ঘুরে এলাম নিকলী হাওর

সঙ্গীদের সাথে লেখক (মাঝে, সাদা টিশার্ট পরিহিত)
ছবি: সংগৃহীত

ভোর পাঁচটায় স্নান সেরে নিলাম। রাতে ভালো ঘুম হয়নি। ভ্রমণে যাওয়ার আগের রাতে আমার ঘুম হয় না। এটা পুরোনো অভ্যাস। বাইরে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। মেঘলা আকাশ। বের হওয়ার সুযোগ নেই। দুই গ্লাস জল পান করে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলাম। মনে এখন অন্য চিন্তা। এমন আবহাওয়া দেখে কেউ যদি যেতে না চায়! তাই মনস্থির করলাম, কাউকে না পেলে একাই যাব। নাশতা সেরে বৃষ্টির মধ্যেই বেরিয়ে পড়ি।
সকাল আটটার মধ্যে নরসিংদী রেলস্টেশনে পৌঁছে যাই। চোখে ঘুম নেই, তবে রাতে ঘুম না হওয়ায় এখন চোখ দুটি হালকা জ্বলছে। বন্ধুদের সঙ্গে নিকলী হাওর দেখতে যাওয়ার পরিকল্পনা অনেক দিনের। কিন্তু কারোরই একসঙ্গে সময় হয়ে উঠছিল না। সবাই যার যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। তাই রাতে হুট করেই বলা, যারা যেতে চায়, তারা যেন সকাল আটটার মধ্যে রেলস্টেশনে উপস্থিত থাকে।

আমার হতাশ হতে হয়নি। প্রথমেই সৌরভ ভাই এল। দীপ্ত এসে তাঁর বন্ধুদের চট্টগ্রাম ভ্রমণের অগ্রিম টিকিট কেটে দিল। দীপ্তর সঙ্গে তনয়ও এসেছে। তবে সে আমাদের সঙ্গে যাওয়ার উদ্দেশে আসেনি। আমরা তাঁকে জোর করাতে রাজি হয়ে গেল। আমরা চারজন কিশোরগঞ্জগামী এগারসিন্ধু প্রভাতি এক্সপ্রেসে উঠে বসলাম। সাড়ে আটটারও কিছু সময় পর ট্রেন ছাড়ে। ট্রেন ভ্রমণ সব সময়ই মজার। অপরিচিত মানুষের সঙ্গেও গল্পের আসর জমিয়ে তোলা যায়। আমরা গান গাচ্ছিলাম, আরও কয়েক যাত্রী এসে সুর মেলালেন। সময় আর পরিকল্পনার অভাবে আমাদের টিকিট কাটা হয়নি। ভেবেছিলাম টিটি টিকিট চেক করতে এলে কিছু টাকা দিয়ে দেব। কিন্তু কেউই এল না। ভ্রমণে আর টাকা খরচ হয়নি। বেলা পৌনে ১১টায় মানিকখালী রেলস্টেশনে পৌঁছে যাই।

হাওরের মাঝে ছোট্ট চরে মানুষের বাড়িঘর
ছবি: লেখক

স্থানীয় বাজার থেকে জল, পাউরুটি ও কলা কিনে একটা অটোরিকশা রিজার্ভ করে নিকলী হাওরের উদ্দেশে রওনা দিই। অটোরিকশা ভাড়া ১৮০ টাকা নেয়। প্রায় এক ঘণ্টার জার্নি শেষে আমরা হাওর ঘাটে এসে পৌঁছাই। প্রথমেই একটা ভ্রমণ গ্রুপ খুঁজলাম। আমরা মাত্র চারজন হওয়ায় নৌকা ভাড়া নিলে খরচ বেশি লাগবে। কোনো গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেলে সবার ভাগে ভাড়া কম পড়বে। দুটি দল পেয়েও যাই। একটি দলে তিনজন, কুষ্টিয়া থেকে মোটরসাইকেলে এসেছে। অন্য দলটিতেও তিনজন, তাঁদের বাড়ি কুমিল্লা। আমরা ১০ জন মিলে ১ হাজার ৫০০ টাকায় একটি ট্রলার ভাড়া নিলাম।

নিকলী হাওর
ছবি: লেখক

বৃষ্টি এখন আর পড়ছে না। আকাশে রোদেরও তেমন আনাগোনা নেই, মেঘাচ্ছন্ন হয়ে আছে। হাওর ভ্রমণের জন্য এমন পরিবেশই মুগ্ধতা ছড়ায়। কবি হলে হয়তো দুই-একটা কবিতা লিখেও ফেলতাম। নৌকায় বসে কেউ গান ধরেছে, কেউবা আবার আড্ডা জমিয়ে দিয়েছে। সবার সঙ্গে অল্পতেই খাতির জমে ওঠে। হাওরের বিস্তৃীর্ণ জলরাশি ও শীতল বাতাসে মন জুড়িয়ে যায়। নৌকা ভ্রমণ শেষে আমরা রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদের বাড়ি দেখতে গেলাম। কাছেই তাঁর বাড়ি। সেখান থেকে অটোরিকশা নিয়ে আমরা অষ্টগ্রাম, ইটনাসহ আরও কয়েকটি জায়গা ঘুরে দেখি। রাস্তার দুই পাশে হাওরের বিস্তৃীর্ণ জলরাশি। চারপাশে কয়েকটি দ্বীপ ও ছোট ছোট বাড়িঘরও চোখে পড়ে। দ্বীপের বাসিন্দারা ডিঙি নৌকায় যাতায়াত করে থাকেন।

হাওরে সূর্যাস্ত
ছবি: লেখক

এবার ফেরার পালা। মিঠামাইন ঘাটে আসতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামার উপক্রম। নৌকা উঠে বসলাম, দ্রুত নিকলী ঘাটে পৌঁছাতে হবে। কুষ্টিয়ার এক ভাই হাওরে গোসল করতে চাইল। শেষ পর্যন্ত নিরাপত্তার কথা ভেবে তার ইচ্ছাটা জলাঞ্জলি দিতে হলো। ফেরার সময় নৌকাযাত্রাটা ছিল আরও মধুর। সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় শীতল বাতাসের তীব্রতা বেড়ে যায়। সেই বাতাস শরীরে স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গেই সারা দিনের সকল ক্লান্তি মুহূর্তেই দূর হয়ে গেল। সূর্য অস্তের দৃশ্য দেখতে দেখতে আমাদের পথচলা আরও আনন্দময় হয়ে ওঠে। স্মৃতির পাতায় যুক্ত হয় সুন্দর একটি অপরাহ্ণের ছবি।
অন্ধকার নেমে আসার আগেই আমরা নিকলী ঘাটে চলে আসি। এবার আর ট্রেন নয়, বাসে উঠে বসলাম। জনপ্রতি ১০০ টাকা করে নিল। রাত ১০টায় নরসিংদীতে পৌঁছে যাই।

লেখকের ঠিকানা: নরসিংদী