কুপিবাতির সন্ধ্যা

লম্বা বারান্দায় ঝুলছে সলতে দেওয়া কুপিবাতি, পুরোনো চিঠির বাক্স আর গাছ
ছবি: অনিক মজুমদার

হিমঝরা শীতের বিকেল। মনু মামার বিশেষ আবদার রাখতে তার বাড়িতে যাওয়া। পাখিদের কলকাকলিতে সন্ধ্যাটা যেন দ্রুতই নেমে এল। বাড়ির পিচ্চিরাও আমার সঙ্গে এসেছে। পিঁড়ি পেতে বসতেই একথাল খই খেতে দিলেন মামা। খই মুখে দিতেই বিদ্যুৎ চলে গেল। মনু মামা তাঁর কুড়েঘরের কোনা থেকে নিয়ে এলেন কুপিবাতি। আশ্চর্য জাদু দেখার মতো পিচ্চিরা অবাক হলো। জ্বলন্ত কুপির চারপাশ ঘিরে বসেছে সবাই।

দিয়া জিজ্ঞেস করল, ‘এটা কী?’ শুভা ভাবুক দৃষ্টি মেলে উৎসুক হয়ে বলল, ‘এটাই কি আলাদিনের চেরাগ?’ তাদের সবার উৎসাহ, বিস্ময় দেখার মতো!

মাত্র এক দশকের ব্যবধানে এই প্রজন্ম কুপি চিনতে পারছে না। অথচ বছর পনেরো আগেও গ্রামে সন্ধ্যা নামলেই ঘরে ঘরে কুপি জ্বালানো হতো। সেই আলোয় সবাই পড়তে বসত। প্রযুক্তি ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় আলোকবর্তিকা কুপি আজ কেবলই স্মৃতি। কুপিবাতির মিটিমিটি আলোয় সন্ধ্যার কিছু পরই মনে হতো, গভীর রাত ঘনিয়ে এসেছে। আর এখন বিদ্যুতের ছোঁয়ায় গভীর রাতকেও আমরা উপেক্ষা করে ঘুমাতে যাই না।

গ্রামের মানুষ তাঁদের সামর্থ্য অনুযায়ী কুপি কিনে ব্যবহার করতেন। দুই ধরনের কুপি পাওয়া যেত; বড় ও ছোট। বেশি আলোর প্রয়োজনে কুপিবাতিগুলো কাঠ ও মাটির তৈরি গছা অথবা স্ট্যান্ডের ওপর রাখা হতো। গছা অথবা স্ট্যান্ডগুলো ছিল বাহারি নকশার। মাটি, বাঁশ, কাচ, পিতল, লোহা ইত্যাদি উপাদানে তৈরি হতো কুপি। সবচেয়ে কম দামের ছিল মাটির তৈরি কুপি।

গ্রামবাংলা কুপিবাতির টিমটিমে আলোয় জ্বলে উঠত রূপকথার গল্পের মতো। তৎকালীন বনেদি পরিবারগুলোয় ছিল বাহারি রঙের কুপিবাতি। রাজা-বাদশাহদের আমলে এই বাতি ছিল আরও চমকপ্রদ। কালের বিবর্তনে সেই কুপিবাতির স্থান বর্তমানে দখল করে নিয়েছে বাহারি বৈদ্যুতিক বাল্ব, চার্জার লাইট, টর্চলাইট, মুঠোফোনের আলোসহ আরও অনেক কিছু। ফলে ক্রমেই হারিয়ে গেছে কুপি। একসময় যা সচরাচর দেখা যেত, এখন তা যেন বিস্ময়। তবে কেউ কেউ শখ করে প্রিয়জনকে উপহার দিচ্ছেন কুপিবাতির সন্ধ্যা।

তুলনামূলক কম আলো দিচ্ছে বলে মনু মামা কুপিবাতিটা হাতে তুলে নিলেন কেরোসিন দেওয়ার জন্য। দাদিমার মতোই তিনি প্লাস্টিকের বোতলের গলায় রশি লাগিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছেন বাঁশের খুঁটিতে। সেই বোতল থেকে একটা বিশেষ চোঙের সাহায্যে কেরোসিন ঢেলে দিলেন কুপিতে। ছোটদের সঙ্গে সঙ্গে আমিও আশ্চর্য হয়ে দেখছি বাংলার ফেলে আসা অতীত।

গেঞ্জি অথবা সুতি কাপড়ের ত্যানা (ন্যাকড়া) ছিঁড়ে দড়ি পাকিয়ে সলতে বানিয়ে ঢোকানো হয়েছে কুপিবাতিতে। কেরোসিন ঢেলে আগুন দিতেই ধপ করে জ্বলে উঠল সেটি। ক্রমেই আলো ছড়িয়ে পড়ে। মনে হলো, কিছু সময়ের জন্য ফিরে গেলাম সোনালি শৈশবে। অনেক বছর পর কেরোসিনের গন্ধ মাখা কুপিবাতির সন্ধ্যায়।

পাঠাগার ও পাঠচক্র সম্পাদক, কক্সবাজার বন্ধুসভা