স্মৃতিতে ভাষাবিদ ড. মাহবুবুল হক

ড. মাহবুবুল হকফাইল ছবি : প্রথম আলো

২০০৫ সালের কথা। চট্টগ্রামের ডিসি হিলের পাশে ফুলকিতে বিবর্তনের ক্লাস হতো। বাতিঘরের কর্ণধারের দীপঙ্কর দাদার পরামর্শে সেখানে ভর্তি হলাম। বিবর্তন হলো সমাজ সংস্কৃতিচর্চা কেন্দ্রের একটা সাম্পান। যেখানে তরুণ যাত্রীদের সৃজনশীল ও মননশীল কাজে অনুপ্রেরণা ও উৎসাহ-উদ্দীপনার মাধ্যমে আগামীর জন্য তৈরি করা হয়। বিবর্তনে শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি, আবৃত্তি, শুদ্ধ উচ্চারণ, বাংলা ভাষার বানান, আলোকচিত্র, শিল্পকলা, লেখালিখি—প্রতিটা বিষয়ে পাঠ দিতেন দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদেরা। বন্ধু সুমন সেন, শিক্ষক ইসমত আরা দিলশাদ, সুজন, কবি মনির ভাইসহ আমরা অনেকে অপরাহ্নে গিয়ে ফুলকিতে বিবর্তনের ক্লাস করতাম। বাংলা ভাষার ওপরে ক্লাস নিতেন ড. মাহবুবুল হক স্যার। তাঁর ক্লাসগুলো ছিল অসাধারণ এবং শিক্ষনীয়। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শোনতাম লেকচার। আনন্দের সঙ্গে পাঠদান করাতেন তিনি। স্যারের ভাষার ব্যবহার, ব্যাকরণ, বাংলা বানান, শব্দচয়ন, উচ্চারণ ছিল বেশ শ্রুতিমধুর।

চট্টগ্রামে প্রথম আলো–এইচএসবিসি ভাষা প্রতিযোগ অনুষ্ঠানে প্রায়ই অতিথি হয়ে আসতেন ড. মাহবুবুল হক। শিক্ষার্থীদের বাংলা ভাষা ও বানানসম্পর্কিত নানা প্রশ্নের উত্তর দিতেন। স্যারের সঙ্গে সর্বশেষ দেখা ও কথা হয়েছিল ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে চট্টগ্রাম একাডেমির সাহিত্যে উৎসবে চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমিতে। স্যারকে পা ছুঁয়ে সালাম করলাম, তিনি হাত মিলিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। ওনার চিরসবুজ মেধাবী হাসিমাখা মুখটা আজও জলছবির মতো চোখে ভেসে উঠে।

ভাষাবিদ ড. মাহবুবুল হকের লেখক (ডানে)
ছবি: সংগৃহীত

ড. মাহবুবুল হক সহজ–সরল ভাষায় বক্তৃতা দিলেন, প্রতিটি বাক্যের পরতে পরতে ছিল আলোক শিখা ও শিক্ষনীয় কথামালা। শিল্পকলার হলভর্তি কবি-সাহিত্যিক, লেখক, দর্শক শ্রোতা—মন্ত্রমুগ্ধ  হয়ে শুনছিলেন বক্তব্য।

গুণী এই মানুষটি ১৯৪৮ সালে ৩ নভেম্বর ফরিদপুর জেলার মধুখালীতে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আবদুল মালেক, মাতা মোছাম্মৎ হাজেরা খাতুন। পিতার কর্মসূত্রে শৈশব থেকে চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠেছেন। ১৯৭৮ সালে রাঙ্গুনিয়া কলেজের প্রভাষক এবং ১৯৮১-১৯৯৭ সালের দিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৯৯৭ সালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। দীর্ঘকাল অধ্যাপনা করেছেন সেখানে। ২০১৬ সালে অবসর গ্রহণের পর কুমিল্লা সিসিএন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্য এবং উপদেষ্টাও ছিলেন।

ড. মাহবুবুল হক ৪০টিরও বেশি গ্রন্থ রচনা করেছেন। উল্লেখযোগ্য হলো ‘ম্যাক্সিম গোর্কির মা, ঐতিহাসিক বস্তবাদ পরিচিতি’ (অনুবাদ), ‘আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস’,‘বাংলা বানানের নিয়ম’, ‘আশুতোষ চৌধুরী’, ‘পাঠ্য বইয়ে বাংলা বানানোর নিয়ম’, ‘বিশ্ব তারিখ অভিধান’, ‘বাংলা কয়েকটি প্রসঙ্গ’, ‘তিনজন আধুনিক কবি সমর সেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও সুকান্ত ভট্টাচার্য’, ‘সংস্কৃতি ও লোক সংস্কৃতি’, ‘নজরুল তারিখ অভিধান’, ‘বাংলার লোকসাহিত্য’, ‘সমাজ সংস্কৃতি’, ‘রবীন্দ্রনাথ ও জ্যোতিরিন্দ্র নাথ’, ‘অন্বেষার আলোয় চট্টগ্রাম’, ‘খটকা বানান অভিধান’ (প্রথমা), সম্পাদিত গ্রন্থ ‘চাটগাঁ ভাষার রূপ পরিচয়’, ‘গল্পে গল্পে ভাষা আন্দোলন’, ‘রশীদ আল ফারুকীর রচনা সংগ্রহ’, ‘লোকমান খান শেরওয়ানী’ ইত্যাদি। তিনি সারাজীবন বাংলা ভাষা ও ব্যাকরণ নিয়ে গবেষণা করে গেছেন। আগামী প্রজন্ম এবং শিক্ষার্থীদের কথা ভেবে বাংলা ভাষার নিয়ম–কানুন ব্যাকরণ এবং বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা ব্যবহারিক ব্যাকরণ সম্পাদনা করেছেন। ২০১৬ সালে ড. মাহবুবুল হককে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ও সম্মাননা এবং ২০১৯ সালে তাঁকে রাষ্ট্রীয় একুশে পদক প্রদান করা হয়।

২৫ জুলাই কাক ডাকা ভোরে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা ফিরলাম। আফরোজা সিদ্দিকা মুঠোফোনে জানাল ভাষাবিদ অধ্যাপক ড. মাহবুবুল হক স্যার না ফেরার দেশে চলে গেছেন। খবরটা শুনে যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। দেশের বাতিঘর দীপ্তিমান শিখাটিও নিভে  গেল। আগের দিন ২৪ জুলাই রাত দেড়টার দিকে কিডনি ও হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর একটি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন।

২৬ জুলাই চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমিতে হাজার হাজার মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত হলেন মাহাবুব স্যার। চট্টগ্রামে দুটি নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। স্যারের মেয়ে উপমা মাহাবুব অশ্রুসিক্ত হয়ে সবার উদ্দেশে তাঁর বাবার স্বপ্নের কথা বলেন, ‘আমাদের দেশটা ক্রান্তিকালের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। আপনারা সবাই যেখানে যাঁরা আছেন, দেশের জন্য কাজ করুন। তরুণদের জন্য আরও কাজ করুন। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আরও সুন্দরভাবে কীভাবে তৈরি করা যায়, সেভাবে কাজ করেন। যাতে আমার বাবা যেমন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন, তেমন বাংলাদেশ পেতে পারি।’

বন্ধু, চট্টগ্রাম বন্ধুসভা