পরিচিত মুখ

অলংকরণ: তুলি
এ কী, আমি দেখি কাঁদছি। দুচোখভর্তি জল। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। অথচ কান্নার কোনো শব্দ হচ্ছে না। পুরুষেরা কি এমনই? হাজারো ব্যথা বুকের মধ্যে লুকিয়ে মুখে হাসি ঝুলিয়ে রাখে?

খাবার টেবিলে বসে আছি। আম্মা ভাত বেড়ে দিল। পাতে ইলিশ আর কুমড়ার তরকারি তুলে দিল। আমি ভাত নেড়ে নেড়ে দেখছি। আম্মা মেঝেতে বসে শসা কাটছে আর বলছে, ‘রাফিন, মেয়েটা খুব ভালোই ছিল রে। কেন যে এমন হলো!’ আমি গ্লাস নিয়ে পানি খাচ্ছি। গ্লাস মুখের ওপর ধরে রেখেছি।

গ্লাস নামিয়ে প্রসঙ্গটা পাল্টানোর জন্য আম্মাকে বললাম, ‘আম্মা, ইলিশ মাছের তরকারিটা খুব স্বাদ হয়েছে। কত দিন যে খেতে ইচ্ছে করছিল!’
আম্মা সামান্য হাসলেন। তার ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠল। বললেন, ‘তুই তো ইলিশ মাছ দেখতেই পারিস না। ইলিশ মাছের গন্ধও তো সহ্য করতে পারিস না। ইলিশ মাছের গন্ধ শুঁকলে তুই দুই মাইল দূরে থাকিস। তোর আবার ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছা করে?’

আম্মা মিথ্যে বলেননি। কোনো বাড়িতে ইলিশ মাছ রান্না হলে দূর থেকেই বলে দিতে পারতাম যে ওই বাড়িতে আজ ইলিশ মাছ রান্না হচ্ছে।
আমি অন্য দিকে ফিরে বললাম, ‘না আম্মা। আমি এখন অনেক কিছুই সহ্য করতে পারি। আমার সহ্যের সীমা এখন অনেকদূর।’
আম্মা সালাদ দিতে এলেন। আমি পাতে পানি ঢেলে উঠে পড়লাম।
‘কী রে বাপধন, ভাত খাবি না? মাছটাও তো শেষ করলি না। কই যাস?’

আমি বেসিনে হাত ধুতে এলাম। আমার ঘরের দরজার ঠিক বাঁদিকে বেসিন। বেসিনে একটা আয়না ঝোলানো। আয়নার একপাশ ভাঙা। মাঝখানে বড় করে একটা ফাটা দাগ পড়েছে। আমার অর্ধেক চেহারা দেখা যাচ্ছে আর বাকি অর্ধেক বড় বড় লাগছে। কল ছেড়ে দাঁড়িয়ে আছি। হাত ধুতে যাব, ঠিক তখনই চোখ পড়ল ভাঙা আয়নায়। এ কী, আমি দেখি কাঁদছি। দুচোখভর্তি জল। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। অথচ কান্নার কোনো শব্দ হচ্ছে না। পুরুষেরা কি এমনই? হাজারো ব্যথা বুকের মধ্যে লুকিয়ে মুখে হাসি ঝুলিয়ে রাখে?

আমি ঘরে এলাম। খাটে বসলাম। বালিশের পাশ থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা নিলাম। খুব একটা ধূমপান করি না। বন্ধুদের সঙ্গে নদীর পাড়ে বসলে মাঝেমধ্যে দুয়েক টান দিই। বন্ধুরা বলে, ‘রাফিন, ধোঁয়া খেলে দুঃখ-কষ্ট দূর হয়।’ আমার কাছে ফালতু বাতচিত মনে হয়। আমি বলি, ‘গাঁজাখোরি কথা কই পেয়েছিস?’ ওরা আমার কথা শুনে শূন্যে ধোঁয়া ছেড়ে হাসে। আকাশে ধোঁয়া কুণ্ডলি পাকাতে পাকাতে উড়ে যায়। দূরে কোথাও। আমি আর আগের মতো বন্ধুদের সঙ্গে খুব একটা মিশি না। মিশতে ইচ্ছা করে না। একা থাকি। একা একা কথা বলি, নিজের সঙ্গে কিংবা প্রকৃতির সঙ্গে।

