কত সহজে তিনি হৃদয়ে পৌঁছে যান

সৈয়দ শামসুল হকফাইল ছবি

লেখালেখির জগৎ অন্য রকম, কঠিন। নানা কাটাছেঁড়া ও বহু ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর কলম চলতে শুরু করে। ছোট্ট একটি ভাবনা থেকে সৃষ্টি হয় গল্প, কবিতা, উপন্যাসসহ সৃষ্টির নানা কারুকাজ। তবে এই বন্ধুর পথ তুলনামূলক সহজ হতে পারত, যদি অঙ্ক, ইংরেজি ও বিজ্ঞান শিক্ষার মতো লেখালেখির শিক্ষক পাওয়া যেত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে লেখালেখির সাধারণ নির্দেশনা ধরিয়ে দেওয়ার জন্য শুরুর দিকে কেউ এগিয়ে আসে না। তাহলে কীভাবে কেউ লেখা শেখে? উত্তরে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের কথায় উদ্ধৃতি দেওয়া যাক। ‘মার্জিনে মন্তব্য’ বইয়ের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, ‘লেখা শেখা হয় অন্যের লেখা পড়ে, শেখা চলে পড়তে পড়তে, লিখতে লিখতে। পড়ারও দুরকম আছে। শুধু যে ভালো লেখকের লেখা পড়ে শেখা যায় তা নয়, খারাপ লেখকের কাছেও শেখবার আছে। তাঁর কাছে শেখা যায় সবচেয়ে বড় শেখা যে ওই রকম লিখতে নেই। ভালো খারাপ দুজাতের লেখকই আমাদের শেখান।’

নিয়মিত লেখা ও পড়ার পাশাপাশি লেখক হওয়ার জন্য প্রয়োজন একজন পরামর্শক তথা শিক্ষকের। আর এই পরামর্শক বা শিক্ষকের অভাব বোধ করি সৈয়দ শামসুল হকের ‘মার্জিনে মন্তব্য’ বইটি দিয়ে পুষিয়ে নেওয়া যায়। অর্থাৎ একজন নবীন লেখকের জন্য ‘মার্জিনে মন্তব্য’ বইটি হতে পারে শিক্ষক। যদিও লেখক বলেছেন, ‘লেখা শেখার বই এটি কোনোমতেই নয়। বরং একে লেখার কলাকৌশলের দিকে আমাদের চোখ ফেরাবার বই বলা যেতে পারে। আমি কিছু সংকেত ও ভাবনা উপস্থিত করতে চেয়েছি। আশা এই, এ থেকে একজন নবীন লেখক উদ্বুদ্ধ হবেন আরও অনেক গভীরে ভাবতে এবং নিজের কলমের দিকে তাকাতে।’

সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক নবীন লেখকদের পথ যেমন সহজ করার চেষ্টা করেছেন, তেমনি নিজের অনুবাদের দক্ষতা দিয়ে অনুবাদ সাহিত্যের প্রতি অনুপ্রাণিত করেছেন তরুণদের। ‘হাফিজের কবিতা/ সরাই শরাব সাকি: তৃষিতের ঠোঁট’ পড়ার পর এমন অনুভূতি হয়েছে।

