মুন্‌শী শেখ জমিরুদ্দীন: উনিশ শতকের বাঙালি সমাজ

মুন্‌শী শেখ জমিরুদ্দীন (১৮৭০-১৯৩৭)ছবি: সংগৃহীত

উনিশ শতকের গোড়া থেকে নদীয়া-যশোরের বিস্তীর্ণ জনপদে একের পর এক গড়ে উঠতে থাকে খ্রিষ্টানপল্লি ও চার্চ। কৃষ্ণনগর, রানাঘাট, মেহেরপুর, চাপড়া, দামুড়হুদার নিম্নবর্গীয় মানুষ দলে দলে চার্চের ছায়ার নিচে আশ্রয় নেন। বাড়তে থাকে খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীর সংখ্যা। এই ধর্মান্তরকরণ যখন হয়েছে, তখন গ্রামকে গ্রাম একসঙ্গে পূর্বপুরুষের ধর্মত্যাগ করে নতুন ধর্মে দীক্ষা নিয়েছেন। স্বধর্ম ত্যাগ ও ধর্মান্তরকরণের এ প্রবণতা বিশ শতকের দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। কিন্তু ধর্মান্তরকরণ কিংবা চার্চ প্রতিষ্ঠার কোনো উদ্যোগ বা প্রবণতা পরিলক্ষিত হয় না মেহেরপুরের সচ্ছল ও স্বনির্ভর গ্রামগুলোতে। মিশনারিরা সচ্ছল ও উচ্চবর্ণের হিন্দু অধ্যুষিত কিংবা মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ গ্রামে প্রচারণা চালায়নি। ওদের নজর ছিল কেবলই যুগী, ধোপা, নিকিরি, বুনো, বাগদী মিস্তিরি, মুর্দফরাস কিংবা লোকধর্ম–অধ্যুষিত অজপাড়াগাঁর দিকে। মিশনারিরা টার্গেট করেছিল ভবরপাড়া, বল্লভপুর, রতনপুর, নিত্যানন্দনপুরের মতো অজপাড়াগাঁগুলো। সচ্ছল ও কুলীন-প্রভাবান্বিত গ্রামগুলো মিশনারির দল টার্গেট করেননি।

কৃষ্ণমোহন কিংবা মধুসূদনের সঙ্গে তুলনা না করেও বলা যায় যে মুন্‌শী শেখ জমিরুদ্দীন ছিলেন উনিশ শতকে বাঙালি মুসলমান সমাজের এক বর্ণাঢ্য ও কৌতূহলোদ্দীপক চরিত্র। তিনি জন্মসূত্রে মুসলমান, পরে দীক্ষিত খ্রিষ্টান, আবারও মুসলমান হন। বাকি জীবন ইসলাম প্রচারে নিজেকে উৎসর্গ করেন।

তবে কলকাতায় যাঁরা ধর্মান্তরিত হন, তাঁরা অধিকাংশই শিক্ষিত ও ব্রাহ্মণসন্তান। ১৮৩২ সালের আগস্ট মাসে হিন্দু কলেজের ছাত্র মহেশচন্দ্র ঘোষ ‘হিন্দুধর্মকে কুসংস্কারের আবর্জনা-স্তূপ মনে করে’ খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষা নেন। ১৮৩২ সালের অক্টোবর মাসে খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষা নেন ব্রাহ্মণসন্তান হিন্দু কলেজের ছাত্র কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। কৃষ্ণমোহনের পর, একই বছরের ডিসেম্বর মাসে খ্রিষ্টান হন অভিজাত ঘরের আদরের সন্তান গোপীনাথ নন্দী। এরপর কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ভাইবোনদের চিরদিনের জন্য ত্যাগ করে খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষাগ্রহণ করেন, তাঁর ধর্মান্তরকরণ কলকাতার পথেঘাটে, হাটবাজারে তর্কবিতর্কের ঝড় তোলে। কেঁপে ওঠে হিন্দুধর্মের ভিত। আবার অনেকের মধ্যে এমন প্রশ্নও জেগে ওঠে, ‘আমার ধর্ম, আমার সমাজ, আমি সংস্কার করব, তার জন্য ধর্ম ত্যাগ করতে হবে কেন? নিজ সমাজ-ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্য সমাজে যাব কেন? সব ধর্মেই তো গোঁড়ামি, কুসংস্কার আর অন্ধত্ব রয়েছে। নিজ ধর্মের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে নতুন সম্প্রদায় গড়ার যুক্তি কোথায়?’ এরপর রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন হাত মিলিয়েছেন ডাফ, ডিয়ালট্রি প্রমুখ পাদ্রিদের সঙ্গে হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করে অর্থডক্স খ্রিষ্টান বানানোর কাজে। তারই চেষ্টায় খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষা নেন প্রভাবশালী উকিল রাজনারায়ণ দত্তের একমাত্র পুত্র মধুসূদন দত্ত। মধুসূদন যেদিন ধর্মান্তরিত হন, সেদিন মিশন রোর চারদিকে, ওল্ড মিশন চার্চের সামনে সেদিন সাহেব, বিবি ও পাদরিদের গাড়ি-ঘোড়ার ভিড়ে যানযট সৃষ্টি হয়। সেদিনের দীক্ষা-উৎসবে উইটনেস হিসেবে এসেছিলেন কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। এ উপলক্ষে মধুসূদনের স্বরচিত সম্মেলক-গানের সুর গির্জার দেওয়াল ভেদ করে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছিল। গানের সুর গির্জার বাইরে দণ্ডায়মান কৌতূহলী দর্শকদেরও ব্যথিত, মথিত ও ভারাক্রান্ত করেছিল। কিন্তু একজন যুক্তিবাদী তরুণের এক ধর্ম ছেড়ে অন্য ধর্মের প্রকোষ্ঠে ঢোকাকে সমর্থন করতে পারছিলেন না কেউই। উনিশ শতকের প্রথমার্ধ ধর্মান্তরকরণের তরঙ্গাভিঘাতে বাঙালি হিন্দু সমাজ ক্ষতবিক্ষত ও লন্ডভন্ড হয়। তবে ধর্মান্তরকরণের এই তরঙ্গ-বিভঙ্গ বাঙালি মুসলমানের মধ্যবিত্ত মানসকে খুব বেশি প্রভাবিত করতে পারেনি। মুসলমান অভিজাতদের মধ্যে কেউই স্বধর্ম ত্যাগ করে অন্য ধর্মে দীক্ষা নেননি। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী ছিলেন মুন্‌শী শেখ জমিরুদ্দীন (১৮৭০-১৯৩৭)।

কৃষ্ণমোহন কিংবা মধুসূদনের সঙ্গে তুলনা না করেও বলা যায় যে মুন্‌শী শেখ জমিরুদ্দীন ছিলেন উনিশ শতকে বাঙালি মুসলমান সমাজের এক বর্ণাঢ্য ও কৌতূহলোদ্দীপক চরিত্র। তিনি জন্মসূত্রে মুসলমান, পরে দীক্ষিত খ্রিষ্টান, আবারও মুসলমান হন। বাকি জীবন ইসলাম প্রচারে নিজেকে উৎসর্গ করেন। ছিলেন বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী। বিচিত্র অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ ছিল তাঁর জীবন। আরবি, গ্রিক, হিব্রু, সংস্কৃত প্রভৃতি ভাষা ও সাহিত্যে সুগভীর জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য ছিল। লেখক দীনেন্দ্রকুমার রায়ের প্রায় সমসাময়িক জমিরুদ্দীন ছিলেন একাধারে ধর্মপ্রচারক, বাগ্মি ও সুসাহিত্যিক এবং মেহেরুল্লাহর ভাবশিষ্য। কাব্যকৃতির স্বীকৃতিস্বরূপ ‘নদীয়া সাহিত্য সভা’ তাঁকে ‘কাব্যবিনোদ’ ও ‘কাব্যনিধি’ উপাধিতে ভূষিত করে। মেহেরপুরের সাহিত্যিকদের সম্পর্কে সুধীর চক্রবর্তী লিখেছেন, ‘বাঙালি মধ্যবিত্ত মানসে মেট্রোপলিটন মন, রেনেসাঁস, এলিটিস্ট অনুষঙ্গ, ইংরেজিবিদ্যা ও প্রতীচ্যের চিন্তানায়কদের ভাবনার সংগ্রাম বিষয়ে পাতার পর পাতা ভরে ওঠে উচ্ছ্বাসে-গর্বে। কিন্তু সেই ঝোঁকে অবজ্ঞাত থেকে যায় মেহেরপুরের গাঁড়াডোব গ্রামের মুন্‌শী শেখ জমিরুদ্দীনদের জীবন-সংগ্রাম, কুমারখালির কাঙাল হরিনাথ মজুমদারদের দুরূহ সাংবাদিকতার ব্রত পালনের নিষ্ঠা, মেহেরপুরের দীনেন্দ্রকুমার রায়ের অনন্যব্রত সাহিত্যনিষ্ঠার সততা।’ দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের বিদ্যাগর্বী শিক্ষিত সমাজ এবং নগরমনস্ক বিদ্যাজীবীরা দীনেন্দ্রকুমার কিংবা জমিরুদ্দীনদের সৃজনপ্রতিভা ও সাহিত্যকর্মকে খুব একটা আমল দেননি। এ কারণে লালন, কাঙাল হরিনাথ, মীর মশাররফ থেকে দীনেন্দ্রকুমার-জমিরুদ্দীন পর্যন্ত গ্রামীণ মনীষীরা প্রায় সবাই অবজ্ঞাত ও অন্ত্যজ থেকে গেছেন। অথচ ‘বাংলার লোকমানসের দেওয়ালি উৎসবে’ এদের অবদানও অপরিসীম। বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা যে সত্যিকার অর্থেই অন্তঃসারশূন্য বিচ্ছিন্নতাবাদী তা অমলেন্দু দে তাঁর ‘বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও বিচ্ছিন্নতাবাদ’ (১৯৭৪) গ্রন্থে বারবার উল্লেখ করেছেন।

জমিরুদ্দীনের জন্ম মেহেরপুর শহর থেকে আট কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত গাংনী থানার গাড়াডোব-বাহাদুরপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে, ১৮৭০ সালে। পিতা শেখ আমিরুদ্দিন ছিলেন ধর্মপ্রাণ মুসলমান। পারিবারিক ঐতিহ্য অনুসারে পিতা তার পুত্রকে সহি মুসলমান হিসেবে গড়ে তোলার জন্য পাঁচ বছর বয়সে মক্তবে ভর্তি করে দেন এবং নামাজ-রোজায় নিষ্ঠাবান করে তোলেন। এরপর বাংলা শেখার জন্য ভর্তি হন গ্রামের পাঠশালার গুরুমশাইয়ের নিকট এবং ইংরেজিতে পারদর্শী হওয়ার জন্য ভর্তি হন আমঝুপি খ্রিষ্টান স্কুলে। পরে মেহেরপুর ইংরেজি উচ্চবিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। তারপর কৃষ্ণনগর নর্মাল স্কুলে পড়াশোনা করে মেধাবী ছাত্র হিসেবে কৃতিত্বের পরিচয় দেন। কৃতী ছাত্র হিসেবে মিশনারিরা তাঁকে মিশনের কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি চেয়েছিলেন উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে। একপর্যায়ে মিশনারিদের সান্নিধ্য লাভ করে খ্রিষ্টধর্মের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। চাপড়ার গির্জায় পাদরি সলিভান সাহেবের নিকট ১৮৮৭ সালে ২৫ ডিসেম্বর, মাত্র ১৭ বছর বয়সে জমিরুদ্দীন খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষা নেন। ১৮৯১ সালে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য তাঁকে এলাহাবাদ সেন্ট পলস ডিভিনিটি কলেজে পাঠানো হয়। সেখানে হিন্দি ও উর্দু ভাষায় ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়ন করেন। আরবি, সংস্কৃত ও গ্রিকভাষা শেখেন। সেই সঙ্গে শেখেন ধর্মবিষয়ক বক্তৃতা প্রদান এবং হাটবাজারে খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের কৌশল। এলাহাবাদ থেকে কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করে পাঠ নেন খ্রিষ্টধর্মতত্ত্ব এবং সংস্কৃত, আরবি, গ্রিক, হিব্রু সাহিত্য ও ব্যাকরণের ওপর। তাঁর ইংরেজি ভাষাজ্ঞান ছিল অসাধারণ। সারা জীবন তিনি জ্ঞানের রাজ্যে কাটিয়ে দেন। তাঁর কাজ ছিল নদীয়ার গ্রামে গ্রামে খ্রিষ্টধর্মের প্রচার ও মুসলমানদের খ্রিষ্টধর্মের পতাকার নিচে টেনে আনা। বিভিন্ন ধর্মসভায় দাঁড়িয়ে তিনি বলতেন, ‘আমি একজন নতুন খ্রিষ্টান, পূর্বে মুসলমান ছিলাম। মুসলমান ধর্মে পাপের মুক্তি না পেয়ে খ্রিষ্টান ধর্মে প্রভু যিশুর নামে বাপ্তাইজ হয়েছি, আমি পূর্বে পাঁচবার নামাজ পড়তাম, রমযান মাসে রোযা রাখতাম, কিন্তু তাতে কোনো উপকার পাইনি। তোমরা সকলে প্রভু যিশুকে বিশ্বাস কর, মুক্তি পাবে।’

হঠাৎ জন জমিরুদ্দীনের ধর্মসম্পর্কিত ধারণা ও জীবনবোধ বদলে যায়। যিনি একদিন সেকালের বহুমান্য ইসলাম প্রচারক মুন্‌শী মেহেরুল্লাহর বিরদ্ধে কলমযুদ্ধে নেমে, প্রশ্ন ছুড়ে দেন, ‘আসল কোরান কোথায়’ বলে, তিনিই আবার ফিরে আসেন ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে।

জন জমিরুদ্দীনকে নদীয়ার বিভিন্ন গ্রামে ধর্ম প্রচারের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। দেবগ্রাম, নিজলাঘাট, পলাশী, বড়োয়ার গ্রামে প্রচারের পর করিমপুর থানার শিকারপুর গ্রামে মিশন স্থাপিত হলে সেখানে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পাদরি লিংকিবারের সঙ্গে আল্লার দরগা, মিরপুর, ভেড়ামারা, সোনাইকুণ্ডী, মহিষডেরা গ্রামে তিনি খ্রিষ্টধর্ম প্রচারে নামেন। এছাড়াও মুরুটিয়ার মাধবপুর, বেলেডাঙ্গা, আউদিয়া, কাথুলি গ্রামে প্রচার কাজ পরিচালনা করেন।

জন জমিরুদ্দীন ছিলেন অসাধারণ বক্তা। মানুষকে কথা বলে সম্মোহিত করার অলৌকিক ক্ষমতা তাঁর ছিল। বক্তৃতায় যুক্তিবুদ্ধি ও শাস্ত্রজ্ঞান প্রয়োগ করে মানুষকে নিজের মতের দিকে নিয়ে আসতে পারতেন। নদীয়া জেলার খ্রিষ্টান মিশনারির জন্য তিনি অদ্বিতীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। পদ্মার তীরবর্তী অনেক গ্রামে প্রচার করতেন, শীতকালে তাঁবুতে অবস্থান নিয়ে আর বর্ষাকালে নৌকায়। কেবল বক্তৃতা করে নয়, লেখালেখির মাধ্যমেও খ্রিষ্টধর্ম প্রচার করেন। তিনি লিখেছেন, ‘এ সময়ে আমি মুসলমান ধর্মের বিরুদ্ধে তীব্র লিখনী ধারণ করে অনেক মুসলমান তনয়কে খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত করি। আর আমি যে কেবল লিখনী চালনা করিয়া অনেক লোককে খ্রিষ্টীয় ধর্মে দীক্ষিত করিয়াছি তাহা নহে, প্রচার দ্বারাও অনেক হিন্দু-মুসলমানকে খ্রিষ্টীয় ধর্মে দীক্ষিত করিয়াছিলাম।’

কিন্তু হঠাৎ জন জমিরুদ্দীনের ধর্মসম্পর্কিত ধারণা ও জীবনবোধ বদলে যায়। যিনি একদিন সেকালের বহুমান্য ইসলাম প্রচারক মুন্‌শী মেহেরুল্লাহর বিরদ্ধে কলমযুদ্ধে নেমে, প্রশ্ন ছুড়ে দেন, ‘আসল কোরান কোথায়’ বলে, তিনিই আবার ফিরে আসেন ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে। মুন্‌শী মেহেরুল্লার লেখা ও তাঁর সান্নিধ্য জন জমিরকে বদলে দিল, যেন তাঁর নবজন্ম হলো। মেহেরুল্লাহ রচিত ‘আসল কোরান সর্বত্র’ নিবন্ধটি পড়ে জন জমিরুদ্দীনের সংশয়, সন্দেহ ও মনের ধোঁকা কেটে গেল। এরপর মেহেরুল্লার সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং ইসলাম ধর্মে ফিরে আসেন।

কলকাতার আলবার্ট হলে ব্রাহ্মসমাজের নগেন্দ্র মিত্রের ধর্মবিষয়ক বক্তৃতা শুনে ব্রাহ্মধর্মের প্রতি কিছুদিনের জন্য অনুরাগী হন, ব্রাহ্মধর্ম তাঁর বেশ ভালো লাগত। ভালো লাগত রামমোহন ও কেশবচন্দ্রের লেখা। তিনি নিরাকার পরমব্রহ্মের সঙ্গে ইসলামের তাওহিদবাদের মিল খুঁজে পান। কিন্তু সব হিসাব-নিকাশ পালটে যায়, মেহেরুল্লাহ, রেয়াজউদ্দিন আহমদ ও শেখ আবদুর রহিমের ইসলাম–সম্পর্কিত লেখা পড়ে। খ্রিষ্টধর্ম ও মিশনারির কার্যক্রম ত্যাগ করে নিজ বাড়িতে ফিরে এসে আত্মীয়স্বজনের সামনে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন। এর পরের ইতিহাস আরও চাঞ্চল্যকর, আরও কৌতূহলোদ্দীপক। মেহেরুল্লাহ ও জমিরুদ্দীনের অপ্রতিহত প্রচারে মুসলমান সমাজের ধর্মান্তরকরণ প্রক্রিয়া প্রতিহত হয়। খ্রিষ্টান পাদরিরা পিছু হটে। বন্ধ হয় খ্রিষ্টধর্মের সম্মুখযাত্রা। ধর্মযুদ্ধ কিংবা সর্বশক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে এদেশে খ্রিষ্টধর্মকে স্থায়ী আসন দেবার যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, তা সফল হয় না। তাঁর বক্তৃতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মসজিদ, মাদ্রাসা ও মক্তব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিশ শতকের ত্রিশের দশক পর্যন্ত বাঙালি মুসলমান সমাজে মুন্‌শী জমিরুদ্দীন ছিলেন এক অনন্য ও অদ্বিতীয় ব্যক্তিত্ব। অথচ তাঁর জীবন, কর্মতৎপরতা ও লেখালেখি নিয়ে তেমন পর্যালোচনা হয় না। জমিরুদ্দীনের জীবন ও কর্মের ওপর গবেষণাও তেমন হয়নি। উনিশ শতকের সমাজ বাস্তবতা, এর ঘাত-প্রতিঘাত ও দলে দলে খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষা গ্রহণ যদি আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়, তাহলে অবশ্যই মুন্‌শী শেখ জমিরুদ্দীনের বহুবর্ণিল জীবনগাথা, তাঁর প্রতিবাদী-কর্মতৎপরতা ও সাহিত্যকর্ম সেই ইতিহাসের একটি হিরণ্ময় পর্ব।

আবদুল্লাহ আল আমিন: গবেষক ও প্রাবন্ধিক এবং সহযোগী অধ্যাপক, মেহেরপুর সরকারি কলেজ