বোকা জামাই

অলংকরণ: প্রথম আলো

রতনের বিয়ের সবে ছয় মাস অতিবাহিত হয়েছে। নতুন জামাইয়ের তকমা এখনো লেগে আছে। তবে শ্বশুরবাড়িতে খুব একটা যাওয়া হয়নি। বিয়ের পর স্ত্রী সুমিকে নিয়ে মাত্র তিনবার গিয়েছে। তাই যখনই যায়, জামাই আদরের কমতি থাকে না।

খুব সহজসরল ছেলে রতন। গ্রাম্য পরিবেশে বেড়ে ওঠায় তার মধ্যে চতুরতার ছাপ নেই। বোকা স্বভাবের কিছুটা। খুব বেশি গুছিয়ে কথা বলতে পারে না। এ জন্য পরিবার ও সমাজের বিভিন্ন স্থানে নানাভাবে হেয় প্রতিপন্ন হতে হয়। আধুনিক সভ্য সমাজে এমন মানুষেরা যথাযোগ্য মর্যাদা পায় না।

বিয়ের পর প্রথম শীত। শ্বশুরবাড়ি থেকে শাশুড়ি জামাই-মেয়েকে নেমতন্ন করেছে। শীতের পিঠাপুলি খাওয়ার জন্য। নতুন জামাই বলে কথা। তাছাড়া এটি বাঙালি সমাজের চিরায়ত একটি প্রথা। এই সময়টায় গ্রামের প্রতিটা বাড়িতে জামাই-মেয়েরা আসে। শ্বশুর-শাশুড়ি সাধ্যমত আদর-আপ্যায়ন করে থাকেন। পাড়া-প্রতিবেশীরাও নেমতন্ন করে খাওয়ান। গ্রামবাংলার এই প্রথা যুগের পর যুগ ধরে চলে আসছে।

বিড়াল ভেবে সবাই হেই হেই করতে করতে রান্না ঘরে এসে দেখে তাদের জামাই রতন কালিঝুলি পায়েস মাখানো মুখে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে! সবার চক্ষুস্থির।

পৌষপার্বণের ঠিক আগের দিন রতন তার স্ত্রী সুমিকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশে রওনা হয়। দুহাতভর্তি মিষ্টান্ন, ফলফলাদিসহ আরও অনেক কিছু নিয়ে সন্ধ্যার কিছু আগে পৌঁছে যায়। জামাই-মেয়েকে পেয়ে সবাই খুব খুশি। রাতে খাওয়াদাওয়া ও আপ্যায়নে বেশ সমাদর করা হয় জামাইকে। মাছ, মাংস, সবজিসহ অনেক রকম পদ। শেষপাতে দেওয়ার জন্য সুস্বাদু মিষ্টি পায়েস তৈরি করেন শাশুড়ি। চিনি দিয়ে তৈরি পায়েশ দেখতে সাদা ফেনা ভাতের মতো। রতনের মা বাড়িতে প্রায়ই ফেনা ভাত রান্না করেন। যা খেয়ে খেয়ে রতনের অরুচি হয়ে গেছে। খাওয়া শেষে শাশুড়ি যখন রতনের পাতে ফেনা ভাতের মতো পায়েস দিতে গেলেন, তখন রতন কোনোকিছু না ভেবেই শাশুড়িকে বলল, ‘না মা, আমি এটা নেব না। এটি আমার মা বাড়িতে প্রতিদিন রান্না করেন। রোজ রোজ খেয়ে বিরক্তি এসে গেছে। আর ভালো লাগে না।’

নেব না, নেব না করতে করতে কিছুটা পায়েস রতনের পাতে পড়ে যায়। একটুখানি মুখে দিতেই স্বাদে অবাক হয়ে যায় রতন। এটাতো সাধারণ ফেনাভাত নয়! এ যে অমৃতসম পায়েস। জীবনে সে কখনো এত সুস্বাদু পায়েস খায়নি। রাতে শুয়ে শুয়ে শুধু পায়েসের কথাই মনে পড়ছিল। স্বাদ যেন মুখে একদম লেগে আছে। অনেক রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে ঠিক তখন রতন পায়েসের খোঁজে রান্নাঘরে ঢুকে হাঁড়ি সমেত পায়েশ অমৃতের মতো গ্রোগ্রাসে গিলতে থাকে। খাওয়ার সময় কোনো দিকে যেন খেয়াল নেই তার। হঠাৎ হাত থেকে পায়েসের হাঁড়ি পড়ে যায়। হাঁড়ি পড়ার শব্দে সবার ঘুম ভেঙে যায়। বিড়াল ভেবে সবাই হেই হেই করতে করতে রান্না ঘরে এসে দেখে তাদের জামাই রতন কালিঝুলি পায়েস মাখানো মুখে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে! সবার চক্ষুস্থির। কী করবে বা কী বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না। এ যে ওদের জামাই। কিছুক্ষণের মধ্যে নীরবে সবাই যে যার ঘরে চলে গেল। সুমি এসে রতনকে ঘরে নিয়ে যায়। সবার সামনে লজ্জায় ওর মাথা ছোট হয়ে গেছে। সারারাত স্ত্রীর কথার প্রহারে রতনকে নাজেহাল হতে হয়। তবু তার মুখে কোনো কথা নেই। নির্বাক হয়ে স্ত্রীর কটুবাক্য হজম করে যাচ্ছে। মহা অন্যায় করে ফেলেছে যে সে। সকাল হতেই শ্যালক-শ্যালিকারা এই ব্যাপারটা নিয়ে ঠাট্টাতামাশায় মেতে ওঠে। কথাগুলো খুব গায়ে লাগে সুমির। একটু বেলা হতেই পুরো এলাকাতে ব্যাপারটা ব্যাপকভাবে চাউর হয়ে যায়। লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করে সুমির। সেখানে আর এক মুহূর্ত নয়, রতনকে টানতে টানতে শ্বশুরবাড়ি চলে আসে সুমি। সেই থেকে বোকা জামাইয়ের হাস্যকর গল্পটা এলাকার সবার মুখেমুখে।

নওগাঁ, বাংলাদেশ