শাটল ট্রেন: স্মৃতির গহিন বনে পথচলা

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেনফাইল ছবি

এক.
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম উচ্চারণ করলেই মনের ভেতর বেজে ওঠে এক পরিচিত ধ্বনি—শাটল ট্রেনের ছুটে চলার শব্দ। পাহাড়ি সবুজে মোড়ানো পথের বুকে ছুটে চলা এই ট্রেন যেন এক চলমান জীবনদর্শন। জানালায় বসে যে দৃশ্য দেখা যায়, তা শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্য নয়, জীবনের অমলিন কাব্য।

প্রথম যেদিন শাটল ট্রেনের ভেতরে পা রাখি, মনে হয়েছিল আমি যেন কোনো স্বপ্নের রাজ্যে প্রবেশ করছি। সদ্য ভর্তি হওয়া একজন প্রথম বর্ষের ছাত্র হিসেবে তখনো জানতাম না, এই শাটল ট্রেন আমার জীবনের গল্পের কতটুকু জায়গা দখল করে নেবে। ট্রেনের ভেতর একরকম জাদু কাজ করত। কারও মুখে গান, কারও হাসিঠাট্টা, আর কারও চোখে নীরব স্বপ্নের ছায়া।

সেই প্রথম দিনের সকালটাকে এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে। ট্রেন তখন স্টেশন ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমি জানালার পাশে বসেছিলাম, হাতের মুঠোয় বই। বইয়ের পাতায় মনোযোগ নেই, ট্রেনের ভেতরের কোলাহল আমাকে গ্রাস করে নিয়েছে। হঠাৎ দেখলাম এক ছেলেকে, তার হাতে গিটার। সে গুনগুন করে গান ধরল—‘এই পথ যদি না শেষ হয়…’। একমুহূর্তের জন্য মনে হলো পুরো ট্রেন যেন থমকে গেল। সবাই চুপচাপ হয়ে তার গান শুনতে লাগল। সেই ছেলেটির কণ্ঠে জাদু ছিল। সেই দিনের সেই গান আজও আমার মনে গেঁথে আছে।

দুই.
শাটল ট্রেন মানেই গল্প, গান, আর একধরনের অকৃত্রিম মুক্তি। ট্রেনের প্রত্যেক যাত্রীই একেকটি চরিত্র। কেউ চুপচাপ, কারও চোখে দুষ্টুমি, আবার কেউ প্রতিবাদে উত্তাল। কখনো গাঢ় সিলেটি টানে বন্ধুদের আড্ডা, কখনো ক্লান্ত চোখে পড়ার নোটগুলো ঝালিয়ে নেওয়া—সবই চলত একসঙ্গে।

একদিন বিকেলে ট্রেনে চড়েছিলাম। ক্লাস শেষে শরীরে ক্লান্তি। ট্রেনের ভেতরে তখন গুনগুন করে কেউ একজন রবীন্দ্রসংগীত গাইছিল। জানালার পাশে বসে সেই গান শুনতে শুনতে চোখ বুজে ফেলেছিলাম। ট্রেনের ছন্দময় দুলুনি, জানালার বাইরের পাহাড়ি বাতাস আর সেই মিষ্টি গানের সুর মিলেমিশে আমাকে যেন অন্য এক জগতে নিয়ে গিয়েছিল।

তিন.
শাটল ট্রেন শুধু যাতায়াতের বাহন নয়, এটি অজস্র গল্পের জন্মস্থান। সেদিনের সেই গান গাওয়া ছেলেটিই পরবর্তী সময়ে আমার খুব কাছের বন্ধু হয়ে উঠল। তার নাম সুমন। সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি সংসদের সদস্য। একদিন শাটলে বসেই আমরা একসঙ্গে কবিতা নিয়ে আলোচনা করছিলাম। হঠাৎ ট্রেনের ঝাঁকুনিতে তার হাতে থাকা কাগজের টুকরা পড়ে যায়। কাগজের ওপরে কয়েকটি লাইন লেখা ছিল—
‘এই রেললাইনের পথ ধরে
স্বপ্ন ছুটে যায় দূর বহুদূর,
তুমি কি জানো, সেই স্বপ্নগুলো
তোমার জানালার পাশে বসে আছে চুপচাপ!’

