শেষ রাত থেকে মুষলধারে বৃষ্টি। ভেবে পেলাম, অবনীকে নিয়ে ঘুরতে বের হওয়ার এ–ই তো সুসময়। ওকে জানিয়ে দিয়েছি বিকেলে ঘুরতে যাওয়ার কথা। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলেছি, ‘দেখো অবনী, সারা বছরই তো আর প্রকৃতিতে বৃষ্টি থাকছে না, এমন সুযোগের অপচয় করলে চলবে কেন?’
আমার সাধাসাধিতে অবনী না করার সুযোগ পায়নি। অতঃপর রাজি হলো। বের হওয়ার আগে অবনীকে বলে দিলাম, নববর্ষে কেনা সাদা ব্লাউজের সঙ্গে নীল শাড়িটা পরে আসতে। তড়িঘড়ি করে আমিও নীল পাঞ্জাবিটা পরে নিলাম। দুজনে হুড তোলা রিকশায় চলে গেলাম শহরের নির্জতম জায়গা সিআরবিতে।
আমি রিকশা থেকে লাফিয়ে নেমে অবনীর কোমল হাত ধরে নামতে সাহায্য করলাম। বৃষ্টিতে ওর শাড়ির কুঁচি আলুথালু হয়ে আছে; খুব যতনে একটা একটা ঠিক করে দিলাম। হালকা বাতাস আর বৃষ্টির সঙ্গে যোগ দিলাম আমরাও। ঝুমবৃষ্টিতে বিশালাকার গাছগুলোর ডালপালা আনত হয়ে মুখভার করে আছে। অবনী আমার ডান হাতের কনিষ্ঠা ধরে হাঁটছে, কেমন ছোট্ট শিশুর মতো মেয়েটি। হাঁটতে হাঁটতে ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে অবুঝের মতো কথা বলছে। মাঝেমধ্যে আমিও খিলখিলিয়ে হেসে উঠি। অকারণ হাসি–তামাশায় ভিজতে থাকি দুজন। প্রবল বৃষ্টির ছাঁটে অবনীর পুরো শরীর ভিজে জবজবে হয়ে আছে, আলুলায়িত চুলের ডগা দিয়ে টপটপ করে ঝরে পড়ছে জল। পাতলা নীল শাড়িটা শরীরের সঙ্গে ঠেসে লেগে আছে, ধবধবে পুলকিত শরীর ভেসে উঠছে সুচারুরূপে। মুখে বিন্দু বিন্দু বৃষ্টির ফোঁটা জমে আছে, একটার সঙ্গে একটা মিলিত হলে লাবণ্যময় গাল বেয়ে শিরশির করে নেমে পড়ছে নিচের দিকে। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার চোখ বুজে আসে।
এদিক-ওদিক থেকে আরও কয়েকজন রমণী হাতে হাত রেখে হেঁটে আসছে। থেকে থেকে বৃষ্টির রিমঝিম ছন্দ বোনা সুর ছিঁড়ে ভেসে বেড়াচ্ছে তাদের অট্টহাসির রোল। সুখানুভবে তাকিয়ে রইলাম, এ জগতে মানুষ সত্য, প্রেম সত্য, আরও সত্য প্রকৃতি। তিন সত্যের বৃত্তে বৃষ্টির জল যেন প্রেমের শুদ্ধতা ও শুভ্রতাকে আরও উজ্জ্বল করে দিচ্ছে।
বৃষ্টির ধোঁয়াশায় নির্জনতম জায়গাটিতে বিকেলবেলায় নেমে এসেছে সন্ধ্যার অন্ধকার। আগেভাগে অন্ধকার নেমে এলে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নিঃসঙ্গ ল্যাম্পপোস্টগুলো জ্বলে ওঠে। ভিজতে ভিজতে অবনীর কাঁপুনি ধরে। খুকখুক করে একটু একটু কাশছেও। আমার শরীরের উষ্ণতা তাকে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলাম। অবনীকে ডান হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বগলদাবা করে এগুতে শুরু করি। প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় সখ্য গড়ে তুলে দুর্বার অনুভবের রাজ্যে কল্পলোকের ঘৃতচীকে নিয়ে অন্ধকার ঠেলে হারিয়ে যেতে লাগলাম অচিনপুরে।
অবিশ্রান্ত বজ্রপাতের বিকট শব্দে অকস্মাৎ ঘুম ভেঙে যায় আমার। বুকে জড়িয়ে রাখা কোলবালিশটি একঝটকায় পাশে রেখে ধড়মড় করে উঠে বসলাম বিছানায়। মুঠোফোনের ঘড়িতে দেখি, বারোটা বেজে বিশ মিনিট। ভার্সিটির শাটল ট্রেন মিস হয়ে গেছে প্রায় তিন ঘণ্টা আগে। স্বপ্নের কথা ভাবতে ভাবতে জানালার কাচ খুলে দেখি, বৃষ্টি আর মেঘ ডাকার শব্দ তুমুল কাণ্ড ঘটিয়েছে বাইরে। আনমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘কোথাও কেউ নেই এই হৃদাকাশে; তবু বৃষ্টি নামুক শহরজুড়ে।’
বন্ধু, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা