আকাশ এখন ঝাঁট দেওয়া উঠোনের মতো পরিষ্কার। কলেজের মাঠে জনমানবের বিস্তৃত ঢেউ। কেউ এসেছে পুরো পরিবার নিয়ে, কেউ আবার প্রিয় মানুষের সঙ্গে। সবার গন্তব্য মুক্তমঞ্চের গোলচত্বর। এর পাশেই আকাশছোঁয়ার প্রত্যয় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আটতলাবিশিষ্ট ওয়াচ টাওয়ার। সেই টাওয়ারের নিচে প্রতিদিন বিকেলে তৈরি হয়ে অসংখ্য যুগলের জটলা। সবাই যে কেবল টাওয়ারের নিচেই জড়ো হয়, ব্যাপারটি সে রকম নয়। অনেকে সিঁড়ি ভেঙে উঠে যায় সবচেয়ে ওপরের তলায়। বিদিতা আজ দূরের জিনিস দেখবে না। নিচতলাতেই দাঁড়িয়ে আছে। অপেক্ষা করছে মাহমুদের জন্য।
আজই শেষ দেখা মাহমুদ-বিদিতার। এরপর বিদিতার চলে যাওয়ার দিন। বিপন্ন মাহমুদ কেমন করে এক সমুদ্র দুঃখকে আঁজলা ভরে পান করবে, তা-ই এখন ভাবছে বিদিতা। কী সুন্দর একটি স্বপ্নজমিন ছিল তাদের; প্রণয় সুধায় ভরে থাকত সে জমিন! অথচ আজ সেই জমিন ঘিরেই রচিত হতে যাচ্ছে এক কবরখানা। ‘আহ্, মাহমুদের একটা চাকরি হয়ে গেলেই হতো’—বিদিতার চোখে জল। ওড়না দিয়ে সেই জলকে মুছতে গেলেই অশ্রুতে-কাজলে মাখামাখি হয়।
বিদিতার কাজলে আঁকা চোখ দুটো মাহমুদের খুব প্রিয়। শেষবেলায় এমন বিচ্ছিরি চোখ সে দেখাতে চায় না। ব্যাগ থেকে আয়না বের করে। টিস্যু দিয়ে চোখ মুছে আবার তাতে কাজল আঁকে। কপালের ঠিক মাঝখানে সাঁটা লাল টিপটার অবস্থান ঠিক করে নেয় বিদিতা। ঠোঁটযুগলে ঘষে নেয় আরেকপ্রস্ত গোলাপি লিপগ্লস। মাহমুদ প্রায়ই বিদিতিকে বলে, ‘তোমার ঈষৎ গোলাপি ঠোঁটে কী যেন মধুমাখা।’ এমন প্রশংসায় বিদিতার গালের রং বদলে যায়। লজ্জারাঙা লাল আভা গালে গালে ছড়িয়ে যায়। আজও কি এমন হবে? এমন করে কি আজও মাহমুদ বলবে?—টাওয়ারটার উত্তর পাশেই লেক। সেই লেকের জলে ভাসতে থাকা অজস্র অতিথি পাখির ঝাঁক। সেদিকে আনমনে তাকিয়ে সে ভাবে।
মাহমুদ প্রায়ই বিদিতার চোখের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। বিদিতা জিজ্ঞাসা করে, ‘কী চাই তোমার?’ মাহমুদ স্মিত হেসে বলে, ‘এমন একজোড়া চোখ হলেই চলবে।’ আনন্দ-বেদনা, মান-অভিমানের কাব্য করে চলতে থাকা সম্পর্ক নামক ট্রেনটা হুট করে থেমে যাবে কে ভেবেছিল? বিদিতা কি মাহমুদের হাত ধরে পালাতে পারত না? তবে কেন সে পালাচ্ছে না? পরিবার, মা–বাবার সম্ভ্রমের কাছে নিজের ব্যক্তিসুখ কি এতই তুচ্ছ? বিদিতার এত সাহস হয় না। সে তার ব্যক্তিগত সুখ বিসর্জন দিতে রাজি।
মাহমুদও আটকায় না। বরং তার বিরহে ভরা উদাস কণ্ঠ, ‘যাও, আমি বাধা দেব না।’ সম্পর্কের বয়স তিন বছর হলেও পরিচয়, চেনাজানার বয়স তো বছর দশেকের কম হবে না। বিদিতা আগেই জানত, মাহমুদ এমন উদাস-অভিমানী। বিদিতার নিখাঁদ প্রেম ও বন্ধুত্ব কি তার সব উদাসীনতা ভাঙাতে পারে না? মাহমুদ কেন পথ আটকে অধিকার প্রতিষ্ঠা করে বলে না, ‘বিদিতা, তুমি থেকে যাও’।
আছড়ে পড়া ঢেউয়ের মতো মানুষের ঢলে মুক্তমঞ্চের তল্লাট সয়লাব। অজস্র মানুষের ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসা মাহমুদকে দূর থেকেই শনাক্ত করা যায়। পরনের উজ্জ্বল কমলা রঙের টি-শার্টে আঁকা মুক্ত পায়রার রেখাগুলো সাদা প্রিন্টের মধ্যেই আটকে আছে। মুদ্রিত পায়রাদের দল বাতাসে আর উড়তে পারছে না। আজ উড়বে বোধহয়—বিধ্বস্ত বিদিতার মন দার্শনিক।
ভিড়ের মধ্যে বসার কোনো জায়গা মেলে না। অগত্যা আরেক যুগলের সঙ্গে বেঞ্চি ভাগাভাগি করতে হয়। হটপট থেকে বের করে আনা সদ্য রান্না করা নুডলস থেকে এখনো ধোঁয়া উড়ছে, মসলার ঘ্রাণ আশপাশের মানুষকে ভালো করেই সুড়সুড়ি দিচ্ছে। টনক নড়াতে পারছে কেবল মাহমুদের জিভকেই। এতকাল যে সুস্বাদু নুডলসে সে রসনাবিলাস করে এসেছে, সেই নুডলস আজ কেন এত বিস্বাদের! মাহমুদ ভেবে পায় না।
সে দেখে, বিদিতার অনামিকায় রিংটা বেশ ঝিকমিক করছে। মাহমুদ আলতো করে সেই রিংটাতে ছোঁয়। কী ভেবে আবার হাতটা ফিরিয়ে আনে। বিরহে, বেদনায় বিদিতার চোখ বিস্ফোরিত হওয়ার জোগাড়। তবু সে কাঁদে না। কেন কাঁদে না, কারণ তাঁর জানা নেই। মাহমুদের আচমকাই কান্না পায়।
বিদিতার বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ার পরই মাহমুদ সিদ্ধান্ত নেয়—এই শহরে আর একমুহূর্তও নয়। যে শহরে এত এত স্মৃতির বিমূর্ত মূর্তি আঁকা, সে শহর তাঁর জন্য বেদনার বিরানভূমি হতে পারে। এমন আশঙ্কাতেই শহর ছেড়ে পালানোর পরিকল্পনা।
পুরুষদের কাঁদতে নেই জেনেই মাহমুদ শামুকের মতো গুটিয়ে নেয় নিজেকে। সন্ধ্যায় উড়ে আসে অনেক জ্বালাধরা পোকা। এসবের একটি চোখে পড়লে আর রক্ষে নেই। তীব্র জ্বালা হয় চোখে। এমনই পোকাপড়া চোখ কচলানোর মতো করে দুহাতের পিঠ দিয়ে ঢলতে থাকে চোখ। বিদিতা আলতো করে কাঁধে হাত রাখে। নিজেকে সংবরণ করতে পারছে সে। বর্ষার স্রোতে পাড়ভাঙা ঢেউয়ের মতোই ভাঙছে কেবল বুকের ভেতরটা। ধসে যাওয়া বুকের ভেতরকার চাপাকান্না মুহূর্তেই সশব্দে ফেটে বেরুলে সে মাহমুদকে জড়িয়ে ধরে। তখন বিদিতার মনে হয়, আয়োজন করে সব হলেও অন্তত বিচ্ছেদপর্বটা আয়োজন করে হয় না।
হাতে হাত রেখে দুজনে ওয়াকওয়ে ধরে হাঁটতে থাকে। পৌরসভার ল্যাম্পপোস্টগুলো জ্বলে ওঠে মাথার ওপর। তার ওপরে উঁকি দিচ্ছে এক আধখানা চাঁদ।