দেশলাইয়ের বাক্স খুঁজে পাচ্ছি না। বাবা হয়তো নিয়েছেন। মাঝেমধ্যে বাবা এসে দুয়েকটা সিগারেটও নিয়ে যান। বাবা কি জেনে গেছেন যে আমি সিগারেট খাই? ওই ঘটনার পর থেকে বাবাও কেমন যেন নীরব হয়ে গেছেন। মন চাইলে অফিসে যান, না চাইলে নাই। উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টরে বসে চাওয়ালাদের সঙ্গে বসে গল্পগুজব করেন। পত্রিকা পড়ে সময় কাটান। ছুটির দিনগুলোয় বাবা বারান্দায় ইজি চেয়ারে মন খারাপ করে বসে থাকেন। বাবাকে দেখলে আমার বড্ড মন খারাপ হয়। আমার জন্য আমার পরিবার কষ্ট পাবে কেন? আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারি না।

তুলি, আমার ছোট বোন। নিজের ঘরে শব্দ করে পড়ছে। নতুন ম্যাম আসার পর থেকে এই অবস্থা। এই ভরদুপুরে শব্দ করে পড়ার কী আছে, কে জানে। একদিন ম্যামকে কড়া করে দুয়েকটা কথা শুনিয়ে দিতে হবে।
মুখ থেকে সিগারেট নামিয়ে চিৎকার করে ডাকলাম,
‘তুলি, এই তুলি?’
‘ভাইয়া, বলো।’
‘এই ঘরে আয়।’
‘ম্যাম এসেছে। পড়ছি। আমি এখন যেতে পারব না।’
‘কেন?’
‘ম্যাম বাসায় এলে আমার সব কাজ বন্ধ।’
‘তুই আসতে না পারলে তোর ম্যামকে পাঠা। যত্তসব ফাউল মেয়েছেলে কোথাকার। রান্নাঘরে দেশলাই আছে না? নিয়ে আয়।’

আমি রাগ করে সিগারেটটা দরজার দিকে ছুড়ে মারলাম। ম্যাম ঠিক সেই মুহূর্তে দরজায় দাঁড়িয়ে দেশলাই বাড়িয়ে দিলেন।
‘এই নিন দেশলাইয়ের বাক্স।’
আমি বললাম, ‘না। লাগবে না।’
‘আপনি তুলিকে না বললেন, আমাকে দেশলাইয়ের প্যাকেট নিয়ে আসতে!’
‘হ্যাঁ, বলেছি। কিন্তু...’

আমার খুব খারাপ লাগছে। কঠিন কঠিন কথা বলতে ইচ্ছা করছে। মনে মনে অনেক চেষ্টাও করলাম, কিন্তু কোনো কঠিন কথা মুখ দিয়ে বের হলো না।
মেয়েটি ঘরে হেঁটে হেঁটে দেখছে। মনে হচ্ছে তার পূর্বপরিচিত একটা ঘর। যে ঘরে হারানো স্মৃতি ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে, সে তা নিচ্ছে।
‘এটা আপনার ঘর? ঘরটা তো খুব সুন্দর। এত সুন্দর করে কে সাজিয়ে রেখেছে? আপনার বউ? আমাদের ভাবি? উনি কোথায়? একটু কথা বলি। চা-টা খেয়ে আজ চলে যাব। আজ আর তুলিকে পড়াব না।’
‘কি, চলে যাবেন?’
‘একবার বসতেও তো বললেন না। আপনি বিরক্ত হলে উঠি। অন্য একদিন আসব।’
আমি কথার কথা বললাম, ‘আরে না, বসুন। শেফালিকে চা দিতে বলি?’
‘ও ঘুমাচ্ছে পাশের ঘরে। দেখে এলাম। এখন চা খেতে ইচ্ছা করছে না। তার চেয়ে বরং আজ আপনার সঙ্গে একটু গল্পটল্প করি।’
আমি কী বলব, ভেবে পাচ্ছি না। মেয়েটা কী মনে করে যেন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।
পুরো ঘরে চোখ বুলিয়ে বলল, ‘এই ছবি কার? আমার খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। মেয়েটি কে? কী নাম তার?’

শিক্ষার্থী, বাইতুস সালাম এরাবিক ইউনিভার্সিটি, উত্তরা, ঢাকা