রুনুর মা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

রান্নাঘরের পেছনে বেতের ঝোপ। শেষ বিকেলে রুনু আর শীলাকে জরিনা ওখানে বসিয়ে রেখে গেছে। ওরা নড়তেও পারছে না। বেতের কাঁটায় শরীর ক্ষতবিক্ষত। মেয়েদের কষ্ট দেখে জরিনা বলে, ‘এই কষ্ট সইজ্জো করো। পাকিস্তানিগো হাতে কষ্ট পাওনের চাইতে এই কষ্ট সইজ্জো করন ভালো।’

আজ রাতে মিলিটারিরা আসবে। মা বিছানার ছেঁড়া চাদরে অল্প মুড়ি আর ছোট এককলসি পানি দিয়ে মেয়েদের ঝোপের মধ্যে বসিয়ে রেখেছে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, মিলিটারিদের খোঁজ নেই। রুনু হাইস্কুলে পড়ে, শিলা পড়ে ক্লাস ফাইভে। রুনুর কাঁধে মাথা রেখে শীলা ঘুমিয়ে গেছে। রুনুর ঘুম আসছে না। মায়ের জন্য চিন্তা হচ্ছে।

বিকট শব্দে শীলার ঘুম ভেঙে গেল। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আপুর দিকে। বোনকে জড়িয়ে রাখে রুনু। আশপাশের বাড়িতে কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে। একটু দূরেই রঞ্জিতদের বাড়িতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। ভয় পায় শীলা। রুনু জানে, তাদের বিপদ সবচেয়ে বেশি। কারণ, তাদের বাবা মুক্তিযুদ্ধে গেছে। করিম চাচা মিলিটারিদের খবর দিয়েছে। তাই আজ গ্রামে মিলিটারি এসেছে।

মেয়ে দুটোকে ঝোপের ভেতর বসিয়ে রেখে জরিনা তাদের দুটো গাভি আর একটি বাছুরের দড়ির বাঁধন খুলে দেয়, যেন ওরা জীবন বাঁচাতে পালিয়ে যেতে পারে। কিন্তু বোবা প্রাণীগুলো বাড়ির মায়া ছাড়তে পারল না। উঠানে বসে রইল। করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জরিনার দিকে।

চারপাশের অন্ধকার আগুনের লাল আলোয় হারিয়ে গেছে। রুনু হঠাৎ বাড়িতে কারও পায়ের আওয়াজ পায়। করিম চাচার গলা—‘হাশেমের বউ, বাড়ি আছনি?’ দরজা খুলে জরিনা বেরিয়ে

আসতেই মিলিটারিরা তার চুলের মুঠি ধরে উঠানে টেনে এনে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়। বুট দিয়ে সজোর লাথি মারতে থাকে। করিম চাচা জিজ্ঞেস করে, ‘হাশেম কই? তোর মাইয়ারা কই?’ জরিনা জবাব দেয় না। বোনের মুখ চেপে ধরে ভয়ে কাঁপছে রুনু।

মিলিটারিরা জরিনার শাড়ি খুলে আগুন লাগিয়ে ঘরের চালে জুড়ে দেয়। ঘর লাল আভায় জ্বলে ওঠে। এরপর জরিনাকে উঠানের পেয়ারাগাছটায় ঝুলিয়ে বেঁধে দেয়। রুনু দেখে, করিম চাচা মায়ের শরীর নোংরা স্পর্শে ভরিয়ে দিচ্ছে। কিছুক্ষণ পরই গুলির শব্দ। মায়ের মৃত্যু দেখতে দেখতে কান্নার শব্দ চেপে রেখে শীলার পিঠে হাত বুলিয়ে দেয় রুনু।

বাড়ি জ্বলে গেছে। জরিনার নিথর দেহ গাছে ঝুলছে। মিলিটারিরা চলে গেছে। কোথাও কোনো শব্দ নেই। সূর্য আজ যেন একটু সময় নিয়ে জাগছে। শীলাকে নিয়ে বেতঝোপ থেকে বেরিয়ে আসে রুনু। মাকে গাছ থেকে নামিয়ে আনে। গায়ের ওড়নাটা মায়ের শরীরে বিছিয়ে দেয়। ছোট ওড়নায় সবটুকু ঢাকে না। খড়ের গাদা থেকে খড় এনে মায়ের ওপর বিছিয়ে দেয় সে। শীলার কান্না থামছেই না। রুনু মায়ের পাশে বসে নির্বাক দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে, যেন কিছু একটা বলতে চায় সে।