নিরুদ্দেশ

অলংকরণ: তুলি

সকাল নয়টা, নীরু এখনো ঘুমাচ্ছে। তার চোখের মনি কাঁপছে। সে কি কোনো সুন্দর স্বপ্ন দেখছে? হয়তো কোনো নিশ্চিন্ত দুপুরে রিকশা করে যাচ্ছে… উপন্যাসের নায়িকাদের মতো নীল শাড়ি পরে। এত নিশ্চিন্তে এত সুন্দর স্বপ্ন! এক সপ্তাহ আগে যখন হঠাৎ সে আমার বাসায় হাজির হয়, তখন আমি বিন্দুমাত্র ভাবিনি যে নীরু এত নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবে। হয়তো আমার সব ধারণা ভুল। হয়তো নীরু খুব ভয়ানক একটা স্বপ্ন দেখছে। আর নিশ্চিন্তে ঘুম? নাহ্! সে তো কত বছরের ক্লান্তি।

হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল নীরুর। আমি ওর চোখের ওপর থেকে চোখ সরিয়ে নেওয়ার আগেই। কিছুটা বিব্রত বোধ করলাম। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য সকালের প্রথম মুচকি হাসি ছুড়ে দিলাম। নীরু উঠে সোজা রান্নাঘরে চলে গেল। পানি গরম বসিয়ে, ফ্রেশ হতে গেল। উফ! আমি ওকে এত খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছি কেন? আমি কি ওর প্রতি বিরক্ত? মা-বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে একাই থাকি। ভাই বিয়ে করে বউ নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। এই শহরে আমার আত্মীয়স্বজন কেউ নেই। বিয়ে করব না বলে সিদ্ধান্ত নেওয়ায় এই একাকিত্ব মোটামুটি স্থায়ী বলা যায়। তাই নীরুর এই অকস্মাৎ আগমন আমার স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করেছে বৈকি।

নীরুর সঙ্গে পরিচয় ক্লাস নাইনে। আমাদের স্কুলে ও নাইনে ভর্তি হয়। খুব ভালো বন্ধুত্ব কখনোই হয়নি আমাদের। ও সবাইকেই এড়িয়ে চলত। আমাদের বিদ্যালয়টি ছিল বালিকা বিদ্যালয়। কিসের যেন সংকোচ ছিল নীরুর। মেয়েদের সঙ্গেও স্বাভাবিক হতে পারেনি সহজে। ওকে কোনো দিন স্কুলে একা আসতে দেখিনি। প্রতিদিন ওর বাবা পৌঁছে দিত, না হয় বড় ভাই। টিফিনের সময় সব মেয়ে রাস্তার পাশের ফুচকার দোকানে ভিড় করত। সেখানেও নীরু কোনো দিন যায়নি। অন্তত আমি দেখিনি। বাসা থেকে খাবার নিয়ে আসত। এমন ভান করে খেত যেন কেউ ভাগ বসাবে, সেই ভয়। পরে বুঝেছিলাম, যা খাচ্ছে, তা কাউকে দেখানোর মতো নয়। দামে কিংবা গুণে সেটি ফুচকার চেয়ে অনেক অনেক নিম্নমানের। তবু নীরুর কোনো আক্ষেপ ছিল না; মানিয়ে নিত সবকিছু। জীবন যা দিয়েছে, সবটাই সয়ে গিয়েছিল ওর। আর ওর সহ্যের কথা কী বলব! যদি বলি সহ্যেরও তো সীমা থাকে; নীরুর জীবনে সেই সীমা খুবই জঘন্যভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে।

প্রায় প্রতিটি পরীক্ষার আগেই নীরুর বাবাকে ডেকে পাঠানো হতো। পরীক্ষার ফি কখনোই ঠিক সময়ে দিতে না পারার লজ্জায় নীরুর মুখ মলিন হয়ে যেত। আমাদের ক্লাসের প্রীতি ছিল সবচেয়ে ধনী পরিবারের মেয়ে। সে একদিন নীরুকে বলেছিল, ওর পরীক্ষার ফি দিয়ে দিবে। নীরু নেয়নি। কারও কাছে হাত পাতবে না। কত আত্মসম্মানবোধ! অথচ সবকিছু যেন কত বদলে গেছে। গতকাল নীরু আমার পার্স থেকে টাকা নিয়ে সবজি কিনে আনল। আমাকে একবার জিজ্ঞেস করারও প্রয়োজন মনে করেনি। আমার ওপর ওর এত কিসের অধিকারবোধ, বুঝি না। আমার নিঃসঙ্গতা ঘোচানোর জন্য যদি হয়ে থাকে, তাহলে বলব, এতে উপকার খুব একটা হয়নি। আমি একা থাকতেই পছন্দ করি। এক সপ্তাহ হয়ে গেছে, নীরু আমার বাসায়। আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না।
ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘কী ভেবে এই কাজটা করলি বল তো আমাকে।’
নীরু শব্দ করে হাসল। ‘কিছু ভাবিনি তো, তপুকে স্কুলে ঢুকিয়ে দিয়ে কিছু করার ছিল না, সোজা চলে এলাম তোর এখানে!’