আমার চোখ ছুঁয়ে গেল শব্দগুলো। বললাম, ‘এটা তো অসাধারণ!’ সুমন হাসল। বলল, ‘আমাদের এই শাটল ট্রেন নিজেই একটা কবিতা, জানো?’ আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম। তখন থেকেই শাটল ট্রেনের প্রতি আমার ভালোবাসা আরও গভীর হলো।

চার.
শাটল ট্রেনের আরেকটি দিক হলো উত্তাল রাজনীতি। এটি আন্দোলনের পীঠস্থান। মনে আছে, একদিন সন্ধ্যার ট্রেনে বাড়ি ফিরছিলাম। ট্রেনের ভেতর হঠাৎ একদল ছেলেমেয়ে গলা ছেড়ে স্লোগান দিতে শুরু করল। তারা গান আর স্লোগানে এক অন্য রকম উদ্দীপনা ছড়িয়ে দিল। আমিও অবচেতনভাবে তাদের সঙ্গে গলা মেলালাম। ট্রেনটি যেন সেদিন কেবল লোহা আর ইঞ্জিন নয়; বরং এক জীবন্ত প্রতিবাদের মঞ্চ হয়ে উঠেছিল।

তবে শাটল ট্রেন শুধু রাজনীতি নয়, প্রেমের সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এর প্রতিটি কোনায় লুকিয়ে আছে ভালোবাসার নীরব গল্প। ট্রেনের কামরায় কোনো এক কোণে চুপচাপ বসে থাকা এক জুটি, জানালার বাইরের দিকে তাকিয়ে হাতে হাত রাখা কিংবা চিঠি আদান-প্রদান—এসব দৃশ্য খুব সাধারণ। একদিন দেখেছিলাম, এক ছেলে এক মেয়ের হাতে কাগজের টুকরা দিচ্ছে। মেয়েটি প্রথমে না নিতে চাইলেও শেষে একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে নিয়ে নিল। সেই হাসিতে যেন পাহাড়ের সবুজ আর ট্রেনের ছন্দ মিলেমিশে নতুন এক কবিতা রচনা করেছিল।

পাঁচ.
শাটল ট্রেনের প্রতিটি মুহূর্তই স্মৃতিতে বাঁধাই করার মতো। কিন্তু এক শীতের সকালে ঘটে যাওয়া এক ঘটনা আজও আমাকে গভীরভাবে ছুঁয়ে যায়। সেদিন ছিল আমাদের শেষ সেমিস্টারের পরীক্ষা। ট্রেনের জানালা দিয়ে কুয়াশার পর্দার ওপারে গাছপালার ছায়া ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল। ভেতরে গায়ে জড়ানো চাদরের তলায় আমরা ঠান্ডায় কাঁপছিলাম, কারও মুখে কোনো বিরক্তি নেই। সবাই মিলে গলা ছেড়ে গান ধরেছিল—‘আমরা করব জয়’। সেই মুহূর্তে মনে হয়েছিল, শাটল ট্রেন এক চলমান আত্মার নাম।

বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলো শেষ হয়ে যাওয়ার পর একদিন অফিসের কাজ শেষে বাসায় ফিরছিলাম। ট্রেনের হুইসেলের শব্দ শুনে হঠাৎ শাটল ট্রেনের কথা মনে পড়ে গেল। চোখ বন্ধ করতেই ভেসে উঠল সেই সবুজ পাহাড়ের মধ্যে ছুটে চলা রঙিন শাটল, ভেতরে আমাদের প্রাণবন্ত কোলাহল। মনে হলো, আমি যেন এখনো সেই জানালার ধারে বসে আছি।

আজও যখন কোথাও রেললাইন দেখি, মনে হয় শাটল ট্রেন আমাকে ডাকছে। প্রকৃতির বুকে ছুটে চলা সেই ট্রেন যেন আমাকে জীবনকে আবার নতুন করে দেখার আহ্বান জানায়। শাটল ট্রেন শুধু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি নয়, এটি আমার জীবনের একটি অধ্যায়, যা এক জীবনের জন্য মনে গেঁথে থাকবে।

বন্ধু, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা