শৈশবের স্বপ্ন আর প্রতিজ্ঞা পূরণের গল্প

নিজ উপার্জনের টাকায় বাবাকে নিয়ে প্রথমবার উড়োজাহাজে চড়া। ছবিতে বাবার সঙ্গে লেখকছবি: সংগৃহীত

ছেলেবেলা থেকেই বই পড়ার অভ্যাস। তখন থেকেই ভ্রমণকাহিনিসহ অন্যান্য লেখায় লেখকদের দেশ-বিদেশের সুন্দর সব জায়গার বিবরণ পড়ে সেসব জায়গায় যেতে খুব ইচ্ছা হতো। নতুন নতুন জায়গা দেখা, সেখানকার মানুষ, ভিন্ন সংস্কৃতি, জীবনবোধ ইত্যাদি নিজ চোখে দেখার জন্য উদ্‌গ্রীব থাকতাম। কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে আমি, পরিবারের কাছে ঘুরতে যাওয়ার আবদার করলে শুনতে হতো সেই চিরায়ত ডায়ালগ—‘বিয়ের পর জামাই নিয়ে ঘুরিস’।

কথাটা এতটাই ক্ষুব্ধ করল যে প্রতিজ্ঞা করলাম, ‘বিয়ের পর জামাই নিয়ে ঘুরিস’ ধারণাটা ভাঙতেই হবে। স্বপ্ন বোনা শুরু করলাম। প্রথমবার উড়োজাহাজ আর বিদেশভ্রমণ করব তো নিজ উপার্জনের টাকায়। স্বপ্নটা আরও বর্ধিত হলো যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সেমিস্টারে পাভেল স্যার বললেন, ‘উপার্জনক্ষম হয়ে মা-বাবাকে উড়োজাহাজে করে ঘুরতে নিয়ে যাবে।’ মনের মধ্যে একদম ঢুকে গেল ব্যাপারটা।

ভাবলাম এটাই করব, কিন্তু স্বপ্নপূরণের পথ তো মসৃণ নয়। নানা বাধা-বিপত্তির মুখোমুখি হতে হয়। আমিও এর ব্যতিক্রম নই। ২০১৯ সালে জীবনের সবচেয়ে বড় ধাক্কা হয়ে আসে আম্মুর মৃত্যু। জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান মানুষটাকে হারিয়ে একদম ভেঙে পড়ি। এর কিছুদিন পরেই করোনার আঘাত। শিক্ষাবর্ষে পিছিয়ে পড়ি। হতাশা বাড়তে থাকে। স্বপ্ন পূরণ করতে পারব কি না, তা নিয়ে সন্দেহ হতে থাকে।

এ সময় আম্মুর একটা কথা মনে হয়। আম্মু বলত, ‘ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। তবে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়।’ মনে একটা জোর এল, আমিও পারব। হতাশ না হয়ে আবার চেষ্টা শুরু করি। স্নাতক শেষ করি। এবার নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। চাকরি খোঁজা শুরু করি। বেশ কিছুদিন চেষ্টার পর পেয়েও যাই একটা। ছোট চাকরি, অল্প বেতন। তবে আশা অনেক বড়। প্রতি মাসে অল্প অল্প করে টাকা জমাতে শুরু করি। দীর্ঘ আট মাস পর বিমানের টিকিট আর ভ্রমণের জন্য পর্যাপ্ত টাকা জমাতে পারি। পরিকল্পনা করলাম, বিমানে চড়ে সিলেটে যাব।

বিমানের টিকিট কাটাসহ ভ্রমণের সব পরিকল্পনা করে ফেলি। নির্দিষ্ট দিনে সময়মতো হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অভ্যন্তরীণ লাউঞ্জে পৌঁছে যাই। বিমান এক ঘণ্টা দেরিতে আকাশে উড়বে। অপেক্ষার প্রহর আরও বাড়ল। সময়মতো বিমানে উঠে বসলাম। অপেক্ষা করতে লাগলাম আকাশে ওড়ার। উত্তেজনা বাড়ছিল। কিছুক্ষণ পর আকাশে ওড়ার ঘোষণা দিলেন পাইলট। সিটবেল্ট বেঁধে তৈরি আকাশে ওড়ার জন্য। অবশেষে প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে উড়ে চললাম মেঘের ওপর দিয়ে। উড়লাম আর পাখির চোখে দেখলাম আমার দেশকে। উপলব্ধি করলাম, আমার মাতৃভূমি কত সুন্দর!

সিলেটের রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্টে বাবার সঙ্গে লেখক
ছবি: সংগৃহীত

ওপর থেকে দেখে বুঝলাম, বাংলাদেশ এখনো অনেক সবুজ। প্রচুর গাছপালা, বিস্তীর্ণ ফসলি জমি, আর নদী-খাল-বিল ছড়িয়ে আছে দেশজুড়ে। বিমানের জানালা থেকে চোখ সরাতে পারছিলাম না। বাংলার রূপে মুগ্ধ হয়ে যাই।

৪০ মিনিট পর বিমানযাত্রা শেষ হলো। ওসমানী বিমানবন্দরে অবতরণ করলাম। এখান থেকে আমরা চলে গেলাম শাহজালাল (রা.) মাজারে। সেখানে মাজার জিয়ারত ও জোহরের নামাজ আদায় করি। দুপুরের খাবার খেয়ে যাত্রা করলাম রাতারগুলের উদ্দেশে। নৌকায় করে ঘুরে দেখলাম সোয়াম্প ফরেস্ট।

‘আমার মন বসে না শহরে ইট পাথরের নগরে/তাই তো আইলাম সিলেটে, তাই তো আইলাম সিলেটে’ মাঝির মুখে পল্লিগীতি শুনতে শুনতে পুরো বিকেল ঘুরে দেখি। ফেরার পথে সন্ধ্যা নেমে আসে। ধীরে ধীরে রাত নেমে আসে সিলেটের বুকে। হাজার বছরের সেই রাত। আর আমরা ফিরে চললাম বাড়ির দিকে। সঙ্গে নিয়ে চললাম দারুণ এক অভিজ্ঞতা আর স্বপ্নপূরণের তৃপ্তি।

বন্ধু, গাজীপুর বন্ধুসভা