একেবারে ছোটবেলার স্মৃতি আবছা বা স্পষ্ট যা যা মনে পড়ে, তা সবই সিলেটকে ঘিরে। বাবার চাকরির সুবাদে তখন আমরা বিআইডব্লিউটিএ কলোনির বাসিন্দা। তখনো স্কুলে ভর্তি হইনি। মাকে দেখতাম, একটু অবসর পেলেই হলুদ একটা নরম উলের বল পাশে নিয়ে লম্বা দুটি লোহার শিক দিয়ে কী জানি করেন। না তাকিয়েই দুই হাত দিয়ে দুই শিকের বুনন অটো চালাতেন। বিষয়টা যে সোয়েটার বোনা, তা বুঝতে পেরেছিলাম আরেকটু বড় হয়ে, স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর।
সিলেটে কয়েকজন তরুণ মুক্তিযোদ্ধা মিলে ‘শহীদ স্মৃতি প্রাথমিক বিদ্যালয়’ নামে একটা স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ওটাই আমার প্রথম স্কুল। ওই স্কুলে আমি আর আমার বড় বোনকে একই ক্লাস মানে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করে দেওয়া হয়। যদিও তখন আমার স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়নি, তবু যেতাম। ওপরে টিন, চারপাশে মুলিবাঁশের বেড়া আর নতুন মাটির ওপর সাজানো বেঞ্চিতে বসে ক্লাস করতাম। জীবনের প্রথম বন্ধু হয়েছিল ওই স্কুলে। ওর নাম শরীফ। স্কুলটিচার ছিলেন তরুণ মুক্তিযোদ্ধারাই। স্কুল মাঠে কিংবা তার আশপাশে একটা বড় শহীদ মিনার ছিল, সম্ভবত সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। ওখানে খুব ছোটবেলা থেকেই ২১ ফেব্রুয়ারিতে খালি পায়ে মায়ের হাত ধরে ঘুম ঘুম চোখে ভোরবেলায় প্রভাতফেরি করে ফুল দিতে গিয়েছিলাম বলে জায়গাটাকে আপন মনে হতো। সিলেট অধ্যায়ে কোনো একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরি মিস হয়নি।
কলোনির সমবয়সী শরীফ আর শিউলির সঙ্গে বন্ধু নামক নতুন সম্পর্ক যখন বুঝতে শুরু করলাম, স্কুলের প্রতি আর সিলেটের প্রতি মায়া জন্মানো শুরু হলো, ঠিক তখনই বাবা আবার ট্রান্সফার হয়ে গেলেন ঢাকা। আমরা তো কোনোভাবেই এই মায়া ছেড়ে ঢাকা আসব না, কান্নাকাটি করে প্রতিবাদ করলাম। বাবা বললেন, জন্মের পর থেকে আমরা ঢাকায় ছিলাম। বাবাও ছোটবেলা থেকে ঢাকায় বড় হয়েছেন, সেখানে আমার অনেক অনেক খেলনা রাখা আছে। খেলনার লিস্ট শুনে রাজি হলাম ঢাকা আসতে। গাড়িতে সময়ই কাটছিল না, কখন ঢাকা পৌঁছাব, কখন খেলনা হাতে পাব।
ঢাকা পৌঁছে খেলনা চাইতেই বাবা বললেন, ‘সব আছে।’ আমার মনে না থাকা শৈশব কেটেছিল ওয়ারীতে, ওখানেই নাকি আছে। ছোট্ট আমি বাবার কথা বিশ্বাস করেছিলাম। ওটা যে ছেলে–ভোলানো প্রতিশ্রুতি ছিল, কয়েক বছর পর বুঝতে পেরে কষ্ট পেয়েছিলাম। মা ঢাকায় ফিরেও সেই সোয়েটারটা বানাচ্ছিলেন। তত দিনে একটা শেইপ বোঝা যাচ্ছিল। হলুদ রঙের সুন্দর ডিজাইন করা হাফ সোয়েটারটা বানাতে মায়ের সময় লেগেছিল তিন-চার বছর। ৩১ মাদারটেক, হাফিজউদ্দিন মাস্টারের বাড়ির দেড় রুমের ভাড়া বাসায় হয় ঢাকায় আমাদের প্রথম ঠিকানা। মাদারটেকের একমাত্র স্কুল মাদারটেক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্লাস ওয়ানে ভর্তির মাধ্যমে আমার স্কুলজীবন আবার শুরু হয়। আমি ভর্তি হই ওয়ানে, বড় বোন ডেইজী আপা ক্লাস টুতে। তত দিনে খেলনার কথা ভুলে যাই কিংবা আশা ছেড়ে দিই।
ক্লাস টু বা থ্রিতে পড়ার সময় মা অক্টোবরের কোনো এক শীতের সকালে আমাকে সেই হাফহাতা হলুদ সোয়েটারটা পরিয়ে দেন। আমি খুব অবাক হই। সোয়েটারটা কার জন্য বানানো হচ্ছিল আন্দাজই করতে পারিনি। মায়ের এত মমতা, যত্ন আর সময় নিয়ে বানানো সোয়েটারটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সোয়েটার, শ্রেষ্ঠ উপহার। খেলনার কষ্ট ভুলিয়ে দিয়েছিল সোয়েটারটা। যত দিন গায়ে লেগেছে পরেছি, তারপর স্মৃতি হিসেবে রেখে দিয়েছিলাম অনেক বছর। তখন নিয়ম করে সেপ্টেম্বরের শেষ থেকে শীত শুরু হতো। অক্টোবরে হাফ সোয়েটার পরার মতো শীত পড়ত। আমি প্রিয় হলুদ সোয়েটারটা পরতাম। শর্ষে ফুল যেমন ছোট ছোট পোকা ঘিরে থাকে, সোয়েটারটা পরলে কোত্থেকে যেন একঝাঁক ছোট ছোট পোকা এসে আমাকে ঘিরে ধরত। বিরক্ত লাগত, তবু পরতাম। এই সোয়েটারের প্রতিটা বুননে আন্তরিকতা আর মমতা মিশে আছে, অনেক অনেক গল্প লুকিয়ে আছে। পৃথিবীতে এই সোয়েটার একটাই, এর দ্বিতীয় কোনো কপি নেই। এমন ইউনিক কিছু এখন আর পাওয়া যায় না। দামি ব্র্যান্ডের মূল্যবান অনেক কিছুই পাওয়া যায়, অমূল্য কিছু পাওয়া যায় না। আমি অমূল্য আর আন্তরিকতা খুব মিস করি।