কবে পড়েছিলাম ঠিক মনে নেই, ডায়েরিতে কথাগুলো নোট করা ছিল, ‘প্রতিদিন আমি তাঁর জন্যে প্রতীক্ষা করি, যেমন পারঘাটায় যাত্রী, সে আসে না। প্রতিদিন আমি তাঁকে আশা করি, যেমন এক গৃহস্থ লটারির টিকিট কিনে আশা করে সে আসে/সে আসে না।’ ‘পূর্ণিমায় বেচাকেনা’ শিরোনামের একটি গল্পে লিখেছেন সৈয়দ শামসুল হক।
অহেতুক ভার নেওয়ার অভ্যেস আছে আমার। অবাক হচ্ছেন নিশ্চয়ই! সত্যি বলছি, যে কোটেশন বা কবিতার পঙ্‌ক্তিগুলো খুব ভালো লাগে, ডায়েরিতে নোট করার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো আমি মাথায় রাখার চেষ্টা করি। হ্যাঁ, সহজ বাংলায় মুখস্থ করি। এই যেমন সৈয়দ শামসুল হকের ওই কবিতা প্রথম যখন পড়েছিলাম। কী যে আনন্দ হয়েছিল, লিখে বা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। কবিতাটির কয়েকটি পঙ্‌ক্তি উল্লেখ করলে কিছুটা বুঝতে পারবেন—
‘আমি কার কাছে গিয়া জিগামু সে দুঃখ দেয় ক্যান?
ক্যান এত তপ্ত কথা কয়, ক্যান পাশ ফিরা শোয়,
ঘরের বিছন নিয়া ক্যান অন্য ধান খ্যাত রোয়?
অথচ বিয়ার আগে আমি তার আছিলাম ধ্যান।’

ঠিক ধরেছেন। এবার ‘পরানের গহীন ভিতর’ নিয়ে অনুভূতির কথা বলব। বইটি প্রথম পড়েছিলাম স্নাতক প্রথম বর্ষে। এখন আমি চতুর্থ বর্ষে। তিন বছরের বেশি সময়ের ব্যবধান। আবারও পড়লাম। সেদিনের ভাবনা ও অনুভূতির মধ্যে কী বিশাল ব্যবধান। আঞ্চলিক ভাষার প্রতিটি কবিতা হৃদয়ে এক গভীর হিল্লোল তোলে। মনে হয়, কবি যেন আমার হৃদয়ের কথাগুলো পড়ে ফেলেছেন। তারপর বর্ণবিন্যাসে কলম বুলিয়ে লিখেছেন, তা–ও আমারই জন্য। ‘এ বড় দারুণ বাজি, তারে কই বড় বাজিকর/ যে তার রুমাল নাড়ে পরানের গহীন ভিতর।’ কি, পঙ্‌ক্তি দুটি পড়তেই চিরচেনা, অত্যন্ত কাছের, আপন মনে হচ্ছে না? নিশ্চয়ই হচ্ছে। এ কারণে সৈয়দ শামসুল হক সব্যসাচী। কোথায় নেই তিনি? সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি ধারা তাঁর পরশে সমৃদ্ধ হয়েছে। জীবনের হাসি-আনন্দ, বিরহ, পাওয়া-না পাওয়া সব অনুভূতি কতটা আপন করে বর্ণবিন্যাসে তিনি এঁকেছেন, কত সহজেই তিনি হৃদয়ে পৌঁছে যান, তাঁর লেখা না পড়লে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়।

বাংলা সাহিত্যের আকাশের ধ্রুবতারা সৈয়দ শামসুল হক ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা কুড়িগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ভাইবোনদের মধ্যে সৈয়দ হক ছিলেন সবার বড়। তাঁর প্রথম লেখা প্রকাশ হয় ‘অগত্যা’ নামের একটি ম্যাগাজিনে। এরপর ধীরে ধীরে আকাশের মতো বিশাল হয়ে ওঠেন। কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কারসহ অনেক পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।

কথায় আছে—মানুষ বাঁচে তার কর্মে, বয়সে নয়। একদিন প্রত্যেককেই চলে যেতে হয়, যেতে হবে। সৈয়দ শামসুল হক ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর না–ফেরার দেশে পাড়ি জমান। কিন্তু তাঁর সৃষ্টির জন্য তিনি চিরদীপ্তিমান। তাঁর লেখা পাঠককে ভাবায়, হৃদয় তৃপ্ত হয়; নবীন লেখকেরা শেখে, কীভাবে লিখতে হয়। যুগ থেকে যুগে এ ধারা অব্যাহত থাকবে। বিশাল আকাশ আলোকিত করা সূর্যের মতো সৈয়দ শামসুল হকও চিরদিন দীপ্তিমান থাকবেন।