বাসায় ফিরে মনে হলো একটা অপরাধ করে ফেলেছি। তাকে সত্যিটা বলা উচিত ছিল যে মিতু, আমি তোমাকে দেখতেই এসেছিলাম আজ। আমাদের কাকতালীয়ভাবে দেখা হয়নি।
ছুটির দিনে শিল্পকলা একাডেমিতে ঢুঁ মেরে আসা আমার পুরোনো অভ্যাস। কিন্তু আজ সোমবার, অফিস খোলা। অফিসের দিকে না গিয়ে যাচ্ছি শিল্পকলার দিকে। বিশেষ কারণ, আজ সে আসবে। খবর পেয়েছি ফেসবুকে। তার বন্ধুতালিকায় যুক্ত না থাকলেও ফলো করি গোপনে। মৎস্য ভবনের সামনে বাস থেকে নেমে হাঁটা ধরলাম শিল্পকলার দিকে। অফিস থেকে ফোন, ‘আপনি কোথায়? অফিসে আসলেন না যে এখনো।’ ‘একটা বিপদে পড়ে গেছি, বস। দাদু ভীষণ অসুস্থ। আমি যাচ্ছি হাসপাতালে। রাস্তায় আছি।’ ‘হাসপাতালে মানে কী? গত বছর না আপনার দাদু মারা গেল।’ ‘উনি আমার আপন দাদু ছিল। হাসপাতালে দাদুর আপন মায়ের পেটের বোন। অবস্থা ভালো না স্যার, দোয়া করবেন।’ তড়িঘড়ি করে ফোন কেটে দিলাম। বস মনে মনে কী বলছে আমি জানি। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার এই এক অসুবিধা, এক দিনও মিস করা যাবে না, অফিস অচল হয়ে যাবে।
মিতু মেয়েটার ছদ্মনাম, আমার দেওয়া। গায়ের রং ফরসা। বিশেষ বৈশিষ্ট্য, কথা বলার সময় ঠোঁট কাঁপে। বিশেষ গুণ, ছবি তোলে ভালো। আজকেও তার ছবির এক্সিবিশন আছে। আমাদের প্রথমবার দেখা ঘুমের মধ্যে। স্বপ্নে নয়, আমি বাসের মধ্যে ঘুমিয়ে ছিলাম; সে ওই অবস্থায় আমার একটা ছবি তুলেছিল। আমি হাঁ করে ঘুমাচ্ছি, একটা মাছি মুখের ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, আমার মুখের ভেতর ঢুকবে। সেই দৃশ্যই সে ক্যামেরাবন্দী করেছে। পরে জানতে পারি, এই এক ছবির জন্য দেড় শর মতো ছবি তুলেছে সে। যখন একটা শক্ত ঝাঁকুনিতে আমার ঘুম ভাঙে, তখন সেই ছবি দেখিয়েছিল আমায়। কাঁপা ঠোঁটে বলেছিল, ‘দেখেন, ছবিটা সুন্দর না। তবে সরি, না বলে ছবিটা তুলেছি। বলে তুললে আসলে এই ফ্রেমটা পেতাম না। আপনার আপত্তি থাকলে আমি ডিলিট করে দেব।’ সেই কাঁপা ঠোঁটের হাসিকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা আমার ছিল না।
সেদিনের পর আমার সঙ্গে অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটতে থাকল। প্রায়ই মিতুকে স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম। দেখতাম সে হাসছে, তার ঠোঁট কাঁপছে। দারুণ এক সুন্দর দৃশ্য! ডাগর চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তাকে কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারছি না। মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। কিন্তু তার এই উপস্থিতি আমার ভালো লাগছে। চাইছি সে এভাবেই থাকুক। বেশির ভাগ সময় এমনটা হতো বাসে। তাই বাসে উঠলে ঘুমানোর চেষ্টা করতাম। ঘুমের ঘোরে দুই দিন তো স্টপেজই মিস করে ফেলি! একদিন খালি হলো পকেট। তাতে কী। এ সবকিছুই নস্যি তার কাছে। ফেসবুকে বিভিন্ন ফটোগ্রাফির পেজে খোঁজাখুঁজির পর খোঁজ পেলাম তার।
আমার পাঞ্জাবির পকেটে একটা গোলাপ। আসার সময় এক পিচ্চি পেছন পেছন ঘুরঘুর করছিল যেন ফুল না বেচে ছাড়বে না। ভাবলাম ফুলই তো, একটা নিলে কী আর এমন ক্ষতি। মনে মনে ভাবছি এই ফুলটা মিতুর হাতে দিয়ে যদি বলি, ‘মিতু, আমি তোমাকে ভালোবাসি’, ব্যাপারটা কেমন হবে। না, এভাবে কেউ ভালোবাসার কথা বলে! মুখের ওপর যদি ‘না’ করে দেয়, তখন খারাপ লাগবে। অন্য উপায় ভাবতে হবে। এমন সময় দেখি মিতুর আগমন। শাড়ি পরেছে আজ। অদ্ভুতভাবে আমার পাঞ্জাবির সঙ্গে মিলে গেল রং।
‘আরে আপনি এখানে?’
‘ঘুরতে এসেছিলাম।’
‘যাক, ভালোই হলো। একটা এক্সিবিশন চলছে আমার, আপনার ছবিটাও আছে।’
‘তাহলে তো দেখতেই হয়! দেখেছেন পৃথিবী কত গোল, দেখা হয়েই যায়।’
‘তা–ই তো দেখছি। চলেন ভেতরের দিকে যাই।’
অফিস ফাঁকি দিলেও আজকের দিনটা ফুরফুরে কেটেছে। বাসায় ফিরে মনে হলো একটা অপরাধ করে ফেলেছি। তাকে সত্যিটা বলা উচিত ছিল যে মিতু, আমি তোমাকে দেখতেই এসেছিলাম আজ। আমাদের কাকতালীয়ভাবে দেখা হয়নি।
মিতু নামক অধ্যায়টা মনে ভালোভাবেই গেঁথেছে, সেটা টের পাচ্ছি প্রাত্যহিক জীবনেও। আজকাল অন্য মেয়ের দিকে তাকাতেও ইচ্ছা করে না। মিতুর ভাবনায় ডুবে থাকি পুরোপুরি। কিন্তু সমস্যা একটাই, পছন্দের কথাটা জানাতে পারছি না কোনোভাবেই। এখানেই নিজেকে যুগের চেয়ে পিছিয়ে থাকা মানুষ মনে হয়। পছন্দ করিস ভালো কথা, মুখফুটে বলে দে। সামনাসামনি বলতে না পারলে মেসেজে বল। না, এসব কিছুই করা হয়ে উঠছে না। শুধু তাকে নিয়ে ভাবনাটা প্রখর হচ্ছে। আমি হিসাব কষে যাচ্ছি কথার, কী বলব তাকে।
আজ শুক্রবার। আমার গায়ে সেদিনের পাঞ্জাবিটা। হাঁটছি টিএসসির দিকে। কিন্তু আজ কাকতালীয়, দেখি মিতু সেদিনের শাড়িটা পরেই দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে মুখে চওড়া হাসি। এগিয়ে গেলাম তার দিকে,
‘আবার দেখা হয়ে গেল।’
‘কোথায় যাচ্ছিলেন?’
‘এদিকেই।’
তার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই এক ছেলের আগমন। তার পরনেও প্রায় একই রঙের পাঞ্জাবি। পরিচয়টা মিতুই করিয়ে দিল, ‘আমার বয়ফ্রেন্ড।’
আমি ইতস্তত হয়ে পকেটে হাত ঢুকালাম। হাতে শুকনা গোলাপের অস্তিত্ব টের পেলাম।
নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