ্গে দেখা না হওয়ায় দুঃখ নিয়ে কাসেদ ফিরে এল, তখন জীবন সন্নিকটে কালো ছায়া নেমে এল তার। ধর্মপরায়ণ একমাত্র অভিভাবক মা অসুস্থ হয়ে দীর্ঘদিন বিছানায় থেকে এক রাতে মারা গেল। চাচাতো বোন নাহারকে তার খালু নিয়ে গেল বিয়ে দিতে। কাসেদ একা হয়ে গেল।

একা হয়েও একা হতে হলো না কাসেদকে। বিষণ্নতা যখন ভর করল একাকী কাসেদকে, সে তখন চুপচাপ নীরব হয়ে গেল। শেষ বিকেলে দরজায় কলবেল বেজে ওঠে। দরজা খুলেই সে বুঝতে পারল শেষ বিকেলের মেয়েটিই তাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে নিতে চায় মনপ্রাণ দিয়ে। যাকে কাসেদ হয়তো মনেও করেনি কোনো দিন, বুঝেওনি তার চোখের ভাষা। সে আর কেউ নয়, তাদের বাড়িতে থাকা নাহার।

কাসেদ অবাক হয়। তবু পরিস্থিতি মেনে নেয়। সে যাদেরকে চেয়েছিল, তারা কেউ আসেনি তার জীবনে। আর যারা আসতে চেয়েছিল, তাদেরকেও সে ফিরিয়ে দিয়েছে। তাই আজ নাহারকে সে ফিরিয়ে দেয়নি, ঘরে জায়গা দিয়েছে।

জীবন হয়তো এমনই। যা ভাবা যায়, দেখা যায়, কল্পনা করা যায়, তা না–ও ঘটতে পারে। আবার যা ভাবনার বাইরে তা–ও সত্য হয়ে চোখের সামনে হাজির হয়, যা প্রত্যাখ্যান করা যায় না। মেনে নেওয়াই যখন জীবনের সৌন্দর্য, তখন সহজ করে মানিয়ে নিতে পারলেই জীবন সুন্দর হয়।

একনজরে
বই: শেষ বিকেলের মেয়ে
লেখক: জহির রায়হান
ধরন: উপন্যাস
প্রকাশক: মিলন নাথ
প্রকাশনী: অনুপম
প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: ধ্রুব এষ