কত সহজে বলে দিল। কিন্ত ঘটনাটা তো এত সহজ না। ছয় বছরের ছোট্ট ছেলেকে রেখে নীরু এক সপ্তাহ হলো আমার বাসায়। মা ছাড়া ছেলেটা কিছুই বোঝে না। ছেলেটা হয়তো মায়ের জন্য অস্থির হয়ে আছে। ওর স্বামীও হয়তো খুঁজে বেড়াচ্ছে ওকে। নীরু আমার এখানে আছে, সেটা হয়তো সে কখনোই ভাবতে পারবে না। নীরু এখন অন্য দুনিয়ায় আছে; বাস্তবের দুনিয়ায় ফিরলেই প্রথম সে মুখোমুখি হবে তার মা–সত্তার। সে তো মা! মায়েরা কি এমন করতে পারে? মায়েরা তো শুধু সয়ে যাবে।

নীরু বিয়ে করেছিল বাবার পছন্দ করা ছেলেকে। ছেলেটির না ছিল ভালো চাকরি, না ছিল সুন্দর চেহারা। সুখী হওয়ার কোনো কারণ ছিল না। তবু নীরু মেনে নিয়েছিল বরাবরের মতোই সবকিছু। এর চেয়ে ভালো ছেলে ওর বাবার পক্ষে জোগাড় করা সম্ভবও ছিল না। নীরু ছিল তার ওপর সবচেয়ে বড় বোঝা! নীরু বাবার কথার বাইরে যেতে পারেনি কখনোই। তাই সবকিছু মেনে নিয়েছিল। আর কলেজে যে সাদাসিধা ছেলেটি ওকে পছন্দ করত, প্রতিদিন স্কুল ছুটির পর গেটের সামনে অপেক্ষা করত, সেও শেষ পর্যন্ত নীরুর বাবার ভয়ে কিছু বলতে পারেনি। হয়তো ছেলেটি নীরুকেও ভয় পেত। নীরু তার পরিবারের আর্থিক অবস্থায় খুবই অখুশি ছিল। এ জন্য সবকিছু থেকে নিজেকে আড়ালে রাখতে চাইত। সে যেন কিছুই পায়নি; কিচ্ছু দেয়নি জীবন তাকে। তবু সব সয়ে নিয়েছিল।

ট্রেতে চা-বিস্কুট নিয়ে নীরু ঘরে ঢুকে আমাকে গভীর চিন্তায় মগ্ন দেখে পা দিয়ে মেঝেতে শব্দ করল। সেই শব্দে আমি আবার পৃথিবীতে ফিরে এলাম। নীরু বলল, ‘কী রে তুলি, কিসের চিন্তায় মগ্ন?’ আমি কোনো জবাব না দিয়ে চায়ের কাপ নিয়ে বারান্দায় এসে বসলাম। এতক্ষণে খেয়াল হলো, নীরু আমার জামা পডরে আছে। জামাটা এক ছাত্রী গত বছর উপহার দিয়েছিল আমাকে। আমার একদমই পছন্দ হয়নি। নীল রং আমার একদমই পছন্দ নয়। জানি না কেন! তাই ফেলে রেখেছিলাম। আর এটাই নীরু পরে আছে। ওর খুবই পছন্দ হয়েছে জামাটা। শুধু কি জামা? হয়তো নীরুর আমার জীবনটাই পছন্দ হয়ে গেছে; তাই আমার মতো থাকতে ও চলে এসেছে এখানে সবকিছু ছেড়ে। সংসারের নাগপাশ ছিঁড়ে ফেলে চলে এসেছে। আর শেষ রক্ষা হয়নি।

আমার বাসায় প্রথম যেদিন আসে, ঘরে ঢুকে বলেছিল, নিরুদ্দেশ হওয়ার জন্য চলে এসেছে। আমার বিশ্বাস হয়নি। আমি তো ওকে সাধারণ মেয়ে ভেবেছিলাম। যেমনটা ও আগে ছিল; কোনো অভিযোগ না করে জীবনের সবকিছু বয়ে বেড়াত। সেই নীরু অসাধারণ হয়ে উঠতে পেরেছে। ওর অসুন্দর, ভয়ানক চেহারার স্বামী এতই ভয়ানক হয়ে উঠেছিল যে নীরুর মতো মেয়েরও সহ্যের সীমা ছাড়াল। সবকিছু ভুলে ও হারিয়ে যেতে চাইল।

আমি নাকি মেয়ে হয়েও সেই অসাধ্য সাধন করেছি; আমার পাশে ভিড়তে দিইনি কাউকে। নীরু ভাবছে, আমিও নিরুদ্দেশে আছি। আচ্ছা, আমার কাছে কি নিরুদ্দেশ হওয়ার ঠিকানা আছে? আমি হতে পেরেছি কি? পারলেই বা কী সুখ পেলাম!

শিক্ষার্থী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট