মা,
এখানে যখন প্রচণ্ড বৃষ্টি, তোমার ওখানে তখনো প্রচণ্ড রোদ। তুমি জানো না আমি বৃষ্টিতে ভিজছি নাকি রোদে–গরমে ঘেমে চলছি। মা, আমি তোমার থেকে কয়েক শ মাইল দূরে। তবু তোমার শূন্যতা ভীষণভাবে অনুভব করি।
মা, কাউকে আর বলতে পারি না দুধের গ্লাসটা আমার টেবিলে দিয়ে যাও। সন্ধ্যাবেলা কিছু নাশতা দাওনি এমন দিন যায়নি। আর এখন কেউ হাবিজাবি খাবার এনে টেবিলে রেখে যায় না।
মশারির ছিদ্রগুলো বড় হয়ে মশা ঢুকে রাতভর কামড়ায়। তুমি ছাড়া সেই ছিদ্রগুলোর খবর কেউ রাখে না। মা, আমি আর কারও সঙ্গে রাগ করতে পারি না, বকাবকি করতে পারি না। আমি বলতে পারি না আমার রুমটা ঝাড়ু দিয়ে বিছানাটা পরিষ্কার করে রেখো। ঘুরেফিরে রুমে এলে কেউ জিজ্ঞেস করে না কোথায় ছিলি?
আমার ভীষণ একা লাগে। বাড়িতে থাকলে তোমার মুখটা দেখলে ভীষণ শান্তি পাই! রাজ্যের হতাশা কেটে যায়। ভাত খেতে খেতে ছেলেমানুষি কথাগুলো কেউ শোনে না আর।
আমি বাইরে ঘুরছি ফিরছি। এদিকে বৃষ্টি চলে আসছে। দড়িতে শুকাতে দেওয়া কাপড়গুলো ভিজে আছে সব। অথচ কেউ রাখেনি খবর। তখন তোমার শূন্যতা খুব করে অনুভব করি। বাড়িতে থাকতে এমন হয়েছে কখনো? বলো তুমি!
মা, ঘুমিয়ে ক্লাস মিস হয়, কেউ ডেকে দেয় না। সকাল ১০টা পেরিয়ে ১১টা বাজে, নাশতা করা হয়ে ওঠে না। কেউ চেঁচামেচি করে বলে না যে ‘এখনো খাস নাই’। মা, তরকারি পছন্দ না হলে কাউকে অভিযোগ করতে পারি না। নীরবে বালতিতে ফেলে আসি সব। কেউ দেখেনি, রাখেনি সে খবর।
মা, সন্ধ্যা হলে কেউ চিতইপিঠা বানিয়ে ডাকে না, নুডলস রান্না করে না। চ্যাপা শুঁটকির ভর্তা, কালিজিরাভর্তা, টাকি মাছের ভর্তা—এসবের স্বাদ ভুলে গেছি। খুব খিদে আমার, তোমার হাতের ভর্তায় এক প্লেট ভাত খাব। কবে সে সুযোগ হবে জানি না!
মা, জানো, অগোছালো বিছানা, অগোছালো টেবিল, বইপত্র জামাকাপড় রুম ভর্তি ছড়িয়ে থাকে। কেউ একবারও বকেনা আমায়। আমার কোনো আবদার, পেটের খিদের বায়না আমি কারও কাছে করতে পারি না আর। রাত হয়, কেউ খেতে ডাকে না। বলে না ‘তাড়াতাড়ি খেয়ে যা, আমি শুয়ে পড়ব।’ আমি দেরি করেই চলি, অথচ কেউ বকে না আর!
মা, জীবন আমাকে অনেক স্বাধীনতা দিয়েছে। কিন্তু তোমার আদরযত্ন থেকে বঞ্চিত করছে। বিশ্বাস করো মা, আমি ভালো নেই। স্মৃতির পৃষ্ঠা খুলে যখন পেছনে যাই, তখন খুব মনে পড়ে, চোখে জল এসে বড্ড আবেগপ্রবণ হয়ে যাই।
আজ তিন দিন অসুস্থ তুমি। বিছানায় কাতরাচ্ছ। জ্বরে তোমার গা পুড়ে যাচ্ছে। অথচ আমি পাশে নেই। একটা ট্যাবলেট এনে দেওয়া কিংবা মাথায় পানি দেওয়া—কিছুই করতে পারি না আর। তুমি হাসপাতালে যাও, ডাক্তার দেখাও, এক্স–রে করাও—সব একা একা। তোমার ছেলেটি পাশে নেই। মাগো, আমি ভালো নেই, বড্ড কষ্ট হয়। ভেতরটা ভেঙে চুরমার হয়। কখনো বলতে পারি না তোমায় ভালোবাসি। অথচ ভেতরটাজুড়ে তোমার প্রতি অকৃত্রিম মায়া। আমি যে তোমার নাড়ির সন্তান! মা, দয়াময় প্রভু সুস্থ রাখুক তোমায়।
মা, এ চিঠি পৌঁছাবে না তোমার কাছে। তবু তো সজল চোখে তোমায় ভেবে দুকলম লিখতে পারি। মা, তুমি সেরে ওঠো। তুমি সেরে উঠলেই আমি ভালো থাকি...
স্নেহ–আদুরে তোমার একমাত্র ছেলেটি
তৌফিক
কার্যনির্বাহী সদস্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা