বুকের ভেতর লুকায়িত ঈদ

ছোটবেলায় মামার বাড়িতে থাকতাম। একটাই মামা। এলাকায় নামকরা ব্যক্তি। শিক্ষাদীক্ষার পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবেও বেশ সচ্ছল। চরকাটিহারী গ্রামে তখন ১০ হাজার লোকের বাস। এত বড় গ্রামে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি সরকারি কলেজের অধ্যাপক। সেই সময়ের কথা বলছি, যখন জেলা শহর ছাড়া কোনো সরকারি কলেজ ছিল না। এলাকায় ওনার আলাদা সম্মান ও দাপট ছিল। সামাজিক কাজকর্মে অগ্রণী ভূমিকা রাখতেন। দানশীলতায় তাঁর জুড়ি ছিল না। তিনি ছিলেন গ্রামের লোকজনের মধ্যমণি। বিপদে–আপদে সবার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেন।

আম্মা ছিলেন মামার সবচেয়ে আদরের ছোট বোন। শুনেছি, আম্মা শাখচূঁড়া উচ্চবিদ্যালয়ে মাধ্যমিক ক্লাসে পড়াকালীন আব্বার সঙ্গে পরিচয় হয়। পরিচয় থেকে আস্তে আস্তে প্রেম! প্রেম থেকে বিয়ে! তখন আব্বার আর্থিক অবস্থা মোটেও ভালো ছিল না। নুন আনতে পান্তা ফুরায়, এমন অবস্থা! মামা বিয়ে দিতে রাজি ছিলেন না। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে মা আলটিমেটাম দিয়ে বসলেন, পছন্দের মানুষের কাছে বিয়ে না দিলে তিনি আত্মহত্যা করবেন! অবস্থা বেগতিক দেখে মামা রাজি হতে বাধ্য হলেন।

আম্মা–আব্বার বিয়ের এক দশকের ভেতরে আমাদের পাঁচ ভাইবোনের জন্ম। সংসারের আর্থিক দুরবস্থা আরও বেড়ে গেল। এক বেলা খেলে আরেক বেলা কপালে ভাত জোটে না। পরনের প্যান্ট থাকলে জামা থাকে না। তেলের অভাবে বোন তিনটির মাথার চুল ঝট বেঁধে থাকে। সংসারের এমন ক্রান্তিলগ্নে আম্মা বুদ্ধি করে আমাকে পাঠিয়ে দিলেন মামার বাড়িতে। মামার টাকাপয়সার অভাব নেই।

নতুন জায়গায় গিয়ে প্রথম প্রথম খারাপ লাগলেও মামির আন্তরিক ব্যবহারে আমার সেই খারাপ লাগা দ্রুতই কেটে গেল। মামা-মামি, মামাতো ভাইবোন এবং বাড়ির আশপাশের লোকজনের স্নেহ–ভালোবাসায় সহজেই সবার আপনজন হয়ে উঠলাম।

মামাদের অনেক বড় বাড়ি। বাড়ির সামনেই প্রাইমারি স্কুল, হাইস্কুল, মাদ্রাসা, মসজিদ, খেলার মাঠ, ঈদগাহ, দোকানপাট। অধিকাংশ লোকই শিক্ষিত, সরকারি চাকরিজীবী, শহরের বাসিন্দা। কথায় আছে, মোড়ল বাড়ির বিড়ালও নাকি মোড়লের মর্যাদা পায়! আমার বেলাতেও তাই ঘটল। বাড়ির সামনের প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হয়ে গেলাম। অধ্যাপকের ভাগনে বলে শিক্ষকেরা আমার প্রতি একটু বেশিই গুরুত্ব দিলেন। ক্রমে স্কুলের সেরা ছাত্র হয়ে উঠলাম।

মামার বাড়িতে প্রথম ঈদ
আমাদের অভাবের সংসারে ঈদ যে আদতে কী জিনিস, তা কোনো দিনই বুঝিনি। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ অভাবী। নতুন পোশাক কেনার সামর্থ্য নেই। স্বল্প মূল্যে শহরের বাজার থেকে পুরোনো পোশাক কিনে আনে। আব্বাও আমাদের জন্য পুরোনো জামাকাপড় কিনে আনতেন। তাতেই খুশি থাকতাম।

প্রথম যেবার মামার বাড়িতে ঈদ করি, সেদিন সমবয়সী ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে নদীতে গেলাম গোসল করতে। অনেকের হাতেই নতুন জামা, প্যান্ট, শার্ট। আমার পুরোনো একটা খয়েরি রঙের শার্ট ছিল। মামি সেটা ধুয়ে রেখেছিলেন। গোসল সেরে সেই জামাটাই পরলাম। সহপাঠী গোলাপ সাদার ভেতর ছোপ ছোপ সবুজ রঙের নতুন একটা জামা পরে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কিরে চঞ্চল, তোর নতুন জামা নেই?’ এই প্রশ্ন শুনে আমার চোখেমুখে লজ্জার আভা ছড়িয়ে পড়ল! জীবনে প্রথম অনুভব করলাম, ঈদ এলে নতুন জামা পরে ঈদগাহে যেতে হয়।

আমার ফ্যাকাশে মুখ দেখে মামি আমাকে মায়ের মতো বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘মন খারাপ কইরেন না, আমাদের ভুল হয়ে গেছে। কালই আপনার জন্য নতুন একটা জামা কিনে আনতে বলব।’

মামি আমাকে নিয়ে গেলেন খাবারের টেবিলে। আহা! টেবিলভর্তি খাবার আর খাবার; সেমাই, পায়েস, সাগুদানার ক্ষীর, চালের রুটি, নুডলস, মুচমুচে কারুকাজময় পিঠাভাজা, পোলাও মাংস আর কত কী! পায়েস আর ক্ষীর খেয়েই পেট যে আমার ঢোল! এমন মুখরোচক খাবার যে আর জীবনেও খাইনি! আমাকে এভাবে খেতে দেখে মামি কেবল মুখ টিপে হাসলেন। পিঠে মমতামাখা হাত বুলিয়ে বললেন, ‘ক্ষিদে পেলেই এসে পোলাও মাংস খেয়ে যায়েন।’

আমাদের এলাকায় মামি সম্পর্কীয় নারীরা ভাগনেদের আপনি করেই ডাকে। এটাই আমাদের সামাজিক রীতি। কিন্তু মামি ছিল আমার কাছে দ্বিতীয় মা। আসল মা কাছে না থাকায়, মামি আমাকে মায়ের স্নেহে বড় করেছেন। তিনি মায়ের শূন্যতা কখনোই বুঝতে দেননি। দুর্ভাগা যে আমার দুটি মা-ই পৃথিবী ছেড়ে অদৃশ্যে চলে গেছেন।

এখনো ঈদ আসে। আমার ছেলেমেয়ের জন্য নতুন জামা কিনে আনি। কত কী রান্না হয়! ছেলেমেয়েদের আনন্দ উল্লাস দেখে খুব ভালো লাগে। শুধু আমাদের ছোটবেলার ঈদের কথা মনে হলে চোখ গড়িয়ে জল পড়ে। মায়ের জন্য, মামির জন্য ভেতরে ভেতরে ফুঁপিয়ে কান্না করি। যদিও সেই কান্না কেউ দেখতে পায় না।

টাওয়াইল, খারুয়া, নান্দাইল, ময়মনসিংহ