জীবনচাবি

ছবি: এআই/বন্ধুসভা

আম্মা আজ চার দিন হলো বাড়িছাড়া। রোগ ওনাকে নিঃশেষে গিলে খাচ্ছিল। মানুষ হয়ে আরেক মানুষকে কি আর ওষুধ না খাইয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া যায়? যত অভাব–অনটনই থাকুক না কেন, বুকের মানুষটাকে ধরে রাখার সাধ তো আর থামে না। ‘আম্মা...আম্মা’—এ ডাকটা চার দিন হলো গলা ছেড়ে দিতে পারি না।

টেলিফোনে কথা হয় ঠিকই, কিন্তু পরানের শূন্যতা কি আর তার সীমিত কথায় মেটে? আম্মার শাড়ির আঁচল ছিল আমার মুখ মোছার প্রিয় কাপড়। তাতে যদি হাজারো ঘামের গন্ধও লেগে থাকত, আমার কাছে সেটাই ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে শান্তির সুবাস। আজও সেই শাড়ি মুখে ছুঁয়ে দেখি, যেন সবচেয়ে দামি পারফিউমের ঘ্রাণ!

আম্মার পাশে থাকলে কখনো দু–চার কথার বকাবকি হয়। আম্মারে আমি কত কষ্ট দিই, তবু আম্মারে কতটা ভালোবাসি। এই ভালোবাসার কোনো সীমা নেই। যেদিন আম্মা ঢাকা গেলেন, সেদিন মনটা ভার হয়ে ছিল। সারা দিন ঘুমিয়েছি। মন খারাপ থাকলে ঘুমের মধ্যে নিজেকে লুকাই।

আম্মার হাতে পালিত মুরগিগুলো এখন আমারই দায়িত্বে। আমিই ওদের খাবার দিই। যে হাত একা একা কত শস্য ফলিয়েছেন, সংসারটাকে বুনেছেন, সেই হাতই আজ হাড়ভাঙা ব্যথায় কাতর। আম্মার মাটির চুলা যেন সারাক্ষণ হাঁকডাক করে, তাতে আমি আম্মার অভাব টের পাই। রাতের নির্জনতায় যখন সবাই ঘুমায়, আমি শুনি মায়ের দুঃখী কান্না–বেদনাভরা শরীরের দীর্ঘশ্বাস।

কতবার দেখেছি, পিঠের ব্যথায় আম্মা বসে থাকতে পারেন না। কিন্তু আমার চুলে শ্যাম্পু করার কথা এলে দিব্যি উঠে পড়েন। মায়ের এই নিঃস্বার্থ ভালোবাসার কোনো তুলনা হয় না। চুলে সিঁথি কেটে তেল দেওয়া, তারপর মাথা ধরলে ওনার ব্যস্ত হয়ে পড়াটাও ভীষণ মনে পড়ে। আম্মারে খুব মনে পড়ে। মনে হয়, সেই শৈশবের মতো অকারণে দুষ্টুমি করে মায়ের দৌড়ানি যদি আরেকবার খেতে পারতাম! জানি, এখন আর কোনো দৌড়ানি নেই। আম্মাকে প্রতিদিন থেরাপি দিতে হয়, দামি দামি ওষুধ খেতে হয়। ওষুধ গিলতে গিলতে একদিন তিনি হয়তো আমাদের ছেড়েই চলে যাবেন...।

যখন দু–এক কথা নিয়ে ঝগড়া হয়, আম্মা বলেন, ‘আমি যখন থাকব না, তখন বুঝবি আম্মা কী জিনিস!’ এই বাক্য মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে দুঃখের কথা। আল্লাহর কাছে মিনতি, যদি আমার হায়াতটুকু মায়ের জন্য দেওয়া যেত! আমি বেঁচে থেকে কী করব? আম্মা না থাকলে এই ঘরে মরীচিকা ধরবে, নিঃসঙ্গতা পাথর হয়ে বুক চেপে বসবে। আব্বা একা কীভাবে থাকবেন? আম্মার হাতে ধরা ঝাড়ুর শব্দ, মাটির চুলার উনুন—সব যেন থমকে যাবে।

আম্মার ঘ্রাণ মনে মনে খুঁজি। ‘তিন্নী’ বলে ডাক আমার ভেতরটাকে জ্বালায় খুব। আম্মার আঁচল, হাত, কথা—সবই আমার জীবনচাবি। আম্মা আমার জীবনচাবি। আমার সব ভালোবাসা ও প্রার্থনা শুধু আম্মার জন্য।

ঝিনাইদহ, সদর