খান আতার ছবি দেখতে বসব মানেই মনে মনে আগে থেকে জেনে বসি যে চিত্রায়ণের ছন্দে–গীতিতে ভরপুর, নিপুণ আনন্দ বিনোদনের একটি ছবি উপভোগ করতে চলেছি।
প্রতিটি দেশের আঞ্চলিক রূপকথা, লোককথার মধ্যে সেই দেশের ঐতিহ্য, সংস্কৃতির আবহমানকালের জীবনধারার অন্তর্নিহিত প্রাণশক্তি লুকিয়ে থাকে। বাংলাদেশে ছোটবেলা থেকে আমরা যেমন টোনাটুনির গল্প শুনতে শুনতে বড় হই। এরপর হাজারো রূপকথা ও লোককথার গল্প শুনতে শুনতে আমাদের কল্পনার জগৎ প্রসারিত হয়। আবার রূপকথার সঙ্গে বাস্তবের টানাটানিতে হাবুডুবু খেতে খেতে অলৌকিক, অবাস্তবগুলোকে ছেঁটে ফেলে যুক্তির পথ ধরে একসময় চলতেও শিখে যাই। রূপকথা তবু আমাদের জীয়নকাঠি। অনাবিল আনন্দধারার স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে চলার কাহিনি।
বহুমুখী গুণের অধিকারী খান আতাউর রহমান ১৯৬৮ সালে সেই রূপকথা-লোককথার গল্পের সমাহারে চলচ্চিত্রে বাস্তব রূপ দিলেন। চলচ্চিত্রের নাম ‘অরুণ বরুণ কিরণমালা’। সুন্দর চিত্রনাট্য সাজিয়ে নিপুণ সংলাপ বুনেছেন, যথারীতি অন্য চলচ্চিত্রের মতো এটির জন্যও গান লিখে সংগীত পরিচালনা করেছেন। খান আতার ছবি দেখতে বসব মানেই মনে মনে আগে থেকে জেনে বসি যে চিত্রায়ণের ছন্দে–গীতিতে ভরপুর, নিপুণ আনন্দ বিনোদনের একটি ছবি উপভোগ করতে চলেছি।
এই চলচ্চিত্রে খান আতা নিজেও একজন দরবেশের চরিত্রে অভিনয় করেন। মূল গল্পের শুরু থেকে শেষের যোগসূত্রে যেন সূত্রধরের কাজ করেছেন তিনি। ছবিতে কিরণমালা হিসেবে পেয়েছি তরুণী অভিনেত্রী কবরীকে। বাদশাহ বাহাদুর ছিলেন আনোয়ার হোসেন। পরবর্তী সময়ে একই চিত্রনাট্য, সংলাপ ও কাহিনির অন্য কলাকুশলীদের নিয়ে কিছুটা সংশোধিত ও রঙিন আরও একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছিল। সেই চলচ্চিত্রে আবার দরবেশের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন আনোয়ার হোসেন। খান আতার ১৯৬৮ সালের সাদা–কালো এই চলচ্চিত্রের অভিনয়শিল্পী ও কলাকুশলীরা হলেন আতিয়া চৌধুরী, রাজ, আরমান, মান্নান, রাণী সরকার, বুলবুল ইসলাম, রাজা, রবিউল আলম, আবদুল মতীন, আক্তার আব্বাস, নজরুল, মহিউদ্দিন, জুয়েল, মিথুন, ডিউকসহ অনেকে। অসাধারণ গানগুলো রচনা করেছেন খান আতাউর রহমান, সিরাজুল ইসলাম ভূঁইয়া ও মমতাজ আলী খান। গানে কণ্ঠ দিয়েছেন আবদুল আলীম, আবদুল হাদী, নীলুফার ইয়াসমিন, সাবিনা ইয়াসমিন, লাভলি ইয়াসমিন, রেবা খান, দিলারা মাসুমা, মিথুন রহমান, পিলো ও দীপক।
এক পরিবারের তিন বোনের গল্প নিয়ে বাস্তবের পরিসরে প্রবেশ। বাবা দ্বিতীয় পক্ষ করেছিলেন, একজন সৎবোন আছে। প্রথম পক্ষের দুই বোন প্রয়াত বাবাকেও গালাগাল দেয়। ওরা পায়ের ওপর পা তুলে বসে খায়, সারাক্ষণ পরনিন্দা ও পরচর্চা করে, সৎবোনের পরিশ্রমে অন্ন থেকে পান সবকিছু জোটে, তাকেই আবার কথায় কথায় তিরস্কার ও অত্যাচার করে। সেই বোন এতটাই মুখচোরা যে নীরবে সব সহ্য করে যায়। এতটাই মায়াবী ও সংবেদনশীল যে নিজের মুখের অন্ন ফকিরকে দান করে। সেই দরবেশ ফকির বলে, ‘নিজের মুখের অন্ন দান করলি মা, আল্লাহ তোকে রাজরানি করবে।’
বাদশাহ বাহাদুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু উজিরকে নিয়ে উজিরের পরামর্শে পূর্বপুরুষ ও খলিফাদের মতো ছদ্মবেশে রাজ্য ভ্রমণে বের হন—সবার অভাব–অভিযোগ ও মনের কথা নিজের কানে শুনে বিহিত করবেন বলে। রাজার রাজ্যে কেউ অসুখী থাকবে না। যাদের সঙ্গে দেখা হয়, সবার কাছে নিজেদের পরিচয় দেয় রাজদরবারের সামান্য কর্মচারী হিসেবে। প্রত্যেকের সমস্যার কথা শুনে রাজদরবারে ডেকে নেয়। পরদিন প্রত্যেকে দরবারে এসে স্বচক্ষে বাদশাহকে দেখে অবাক। বাদশাহ বৃদ্ধ গোয়ালা-দইওয়ালা পরমেশ্বর ঘোষকে দোকান করার জন্য ১০টি স্বর্ণমুদ্রা দেন। কাউকে আস্তানা গড়ার জন্য জমি দেন। বেদে সম্প্রদায়ের মানুষেরাও তার অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হন না। সেই কূটনীতিক দুই বোনেরও তাদের ইচ্ছেমতো রাজপরিবারের কর্মচারীর সঙ্গে বিয়ে হয়। একজনের ইচ্ছা ছিল বাদশাহ বাহাদুরের চাকরের সঙ্গে বিয়ে হলে মনের সুখে পান খেতে পারত। অন্যজনের ইচ্ছা রাখালের সঙ্গে বিয়ে হলে নাকের শোলার কাঠিটা ফেলে চুঙ্গি পরতে পারত। বাদশাহ মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেন এবং সৎবোনকে নিজের পত্নীর মর্যাদা দেন।
এবার শুরু হয় দ্বন্দ্ব। সৎবোনকে রানি দেখে বড় দুই বোনের সারাক্ষণ ভেতরে জ্বলতে থাকে। তাদের চক্রান্তের জালে পড়ে বাদশাহ রানিকে পরিত্যাগ করেন এবং কারাগারে পাঠান। কারাগারে রানির তিন সন্তানের জন্ম হয়। এই তিন সন্তানের নাম অরুণ, বরুণ, কিরণমালা। তাদের নিয়ে কাহিনি এগিয়ে যেতে থাকে।
এই চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা করেছেন মজিদ খান। সহকারী পরিচালক ছিলেন চৌধুরী বদরুজ্জামান ও মহিউদ্দিন। নৃত্য পরিচালনা করেছেন দাউদ মালিক। দৃশ্যসজ্জায় ছিলেন নিশান। রূপসজ্জায় ছিলেন আবদুস সোবান। শব্দগ্রহণ করেছেন সেলিম। চিত্রগ্রহণে খান আরিফুর রহমান। সম্পাদনায় ছিলেন বশীর হোসেন।
‘অরুণ বরুণ কিরণমালা’ শুধু বাঙালি জীবনে আবহমানকালের রূপকথা নয়, খান আতার বদৌলতে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতের একটি ঐতিহাসিক পালক।
হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত