মন ভালো করতে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পাহাড়ে

লিভিং রুট ব্রিজ বা জীবন্ত রুট ব্রিজ সংলগ্ন পাহাড়ি খালে লেখকছবি: অনিক পাল

‘আমি শুধু তার কাছেই মেনে নেব হার; যে আমার সঙ্গে আজীবন ঘুরতে চাইবে পাহাড়।’

গত কয়েক দিন ধরে আমাকে অদ্ভুত এক মন খারাপ চেপে ধরেছে। কিছুই ভালো লাগছে না, অকারণেই মাথাব্যথা ও দুশ্চিন্তা। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী কিছু ওষুধও নিলাম। তবু স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। অনেক কিছু ভেবে মনে হলো একমাত্র পাহাড়ই আমাকে এই অদ্ভুত মন খারাপ থেকে মুক্তি দিতে পারে। মনও টানছিল পাহাড়ের দিকে।

এদিকে আমার ভিসাও করা ছিল। ভাবলাম দু-এক দিনের জন্য ভারত থেকে ঘুরে আসি। যেই ভাবনা সেই কাজ! যান্ত্রিক শহরের কোলাহল থেকে একটুখানি শান্তির নিশ্বাস ফেলতে ১৫ মার্চ চলে যাই ভারতের মেঘালয় রাজ্যের ডাউকিতে। জাফলং গিয়ে দূর থেকে এই ডাউকি শহর বহুবার দেখেছি। কিন্তু ইচ্ছা থাকলেও কখনো যাওয়া হয়নি। এই প্রথম ডাউকিতে আসা। ইমিগ্রেশনের সব ফরমালিটি সম্পন্ন করে একটি প্রাইভেট কার রিজার্ভ করে ছুটে চললাম ডাউকি থেকে শিলংয়ের উদ্দেশে।

আমার ভ্রমণসঙ্গী হলো বন্ধু অনিক পাল। সে জানাল, ডাউকি থেকে শিলং যাওয়ার পথে বেশ কয়েকটি সুন্দর জায়গা আছে, সেগুলো ঘুরে দেখা যায়। শিলং যাওয়ার পথ পুরোটাই উঁচু-নিচু আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা, দুপাশে বড় বড় পাহাড়। পাহাড়ের মধ্যে পানগাছ, সুপারিগাছ ও নাম না জানা হরেক রকমের গাছগাছালি চোখে পড়ে। পাখির কলকাকলিও কানে সুমধুর ধ্বনি সৃষ্টি করছিল। এই প্রথম খুব কাছ থেকে এত বড় বড় পাহাড় দেখছি; কী যে ভালো অনুভূতি। গাড়ি কিছুদূর যেতেই হঠাৎ চোখে পড়ে বিশাল এক ঝরনা। পাঁচ মিনিটের জন্য গাড়ি থামিয়ে ঝরনা দেখলাম। পথিমধ্যে আরও কয়েকটি ছোট-বড় অপরূপ ঝরনার দেখা পাই। প্রকৃতির দৃশ্য দেখতে দেখতে গাড়ির সাউন্ড বক্সে বাজছিল বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমের কয়েকটি জনপ্রিয় গান। সেই সব গানে কণ্ঠ মিলিয়ে হারিয়ে যাই সুখের অজানা দেশে!

একটা সময় গাড়ি এসে থামল মাওলাইনংয়ে। মাওলাইনং হলো ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পূর্ব খাসিয়া পাহাড় জেলায় অবস্থিত একটি গ্রাম। এটি মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা এবং এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন গ্রাম হিসেবে পরিচিত। গ্রামটি পাইনুর্সলা সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক এবং পাইনুর্সলা বিধানসভার অন্তর্গত। প্রবেশ ফি বাবদ এক শ রুপি পরিশোধ করে আমরা সেখানে ঢুকলাম। সত্যি বলতে, একটি গ্রাম যে এত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও আধুনিক হতে পারে, সেটা মাওলাইনং না দেখলে হয়তো কখনো জানতামই না। এখানে প্রতিদিন দেশ-বিদেশের অসংখ্য পর্যটক আসেন। সেখানে ৩০ মিনিটের মতো ঘোরাফেরা করে আবার গাড়িতে উঠলাম।

ডাউকি থেকে শিলং যাওয়ার পথ পুরোটাই উঁচু-নিচু আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা, দুপাশে বড় বড় পাহাড়।
ছবি: অনিক পাল

এবারের গন্তব্য লিভিং রুট ব্রিজ। লিভিং রুট ব্রিজ বা জীবন্ত রুট ব্রিজ হলো একধরনের সরল সাসপেনশন ব্রিজ, যা গাছের আকারের মাধ্যমে জীবন্ত উদ্ভিদের শিকড় দিয়ে গঠিত। এটি ভারতের মেঘালয় রাজ্যের উত্তর-পূর্ব অংশে অবস্থিত। এটি শিলং মালভূমির দক্ষিণ অংশে পাহাড়ি ভূখণ্ডের খাসি এবং জয়ন্তিয়া জনগণের দ্বারা রাবার–ডুমুরগাছের শিকড় থেকে তৈরি করা হয়। এই লিভিং রুট ব্রিজ দেখার জন্য প্রবেশ ফি বাবদ জনপ্রতি ৪০ রুপি পরিশোধ করতে হয়েছে। সেটি দেখতে পাথরের সিঁড়ি দিয়ে ১০০-১৫০ ফুট নিচে নামতে হয়। গাছের শিকড় দিয়েও যে এত সুন্দর ব্রিজ হয়, সেটা এই প্রথম খুব কাছ থেকে দেখলাম। একে তো উঁচু উঁচু পাহাড়, তার মধ্যে আবার এত সুন্দর বড় বড় পাথরের খণ্ড এবং ঝরনা দেখে মনটা সতেজ হয়ে ওঠে।

যাহোক, মিনিট দশেক অবস্থান করার পর আমাদের পরবর্তী গন্তব্য মওজনগিহ ল্যাপিনসংডর ভিউ পয়েন্টের দিকে রওনা দেওয়া। যথারীতি এখানেও প্রবেশ ফি বাবদ ২০ রুপি পরিশোধ করে ওপরে উঠতে হলো। একি! এসব আমি কী দেখছি! এত উঁচু থেকে পাহাড়গুলো দেখে এবং মায়াবী প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে রীতিমতো চমকে উঠলাম। কিছুক্ষণের জন্য প্রকৃতির নৈসর্গিক সৌন্দর্যের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলি। ওপর থেকে পাহাড়ের নিচের দৃশ্যগুলো খুবই সুন্দর দেখাচ্ছিল। তখন মনে মনে বলছিলাম, ‘আমি শুধু তার কাছেই মেনে নেব হার; যে আমার সঙ্গে আজীবন ঘুরতে চাইবে পাহাড়।’

সেখানে কিছুক্ষণ অবস্থান করার পর আমাদের পরবর্তী গন্তব্য শিলং শহর। যখন শহরে পৌঁছাই, তখন ঘড়িতে প্রায় সন্ধ্যা সাতটা। একটি হোটেলে গিয়ে চেক ইন করি। তারপর ফ্রেশ হয়ে শহর ঘুরব বলে বেরিয়ে পড়ি। কিন্তু হোটেল থেকে বের হয়ে দেখি শহরের সব দোকানপাট ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। রাস্তাঘাট অনেকটাই ফাঁকা। পরে জানতে পারি, এই শহরের নিয়ম এটা; রাত আটটার মধ্যে সব দোকানপাট বন্ধ করে দিতে হবে। আমরা একটি রেস্টুরেন্টে গিয়ে রাতের খাবার খেয়ে হোটেলে এসে ঘুমিয়ে পড়ি। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সকালের নাশতা করে ঘুরতে বের হয়ে গেলাম। প্রথমেই গেলাম ওয়ার্ডস লেক। স্থানীয়ভাবে পোলক লেক বা নান পোলোক নামে পরিচিত। কৃত্রিম এই হ্রদটি শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এবং শিলংয়ের অন্যতম দর্শনীয় পর্যটনকেন্দ্র। তারপর আরও দু-একটি পার্কে ঘুরে আমরা চলে আসি শিলংয়ের অপূর্ব স্থাপত্য ক্যাথেড্রাল চার্চ দেখতে। বিশাল আয়তন নিয়ে সুনিপুণভাবে তৈরি করা স্থাপনাটি। দেখে মনটা আরও ভালো হয়ে গেল।

এবার কেনাকাটার পালা। শিলংয়ের পুলিশ বাজারে গিয়ে নিজের এবং পরিবারের জন্য কিছু কেনাকাটা সেরে নিই। সেখান থেকে বের হয়ে যাই স্থানীয় বিখ্যাত স্ট্রিট ফুড খেতে। অনেক নাম না জানা স্ট্রিট ফুড খাওয়ার পর অনিকের এক আত্মীয়ের বাসায় রাতের খাবার খেয়ে হোটেলে চলে গেলাম। সারা দিনের ভ্রমণ জার্নিতে শরীর অনেক ক্লান্ত। ঘুমের দেশে হারিয়ে যেতে বেশি সময় লাগেনি। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই দ্রুত সিলেটের উদ্দেশে রওনা হলাম। বিকেল চারটায় বাসায় এসে পৌঁছাই।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি ও অপূর্ব সুন্দরতম এক জায়গা ডাউকি এবং শিলং। আপনিও চাইলে ঘুরে আসতে পারেন। যদি প্রকৃতিপ্রেমী ও পাহাড়প্রেমী হয়ে থাকেন, তাহলে নিঃসন্দেহে কিছুক্ষণের জন্য হলেও প্রকৃতির এই নৈসর্গিক সৌন্দর্যে হারিয়ে যেতে বাধ্য হবেন। প্রকৃতিপ্রেমী না হলেও নতুন করে প্রেমে পড়বেন।

রাতের শিলং শহর
ছবি: অনিক পাল

যেভাবে যাবেন
সিলেটের সোবহানীঘাট থেকে বাসে করে তামাবিল যাবেন; ভাড়া ১২০-১৫০ টাকা। চাইলে সিএনজি অথবা প্রাইভেট কার রিজার্ভ করেও যেতে পারবেন। তবে অল্প বাজেটে যেতে চাইলে বাসে করেই যাওয়া ভালো এবং চেষ্টা করবেন গেটলক বাসে যাওয়ার। তাহলে অল্প সময়ের মধ্যেই তামাবিল পৌঁছাতে পারবেন। ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করে চাইলে সেখান থেকেই সরাসরি প্রাইভেট কার রিজার্ভ করে বা শেয়ারিং বাসে করে শিলং শহরে যেতে পারবেন। অথবা যদি আগে ডাউকি বাজারে গিয়ে পরে শিলং যেতে চান, তা-ও পারবেন।

যা যা করবেন
ডাউকি থেকে শিলং যাওয়ার জন্য একটি গাড়ি রিজার্ভ করবেন। আগেই ড্রাইভারকে বলে রাখবেন যে শিলং যেতে যেসব পর্যটন স্থান রাস্তায় পড়বে, সেগুলোতেও যেন গাড়ি থামায়। এতে পরে আর ঝামেলায় পড়তে হবে না। ড্রাইভার আপনার কাছে গাড়িভাড়া হিসেবে ২৫০০-৪০০০ টাকা পর্যন্ত চাইতে পারে। দর-কষাকষির মাধ্যমে ৩০০০ টাকার মধ্যেই যাওয়া সম্ভব।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মানি এক্সচেঞ্জ। চাইলে বাংলাদেশ থেকে মানি এক্সচেঞ্জ করে নিতে পারবেন। অথবা ডাউকি এবং শিলং থেকেও নিতে পারবেন। তবে ডাউকিতে মানি এক্সচেঞ্জ রেট ১০০০ টাকার বিনিময়ে ৬৩০ রুপি। আর শিলং-এ ৫৮০ রুপি। তাই ডাউকি থেকেই মানি এক্সচেঞ্জ করে নেওয়া ভালো (কমবেশি হতে পারে)।

সাধারণ সম্পাদক, সিলেট বন্ধুসভা