শান্ত, নীরব একটা শহর। রাস্তার ধারে দেখা যায় কিছু কিছু গালিচার দোকান। ফুটপাতে সাজিয়ে রেখেছে তুর্কি নারীদের হাতে বোনা শাহি গালিচা।
ইস্তাম্বুল সিটির একদম মাঝামাঝি বসে আছি। ভাবছি এ শহরের মানুষরা কী খায়, কী পরিধান করে, আর কী নিয়ে এত ব্যস্ত থাকে। বসফরাসের ধারে এসে মনে হলো, এরা আসলে কিছু খায় না—জলের হাওয়াতেই এদের পেট ভরে যায়। আর পড়াশোনা? তা অবশ্য এরা করে; তবে মেট্রোতে বসে। আমার নাক বরাবর বসে থাকা তুর্কি লোকটাকে দেখে মনে হলো দস্তয়েভস্কিকে একেবারে গিলেই ফেলবে মাত্র তিনটা স্টপে।
বসফরাসের জলে কোনো ঢেউ নেই, ঢেউ আছে মানুষের মনে। প্রেমিক-প্রেমিকারা হাত ধরাধরি করে বসে থাকে এখানে, মনের মধ্যে ঢেউ খেলে। এইতো ঢেউ। জলের কি আর ঢেউ লাগে? আমার ধারণা আদীকাল থেকেই এখানে প্রেমিক-প্রেমিকারা যাতায়াত করে আসছে। কত পাশা যে এখানে এসেছে শাহজাদির হাতে চুমু খেতে কে জানে! এই জলের মধ্যে একটা মিঠা হাওয়া আছে। যদিও এটা চেখে দেখা হয়নি, তবে উপলব্ধি করা গেছে। মিঠা হাওয়া আর মিঠা প্রেম—এই দুই-ই এখানে চিরকাল থেকে যাবে আসলে। হায়, প্রেম তো ঢেউয়ের মতোই হয়—আসে যায়, আসে যায়।
আমি উঠলাম একটা ফেরিতে। ফেরির নাম ‘সেহির হাটলার’—মানে শহরের লাইন। অথচ এই লাইন ধরা মানেই হইহুল্লোড় আর ক্রাউডজনিত শহর যাওয়ার আরাম। কেননা এর একপাশে ইউরোপ, অন্যপাশে এশিয়া। ইউরোপের দিকটায় হইহুল্লোড় বেশি। বসফরাসকে যারা নদী ভাবে, তারা মূলত ভুলের সাগরে সাঁতার কাটে। তাঁরা ভুলেই যায় এই জলের নিচে কত ইতিহাস ঘুমায়। অটোমানদের নৌবহর, বাইজেন্টাইনের পরাজিত কান্না, আর ব্রিজের নিচে বসে বসে চায়ের কাপে চুমুক দেওয়া পেনশনপ্রাপ্ত আঙ্কারা চাচা—এই সব মিলে বসফরাস পুরোদস্তর উপন্যাস।
আমিও চায়ের কাপ হাতে নিয়ে রাস্তার ধারে একটা টঙের দোকানে বসলাম। পাশের টেবিলে দুটো তুর্কি ছোকরা তর্ক করছে—একজন গালিব নিয়ে, আরেকজন গালাতাসারায় নিয়ে। গালাতা টাওয়ারটা নাকি বসফরাসের গলার মালা, আর গালিব হলেন তাদের কবি—প্রথমটা মেনে নিলেও দ্বিতীয়টা নিয়ে আমি সংকোচ করলাম। গালিব তো আমাদের কবি। এক চুমুক চা খেয়ে সারকাজম করে আমি বললাম, ‘আলবৎ দুটোই ঠিক।’ ওরা আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল, যেন আমি কোনো সুফি দরবেশ। এই মাত্র আতকা নাজিল হয়েছি। রুমির দেশে সুফির বেশে এসেছি। ভণ্ড সুফি আর ইশকে মুসাফির হলে নির্ঘাৎ ক্যাচাল বেঁধে যাবে, এসব ভেবে তড়িঘড়ি করে ‘গুলে গুলে’ (তুর্কি ভাষায় টাটা) বলেই আমি কেটে পড়লাম।
খানিকটা দূরে গিয়ে মনে হলো তাঁরা এখনো আমার দিকে তাকিয়ে আছে, অবাক চোখে এখনো আমার দিকেই, ঘোর কাটেনি বুঝি! অবশ্য তাঁরা কোন গালিবের কথা বলেছে, তাতো আমার জানা নেই। শেখ গালিব নামেও একজন তুর্কি কবি আছে তাদের। ‘তাদের’ বললে যেমন ভুল হবে, আমাদের বললেও তেমন ‘মুশাবাহা’ প্যাঁচ লেগে যাবে। কেননা, এই দুই গালিবই ছিলেন কবি। কাকতালীয়ভাবে একই সময়ে বসবাস করেছেন তাঁরা। শিল্প-সাহিত্য আর কবিতার জগৎ দাপিয়ে বেরিয়েছেন একই সময়ে। ভারতের এপার ছিল মির্জা গালিবের হাতে, তো ইউরোপের ওপার শেখ গালিবের কবিতাতে।
শেখ গালিব কিংবা মির্জা গালিব— দুজনই দাপ্তরিক কবি। একজন অটোমেনদের তো অন্যজন মোগলদের। তুর্কিদের শত বছরের গৌরবময় দেওয়ানি সাহিত্যের একদম শেষকালীন কবি ছিলেন এই গালিব। কে জানে, মির্জার সঙ্গে এই শেখ সাহেবের কোনো গোপন সংযোগ আছে কিনা! যা–হোক, গালিবের সঙ্গে না হয় অন্য একদিন সময় করে বসা যাবে। আপাতত গালাতার দিকেই যাওয়া যাক। এখানে চা মানে পানি না, এটা এক ধরনের এবাদত। প্রতিদিন না খেলে নাকি শরীরের ওপর অভিশাপ নামে। ছোট ছোট টুলে বসে সবাই চায়ের কাপ ঘোরাতে থাকে, এই ফাঁকে কেউ কেউ রুমি কিংবা নাজিম হিকমতের কবিতার সুর তোলে ইস্তাম্বুলে। কবিতা পাঠ হয় রাস্তায়—আর আমাদের ঢাকায় হয় কেবল পরীক্ষার খাতায়।
ফেরির পাশ দিয়ে এই মাত্র একটা বিশাল জাহাজ পেরিয়ে গেল। মনে মনে বললাম, ‘ইস্তাম্বুল, তুমি যে কেবল শহর না গো, ইরান তুরান কাবুল কিংবা আজারবাইজান সবাইকে তুমি ছাপিয়ে গেছ। যেন ইতিহাসের প্রেমপত্র। যার কোনো নির্দিষ্ট ঠিকানা নাই। তবে তোমার পাঠক অনেক, বেহিসেবি।’
ফেরি থামল উস্কুদার ঘাটে। আমি নামার আগেই এক খচ্চরবাজ হকার ছোকরা আমায় দেখে হেসে উঠল, ‘আয়ে আবি, হাওয়ার ইউ?’ আমি বললাম, ‘তোর শহরের হাওয়া খেতে এসছি, দাম নিবি?’ সে বলল, ‘বসফরাস তো ফ্রি, কিন্তু টোস্ট নিলে ২০ লিরা।’
উস্কুদার—এই নামটা শুনলেই মনে হয় সম্রাট বাবর এখানে এসে কিছুদিন থেকে গেছেন। উস্কুদারেও পুরোনো অলিগলি আছে অনেক। তবে আজকাল আধুনিক হয়ে গেছে এদিকটাও। মাঝেমধ্যে ঢাকা শহরের উত্তরার সেক্টরভুক্ত মনে হয় উস্কুদারকে। শান্ত, নীরব একটা শহর। রাস্তার ধারে দেখা যায় কিছু কিছু গালিচার দোকান। ফুটপাতে সাজিয়ে রেখেছে তুর্কি নারীদের হাতে বোনা শাহি গালিচা। এরই মধ্যে হুটহাট করে ঝামেলা পাকাচ্ছে ইস্তাম্বুলের হেলদি বেড়াল—সব মিলিয়ে উস্কুদারকে বলা যায় মায়াময় ভূগোল।
ইস্তাম্বুলের আরেক নাম ক্যাটসতাম্বুল। এখানে রাস্তাঘাটে কোনো বিড়াল থাকে না, বিড়ালের মধ্যে রাস্তাঘাট থাকে। সেদিন মসজিদ থেকে বেরিয়ে দেখি একদল পুঁচকে ছেলেপুলে এসে তাদের কোরান ক্লাসের খাতা ছুঁড়ে মারছে বিড়ালের দিকে, কেউ আবার কাগজ ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে খাইয়ে দিচ্ছে বিড়ালকে। কি অবাক কান্ড! নিউ জেনারেশনের দুষ্টু তুর্কি বালকগুলো বিড়ালকে হেফজ পড়াচ্ছে! পড়াচ্ছে তো না, একেবারে গিলে খাওয়াচ্ছে।
উস্কুদারের একদম ভেতরে (জামলিজা) মহল্লায় একটা গলির মধ্যে ঢুকে দেখি—একজন বুড়ো হুজুর চায়ের দোকানে (কফি শপে) বসে বই পড়ছেন। আমি এখানে প্রায়ই আসি। কত রকম মানুষ দেখি। আজকে এই হুজুরকে দেখে কাছে গিয়ে বসলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি হুজুর, তফসির নাকি ফিকহ?’
মুরব্বি বললেন, ‘না বাবা, আজকে মেহমেদ আকি এফেন্দির পুরোনো খত (প্রাচীন ধ্রুপদী লেখাপত্র) পড়ছি—এসব খতে শহরের আসল ইতিহাস আছে।’
আমিও এক কাপ তুর্কি কাহভে হাতে তাঁর সঙ্গে বসে পড়লাম। মৌলবি সাহেব আমায় দেখে বিরক্ত হলেন বৈকি! দেখে মনে হলো নকশেবন্দী। যেই আমি ভ্রমণপ্রেমী ওস্তাদ সৈয়দজি কবজাতে যাব, লোকটা অমনি হওয়া হয়ে গেল। না, আমার মোটেও অপমানবোধ হচ্ছে না। তবে অবাক হয়েছি বিল দিতে গিয়ে। আরে বাবা, চিনি না জানি না আমার বিল কেন দিয়ে দেবে? দিয়েছ ভালো কথা, বলে যাবে তো? এবার আমার কিছুটা ভয় হলো! এ আমার সঙ্গে কী ঘটে গেল? ওই লোক আসলে কে? কোনো সুফি দরবেশ না তো!
এত স্নিগ্ধ হাওয়া, কি সুন্দর সূর্যের ডুবে যাওয়া। এসবের কোনো ব্যাখ্যা নেই। ব্যাখ্যা জানতে চাইতেও নেই। এসব কেবল অনুভব চায়, প্রেম চায়, যেন উপলব্ধি করা যায়।
আজ ঘুম ভেঙেছে একদম ভোরে। এটাকে সুবহে সাদিক বলে। গতকালের ঘটনায় মনটা এখনো বিষণ্ন হয়ে আছে। একবার ভাবলাম একটু ইউরোপ থেকে ঘুরে আসা যাক। এবার বেবিটেক্সি নিয়ে পেরিয়ে এলাম এপারে। কাছাকাছি আসতে গালাতা ব্রিজ পর্যন্ত হেঁটে যেতে হলো, এরপর সোজা তাকসিম স্কয়ারের দিকে হাঁটা ধরলাম। ইস্তিকলাল সড়কটা দেখে মনে হলো ছোটবেলায় (মোগল আমলে) মেলায় হারিয়ে যাওয়া টিএসসির বড় ভাই—এখানে সবাই ব্যস্ত, সবাই চিন্তাশীল; কিন্তু কারও নাকে মুখে তাড়াহুড়ার কোনো ছাপমাত্র নেই।
একজায়গায় কিছু লোকজন জটলা বেঁধে আছে। কাছাকাছি এগিয়ে গিয়ে দেখি একটা গানের দল গিটার বাজাচ্ছে। একটা তুর্কি তরুণী গান গাইছে, ‘Istanbul seni seviyorum, ama sen beni duymuyorsun...’ মানে, ‘ইস্তাম্বুল, আমি তোমায় ভালোবাসি, অথচ তুমি আমায় শোনোইনি কখনো।’
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনলাম। মনে পড়ল আমাদের পুরান ঢাকার কথা—চাঁদনী চকের মোড়ে কেউ যদি এই গান গাইত, পুলিশ এসে বলত, ‘এই, লাইসেন্স কই?’ ইস্তাম্বুলে কেউ কারও লাইসেন্স দেখে না। এখানে মনের দরজা সব সময় খোলা, যতক্ষণ না কেউ কাবাবের দোকানে ভুল করে ভাতের অর্ডার দিয়ে ফেলে।
হেঁটে হেঁটে পৌঁছালাম বালাতে—কীভাবে যেন ইহুদি আর আর্মেনিয়ান মহল্লার ভেতরে ঢুকে পড়েছি। এই পাড়ায় পুরোনো দেয়াল, রঙিন দরজা, ইস্তাম্বুলের গহীনে লুকিয়ে আছে অদ্ভুত ধরনের নীরবতা। এক বৃদ্ধা বসে আছেন বারান্দায়। আমায় দেখে বললেন, ‘ইয়াবানজি মিসিন?’ মানে, তুমি কি বিদেশি? আমি বললাম, ‘না দাদি, আমি শুধু পা দিয়ে এখানে এসেছি। মন তো আগে থেকেই ফেলে গেছি।’ তিনি হেসে বললেন, ‘এই শহরটা এমনই, শরীর ছাড়ার আগেই মন ধরে রাখে বাবা।’
হাঁটতে হাঁটতে পথের ধারে ফুটপাতে একটা বইয়ের দোকান পেলাম—ধুলো জমা, ময়লা বাঁধা, কিন্তু ভেতরে গুপ্তধনের মতো রাখা পুরোনো একটা কিতাব। বইটা খুলে দেখি ফার্সি-তুর্কি মিশ্রণ ধ্রুপদী—এখানে মাওলানা রুমি থেকে শুরু করে আতাতুর্ক সবই আছে। না, আজ কোনো তর্ক-বিতর্ক নয়, তওফিকের উৎসব চলছে এখানে।
শেষ বিকেলে সন্ধ্যার আগে আবার বসফোরাসে ফিরে এলাম। সূর্যটা নেমে এসেছে ইউরোপের দিকে, আর আলো পড়ছে এশিয়ার মুখে। আমি চুপচাপ বসে আছি, ভাবছি ইস্তাম্বুল শহরটা কত অদ্ভুত! ইউরোপ-এশিয়ার মধ্যে এটা কি কেবল সেতু? না, আমার তো মনে হয় এটা কেবল সেতু নয়। আমি বরং ভাবছি রোম সাম্রাজ্যের কোনো সুফির প্রার্থনা এটা। কী করে এই ভূখণ্ড পেল তুর্কীরা! সন্ধ্যার পরে বসফোরাস দেখলে মনে হবে এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে সেতু করেছে একটা কুরআনের আয়াত। এত স্নিগ্ধ হাওয়া, কি সুন্দর সূর্যের ডুবে যাওয়া। এসবের কোনো ব্যাখ্যা নেই। ব্যাখ্যা জানতে চাইতেও নেই। এসব কেবল অনুভব চায়, প্রেম চায়, যেন উপলব্ধি করা যায়।
ইস্তাম্বুল, তুরস্ক