পাহাড়ের সবচেয়ে উঁচুতে উঠে শরীরটা কেমন জানি হালকা হয়ে গেল। পাহাড়ি এক বন্ধু আমাকে বিশেষ পানীয় দিয়েছিল। সেটা পান করলে নাকি নিমেষেই ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। বন্ধুর অনুরোধে পানীয়টা মুখে দিলাম। কোনো স্বাদ পেলাম না। তবু ডগডগ করে পুরো বোতল সাবাড় করে ফেললাম। চোখ ঝাপসা হয়ে ঝিমুনির মতো মাথা ঘুরতে লাগল।
দেখলাম আমাদের গ্রামের গোরস্তানের পাশে আছি। গোরস্তানের পাশে পিএসজি বনাম লিভারপুলের খেলা চলছে, ২-২ গোলে সমতা। মনে পড়ল আব্বা বেঁচে থাকলে তাঁকে ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে দাঁড় করিয়ে দেওয়া যেত। পোস্টার টানাতাম মানুষের বাড়িতে বাড়িতে। সবাই বলত ভোট দেবে। আসলে তো দেবে না। শোনে শোনে ভাবতাম সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আব্বা চেয়ারম্যান নিশ্চিত।
এমন সময় খেয়াল করলাম আমি ত্রিশাল ইউনিভার্সিটিতে আহাদের সঙ্গে দেখা করতে গেছি। বসে আছি ক্যানটিনের পেছনে ঘাসের ওপর। অপ্রয়োজনীয় সব আলাপে মশগুল। আলাপে ছেদ কাটল যখন জানতে পারলাম ক্যানটিনের নতুন মালিক বনে গেছে ক্যানটিন বয় শুভ। নামটা সিফাতও হতে পারে, মনে পড়ছে না। মানুষের নাম আমার এমনিতেও মনে থাকে না। চেহারা দেখি, নাম আসলে দেখি না। ওই যে কারও সঙ্গে নতুন দেখা হলে হ্যান্ডশেক করে বলি, ‘আমি সবুজ।’ অন্যরা যেমন বলে আমি মিস্টার বিন বা হিটলার। ওদেরটা আসলে মনোযোগ দিয়ে শুনি না। সাধারণ ভদ্রতা হিসেবেই নাম বলাবলি, শোনাশুনি আমার ধারণা। আমিও এত আস্তে বলি, যাতে ওরা না শোনে। ওই ক্যানটিন বয় আহাদের সঙ্গে দেখা করতে আসে। বলে ভাই, ‘কিনে ফেললাম।’ আহাদ বলে, ‘এখন তো আর ১০-১৫ টাকায় টিপস দেওয়া যাবে না। ২০-৩০ টাকা দেওয়া লাগবে। মালিক বলে কথা।’ ও লজ্জা পেয়ে একটা হাসি দেয়।
আমি জিজ্ঞেস করি তোমার দেশের বাড়ি কই। সে বলে বসন্তি। ময়মনসিংহ বা শেরপুর বলেনি। কারণ, বসন্তি আমাদের গ্রামের পাশের গ্রাম। হুতি নদী পার হলেই বসন্তি। সে জানে আমার বাড়ি ওদের আশপাশেই কোথাও। তাই গ্রামের নামই বলে প্রথমে। আমি বলি, আরে কও কি। আমার বাড়ি তো শিকদারপাড়া। চেনো? ও বলে, না । জন্মের পর থেকেই সে ত্রিশাল থাকে। ছেলেটার বয়স ৯ বা ১০ বছর হবে। বুঝলাম না চেনাও ঠিক আছে। আমার বাড়ি শিকদারপাড়া বলার একটা কারণ আছে। বসন্তি আর শিকদারপাড়া একদম গাঘেঁষা গ্রাম। একবার গুলশান-বাড্ডার গুদারাঘাটের পাশে চিকন জিলাপির দোকানে জিলাপি খাচ্ছিলাম। ওখানে যে কাজ করে ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করি, ‘তোমার বাড়ি ভোলা না? ছেলেটা আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করে আপনি জানলেন কেমনে? আমি বললাম, আমার বাড়ি চরফ্যাশন। তোমারে ভোলা দেখছি একদিন।’ যদিও সব কথাই মিথ্যা। মাঝেমধ্যে ঝড়ে বক মরে আর আমি ফকিরের কেরামতি বাড়ে।
নোয়াখালী, বরিশাল আর ময়মনসিংহ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে আছে আরেক আশ্চর্য ব্যাপার। লক্ষ্মীপুর আর রায়পুর যেখানেই বাড়ি হোক, বলে নোয়াখালী। ভোলা-পটুয়াখালী যেখানেই হোক বলে বরিশাল। শেরপুর-জামালপুর কিংবা ময়মনসিংহ যেখানেই হোক বলে ময়মনসিংহ।
যাহোক, আহাদের রুমের দিকে যাচ্ছিলাম। রুমের কাছাকাছি গিয়ে খেয়াল করলাম পায়ে জুতা নেই। আহাদ বলল, ‘একজনকে ফোন দিয়ে আনতে বলি। আমি বলি, না, আমার জুতা অন্য কেউ হাতে করে আনতেছে ব্যাপারটা দৃষ্টিকটু হবে। থাক। আমিই গিয়ে নিয়ে আসি।
এরপর দেখি আমি দুবাই এয়ারপোর্টে। দেখলাম একটা মেয়ে তার লাগেজ ব্যাগেজ টেনে নিয়ে আসতে পারছে না। এয়ারপোর্টের একজন কর্মচারী তাকে হেল্প করছে। এটা দেখে পাশের যাত্রী বলছে দুবাই এয়ারপোর্ট বলে এই অবস্থা। বাংলাদেশ হলে এটা সম্ভব হতো না। বাংলাদেশে তো উল্টা ব্যাগ হারিয়ে যায়। ব্যাগের অবস্থাও ঝাঁকিয়ে টাকিয়ে ছ্যাড়াব্যাড়া করে ফেলে।
সবার ব্যাগ চেক করে। একজন অফিসার কী জানি লেখে পাস দিয়ে দিচ্ছে। একজন বলল, তার ব্যাগে কাচের বোতল আছে। সাবধানে। মদ না, একটা ফলের জুস। হেসে তাকে পার করে দিল। আরেকজন জুসের বোতল আগেই হাতে নিয়ে টেবিলে রাখল। অফিসার তার দিকে কটমট করে তাকাল। আমি একটু একটু ভয় পাচ্ছিলাম। আমার ব্যাগে তো ৬টা ৬০০ এমএলের বিয়ার। আটকায়ে দেবে নাকি?
এমন সময় দেখলাম আমি ব্লাড ডায়মন্ড সিনেমা দেখছি থিয়েটারে। এরপর মনে হলো ডি ক্যাপ্রিওর সঙ্গে সিয়েরা লিওন আছি। একই সঙ্গে আফসোস করছিলাম এই ভেবে যে এই সিনেমা করেও বেচারা অস্কার পায়নি!