বৃক্ষপ্রেমী হুমায়ূন আহমেদ

হুমায়ূন আহমেদছবি: প্রথম আলো

‘ঘর খুলিয়া বাহির হইয়া
জোছনা ধরতে যাই;
আমার হাত ভর্তি চান্দের আলো
ধরতে গেলে নাই।’
৩১ বছর ধরে পাঠকের কাছে হুমায়ূন আহমেদের বই মানে অনেকটা মজার ভোজনরসদের মতো। চাঁদনি পসর রাইতে স্বপ্নডানায় চড়ে ফাউন্টেন পেন ঘুরিয়ে তিনি লিখেছেন অসংখ্য গল্প, উপন্যাস, কল্পকাহিনিসহ নানা বই। তৈরি করেছেন নাটক ও চলচ্চিত্র; জলরং দিয়ে ছবিও এঁকেছেন।

হুমায়ূন আহমেদ তাঁর লেখালেখি জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন গাজীপুরের পিরুজালী ইউনিয়নের হোতাপাড়ার প্রকৃতির নন্দনকানন ‘নুহাশ পল্লী’তে। ছোটবেলা থেকে লেখক হুমায়ূনের ভক্ত আমি। আজও মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে স্যারের বই পড়ি। হুমায়ূন আহমেদের বই পড়ে শিখেছিলাম প্রকৃতিকে কীভাবে উপভোগ করতে হয়, বৃক্ষকে কীভাবে ভালোবাসতে হয়।
১৯৯৭ সালে গাজীপুর থেকে মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরে নুহাশ পল্লীতে প্রায় ৪০ বিঘা জমির ওপর বাগানের কাজ শুরু করেন বাংলা কথাসাহিত্যের এই বরপুত্র। তাঁর রচিত বৃক্ষকথায় দেখি হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর হাদিস, ‘যদি তুমি জানো পরের দিনই রোজকেয়ামত; তারপরেও একটি গাছ লাগিও।’
লেখক নিজ হাতে আটটি ঝাউগাছ লাগিয়ে বৃক্ষরোপণ শুরু করেন। কল্পনা করেননি যে গাছগুলো আকাশ স্পর্শ করার স্পর্ধা নিয়ে বড় হবে। তিনি যতবার নুহাশ পল্লীতে গেছেন, ঝাউগাছের পাশে দাঁড়িয়ে স্পর্শ করে বলতেন, ‘এই তোদের নিজের হাতে লাগিয়েছি। আজ তোরা এত বড় হয়েছিস, তার মূলে কিন্তু আমি। আমাকে হ্যালো বল।’ ঝাউগাছগুলো নাকি তাদের ভাষায় হ্যালো বলত। লেখক গাছপালা এত ভালোবাসতেন যে তাদের ভাষাও তিনি কল্পনায় গভীরভাবে উপলব্ধি করতেন।
নুহাশ পল্লীর সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন জায়গা হলো লেখকের প্রয়াত পুত্রের নামে করা ‘রাশেদ হুমায়ূন ঔষধি উদ্যান’। সেখানে পাথরের ফলকে লেখা আছে—‘আমার ছোট্ট বাবাকে মনে করছি।’

নুহাশ পল্লীতে হুমায়ূন আহমেদ অর্ধশতাধিক ঔষধি গাছ লাগিয়েছেন নিজ হাতে। আবার বৃক্ষকথায় প্রতিটি গাছের বৈজ্ঞানিক নাম এবং ঔষধি গুণের কথাও উল্লেখ করেছেন চমৎকারভাবে। বৃক্ষকথায় বনসাই নিয়ে লিখেছেন— ‘অনেকে দেখি বনসাই নিয়ে উত্তেজিত। বিশাল বটবৃক্ষকে বামুন বানিয়ে উত্তেজিত হবার কী আছে? একটি বিশাল প্রাণকে সংকুচিত করার অপরাধে তারা অপরাধী। বৃক্ষদের হাতে শাসনক্ষমতা থাকলে এই অপরাধে তারা যাবজ্জীবন শাস্তির ব্যবস্থা করত। মানবজাতি ভাগ্যবান, বৃক্ষের হাতে শাসনক্ষমতা নেই।’
নুহাশ পল্লীতে প্রবেশ করলে চোখে পড়বে ঘাসের সবুজ গালিচা। লেখক যে রুমে থাকতেন, তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আপেলবৃক্ষ।
ঔষধি উদ্যানে দেখা মিলল আদা, কদম্ব, বেল, পান, বাসক, বাদাম, তেঁতুল, বাজনা, কাঁকড়া চোখ, নিশিন্দা, বিলম্বী, নিম, খয়ের কৃষ্ণবট, ঘেটু, পুত্রঞ্জীব, জারুল, লটকন, হিং, বরুণ, করমচা, পপি, উদয়পদ্ম, নীলমণি লতা, মাধুরীলতা, বাগানবিলাস, জবা, ঘৃতকুমারী, বকফুল, উলটকম্বল, উলটচণ্ডাল, বনকলা, আম, কাঁঠাল, লজ্জাবতী, আতা, ঢেঁকিশাক, তাল, ছাতিম, গাব, ধূপ, বকুল, মাকাল, রিঠা, বহেড়া ও হরীতকী বৃক্ষ। এ ছাড়া লীলাবতি দিঘির পাড়ে ঝাউগাছ, বৃষ্টিবিলাসের পেছনে সৌদি খেজুরের বাগান, ছোট একটি চা–বাগানেরও দেখা মিলবে। আরও আছে মহুয়া, সর্পগন্ধা, জয়তুন, নিশিন্দা, গিলা, দাদমর্দন শিয়ালমুর্তা, দমকলস, ভেরেন্ডা, বিষকাঁটালি, চিকরাশি, আপাং, কণ্টিকারী, হাতিশুঁড়, সোনালি বাঁশ, ডুমুর, দারুচিনি, ম্যাগনোলিয়াসহ পল্লিজুড়ে আছে সবুজের হাতছানি ও স্মৃতিবৃক্ষ।

জীবনের শেষ সময়ে এসে যখন তাঁর শরীরে মরণব্যাধি ক্যানসার ধরা পড়ল, তখন তিনি নিউইয়র্ক শহরের যে বাসায় থাকতেন, সেখানে বারান্দায় নিজ হাতে লাগিয়েছিলেন লাউগাছ। আমেরিকায় থাকাকালে তিনি বারবার খবর নিতেন নুহাশপল্লীর বৃক্ষগুলোর। সেগুলো ভিডিও করে তাঁকে দেখানো হতো। শেষবার যখন বাংলাদেশে এসেছিলেন, বিমান থেকে নেমে সোজা নুহাশপল্লীতে ছুটে যান নিজের হাতে লাগানো বৃক্ষগুলোর কাছে।
বৃক্ষের প্রতি লেখকের যে ভালোবাসা, গভীর প্রেম, বৃক্ষের সঙ্গে কথা বলা, তা অতুলনীয়। বৃক্ষ এবং প্রকৃতির সঙ্গে যে মানব জীবনের একটি নিবিড় সম্পর্ক জড়িয়ে রয়েছে, তা তিনি তাঁর প্রায় সব গল্প এবং নাটকে উপস্থাপন করেছেন। একপশলা বৃষ্টি পড়ে আকাশে উদিত রংধনুর মতোই মানুষ আর প্রকৃতি যেন জীবনের সঙ্গে খেলা করে। নুহাশ পল্লীর লিচুবাগানে চিরতরে শুয়ে আছেন হুমায়ূন আহমেদ। প্রিয় লেখকের দশম মৃত্যুবার্ষিকীতে বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে বলি— ‘নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে।’ প্রকৃতি ও জোছনার জলতরঙ্গ ভালোবাসায় ভালো থাকুন ওপারে।

বন্ধু, প্রথম আলো বন্ধুসভা চট্টগ্রাম