অমাবস্যার জ্যোৎস্না দেখায় ‘সনাতন গল্প’

সনাতন গল্প–এর দৃশ্যে মাসুম আজিজ ও সহশিল্পীরাসংগৃহীত

কাঁঠালের আমসত্ত্ব হয় না, আমাদের বাংলা ভাষায় প্রবাদের মতো সত্যি, তবু অমাবস্যার জ্যোৎস্না হয়। চারদিকে অন্ধকার, ঘোর অন্ধকার। আশা বলে কিছু নেই। আশাহত জীবন থেকে মুক্তি নেই। স্বাধীনতা নেই। ভালোবাসার শিকল বলে তবু যদি কিছু থাকে, সেই শিকলে নিরুপায় চিরকাল বন্দী থাকতে থাকতে চড়া অন্ধকারে জীবনের দামে যদি হৃদয়ের জ্যোৎস্না উৎসারিত হয়। পরাহত সেই জীবনের জ্যোৎস্নার ছিটেফোঁটার গল্প মাসুম আজিজের ‘সনাতন গল্প’।

গল্পে সনাতন নামের একটি চরিত্র আছে। গ্রামে চা, পান-বিড়ির দোকান চালায়। কিন্তু গল্পটা শুধু তার নয়। গল্পে সনাতন ধর্মাবলম্বী জেলে বা জাইল্যা এবং অসংখ্য নিম্ন শ্রেণির মানুষের জীবন বিস্তৃত আছে। তাতেও গল্পটা শুধু সনাতনীদের নয়। এখানে সনাতন চিরকাল ধরে প্রচলিত, অপরিবর্তনীয়, ধনী-গরিব ভেদাভেদ, শাসক-শোষক অবস্থান, কৃতদাস প্রথা, সামন্ততান্ত্রিক সমাজের কথা তুলে ধরে। রক্তচোষা মহাজন কর্তৃক দাদন প্রথার বীভৎস দিক উঠে আসে। ধর্ম-গোত্র-জাতভেদে মাৎস্যন্যায়, শক্তিশালী ক্ষমতাবান আর দুর্বল ক্ষমতাহীনদের জীবনকাহিনি বিস্তৃত হয়। নামকরণটিও তাই যথার্থ সার্থক।

মাসুম আজিজের দীর্ঘদিনের সাধনার ফসল এই ছবি যেমন ইতিহাসের দিক নির্দেশ করে, তেমনই নিজেও ইতিহাস হয়ে রইল।

চলচ্চিত্রের কাহিনি, চিত্রনাট্য, সংলাপ, পরিচালনা বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব মাসুম আজিজের। বাংলাদেশের থিয়েটার, মঞ্চনাটক থেকে টেলিভিশন নাটককে যিনি কঠিন চরম সাধনা থেকে পরম সিদ্ধির দিকে নিয়ে গিয়েছেন, চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে এসেও পরিপূর্ণ সফল একজন পরিচালক হলেন। সাধুর বাবা যতীন হালদারের চরিত্রে নিজেও অসাধারণ অভিনয় করেছেন। অভিনয় করেছেন চুল থেকে নখ পর্যন্ত ঋণে ডুবে যাওয়া এবং ঋণের দায়ে দুঃখকষ্টে সারাক্ষণ নেশার পানীয় গিলে মাতাল হয়ে থাকা গ্রাম্য দরিদ্র বৃদ্ধ মানুষের চরিত্রে। এই চরিত্রের অভিনয় দেখে কখনো কখনো মনে হয়েছে যেন একজন থিয়েটার পুরুষ মঞ্চের মধ্যে হেমলক পান করছেন। তাঁর সংলাপও কখনো কখনো মঞ্চের সংলাপের মতো। নাটককে যে গোটা জীবন ধরে রক্তে, মাংসে, জীবনে বহন করে গিয়েছেন, চলচ্চিত্রে এসেও তার ছাপ থেকে যায়।

এই মাসুম আজিজ মন প্রাণ উজাড় করে দেওয়া উদাত্ত কণ্ঠে ভূপেন হাজারিকার কালজয়ী ‘বিস্তীর্ণ দুপারে অসংখ্য মানুষের হাহাকার শুনেও নিঃশব্দে নীরবে ও গঙ্গা তুমি বইছ কেন...’ গানটি করে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। এই চলচ্চিত্রের শুরুতে বেদনাবিজড়িত দরদি কণ্ঠে গান ভেসে আসে ‘তুমি অমাবস্যার জ্যোৎস্না দেখছনি/ উজান গাঙে নাও ভাসাইয়া ভাটির নাঙাল পাইছনি?...’ অর্থের অভাবে চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রায় প্রতিটি দিক সামলেছেন তিনি নিজে। কুড়ি বছর আগে সরকারি অনুদান পেয়ে একঝাঁক নামী তারকা দিয়ে নির্মাণ শুরু করলেও শেষ করতে পারেননি। কুড়ি বছর পর একেবারে অনামী শিল্পীদের দিয়ে নতুন করে আবার নির্মাণ করেছেন। কাহিনির মধ্যে যেমন মানুষের জীবনের লড়াই-সংগ্রামে অস্তিত্ব রক্ষার কথা আছে, চলচ্চিত্র নির্মাণের পরতে পরতেও পরিচালকের সেই লড়াই, জেদ আর সাধনা। কিন্তু নির্মাণের পর একবারের জন্যও মনে হয়নি তারকাহীন এই ছবি মাঠে মারা গেল। নব্য শিল্পীরা ভবিষ্যতের নব নব তারকা হয়ে নিজেদের অভিনয় দক্ষতায় দক্ষ পরিচালকের ভাবনাকে সফল করে তুলেছেন।

গল্পটা ইংরেজ আমলের হলেও সামাজিক বৈষম্যের যে চিত্র উঠে আসে, সেটা চিরকালের। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়েও আমরা কেউ বলতে পারি না, ধনী-দরিদ্র সামাজিক ভেদাভেদ, শ্রেণিচরিত্র আজও ঘুচেছে। শোষক শ্রেণির রূপের পরিবর্তন হয়েছে মাত্র। গরিব মানুষ যেই তিমিরে, সেই তিমিরেই রয়ে গিয়েছে। এখানে নাকখত দেওয়া চিরকালের দাস যতীনের বাড়িতে নিয়মিত মদ পাঠায় গ্রামের মহাজন মণি হালদার। মানুষকে নেশায় ডুবিয়ে রেখে যেভাবে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে নিতে পারে একালের শোষকেরাও। যতীন সম্পর্কে মণি হালদার যেমন বলেন, ‘বেটা শালা যাইবি কোথা, ইন্দুর মারার কল বসাইছি। তুই গিলবি না তোর বাপ গিলবে...।’ এদিকে হতদরিদ্র পরিবারে যতীনের বউ সারাক্ষণ খেচড় খেচড় করে, ‘ওই সব গু মুত না খাইলে হয় কি। হাড় পাশ পানি কইরা দিচ্ছে, তবু আপনার জিব জুড়াই না। খালি খালি ছাইভস্ম একাই গিইলা পইড়া থাকেন, সংসারের আর লোকজন কী খাই তা কি একবারও ভাবিছেন।’ যতীনের ছেলে সাধু এসেও নেশাখোর বাবাকে বলে, ‘দেনা বাড়তে বাড়তে যে গলা থেকে নাক পর্যন্ত এসে ঠেকল, সে হিসাব কি তোমার আছে?’ নিরুপায় যতীন ছেলের সঙ্গে পেরে ওঠে না। বউকে শাসায়, ‘এই বান্দির বাচ্চা চিল্লাইবি না’। নারীর ওপর পুরুষের আগ্রাসী আধিপত্য বিস্তারের ছবি যেমন উঠে আসে। পুরুষটি যে চিরকালের পরাজিত মানুষের প্রতিনিধি, গরিবের ঘরে এ ধরনের বিবাদ নিত্য লেগে থাকে, আমরা সবাই জানি।

গ্রামের চিরাচরিত সংস্কৃতির ছবি উঠে আসে। চৈত্র শেষে চড়কের মেলা বসে। সেই মেলাতে দড়িতে ঝোলা মানুষ ঘোরে। বাদ্য বাজে। অনেকে নাগরদোলায় চড়ে। জিলাপি ভাজা হয়। আর এদিকে জল শুকিয়ে আসা নদীর পাড়ে মহাজনের নৌকা বানানোর খুঁটি পোঁতা হয়। বর্ষা এলেই এই নৌকায় করে গ্রামের জেলেদের মাছ ধরতে পাঠান তিনি। মাছ ধরতে গেলে নৌকা লাগে, জাল লাগে, আরও কত কী লাগে। সব মহাজন দেয়। বিনিময়ে মাছের ভাগ কড়ায় গন্ডায় বুঝে নেয়। জেলেদের যোগ্য মজুরি বা ভাগ দেয় না। সারা বছর ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে ঋণের দায়ে দাস বানিয়ে রাখে। ফলে অনেক পরিশ্রম করেও গরিবের অভাব কোনো দিনই ঘোচে না। মানুষ কুমিরের পেটে গেলে তো দায় একেবারে মিটেই যায়। ভাগ্যের হাতে মার খেয়েছে বলে চালান দিয়ে দেওয়া যাবে।

গ্রামের বিচিত্র সব মানুষের মধ্যে টগা নামের জড়বুদ্ধি, প্রতিবন্ধী ছেলেটার বাবার মার্ডার কেসের আসামি আবার মণি হালদার। টগার মা এখন ভিক্ষা করে। রেণু নামের নারীটি লোকের বাড়িতে কাজ করে, ল্যাংড়া স্বামী আর দুধের বাচ্চার ভরণপোষণ করে। জলের ভাড় বহন করা মানুষটি মা মরা দুই মেয়েকে নিয়ে সারা দিন গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায়। দুই বেলা মেয়েদের ভাত খাওয়াতে পারে না, তবু সে স্বাধীন। কারও কাছে বাঁধা পড়েনি।

এদিকে বাপ-মা মরা অন্য কন্যা লক্ষ্মী, তার দাদা কালা আবার মহাজন মণি হালদারের সহচর। দাসখত দিয়ে রেখেছে। লক্ষ্মী নিজের দাদাকেও পছন্দ করে না। লক্ষ্মীকে মনে মনে ভালোবাসে চা পান বিড়ির দোকানে থাকা সনাতন। লক্ষ্মী ভালোবাসে শুধু যতীন হালদারের ছেলে সাধুকে। সাধুকে নিয়ে সে রঙিন স্বপ্ন বোনে। এই সাধু ছিল গ্রামের একমাত্র বিদ্রোহী চরিত্র, বলত ‘না খাইয়া থাকব তবু হালদারের লাওয়ে উঠব না…’। লক্ষ্মীর খুব পছন্দ হতো কথাটা। কিন্তু পিতার ঋণ এতটাই যে মহাজনের কাছে বাঁধা পড়তে সাধু একপ্রকার নিরুপায়। মহাজনেরা যে প্রজন্মের পর প্রজন্ম সবার ওপরে শাসন শোষণ জারি রাখে, সেটাই স্পষ্ট বোঝাতে চান পরিচালক।

এ বড় সুখের ছবি নয়, উৎসবের ছবি নয়। এই ছবি চরম বেদনার। পরাজিত মানুষের বন্দিজীবনের চিরকালের অশ্রুধারার। সুন্দর অভিনয় করেছেন উৎস জামান, তাহমীনা কৃত্তিকা, জয়রাজ, তুষার মাহমুদ, সাবিহা জামান, সুলতানাসহ আরও অনেকে। টগা নামের প্রতিবন্ধী চরিত্রটি প্রতিটি মুহূর্তে মন জয় করে নেয়। ছবির অন্য গান, সেট নির্মাণ, চিত্রায়ণ, দৃশ্যায়ন চমৎকার। মাসুম আজিজের দীর্ঘদিনের সাধনার ফসল এই ছবি যেমন ইতিহাসের দিক নির্দেশ করে, তেমনই নিজেও ইতিহাস হয়ে রইল।

অমাবস্যার জ্যোৎস্না বলে কিছু হয় না। কিন্তু ফুল ফুটুক না ফুটুক, এ ধরনের শৈল্পিক ছবি মনের ঘরে চিরকালের বসন্ত জাগ্রত রেখে যায়। মাসুম আজিজও চিরকাল অমর শিল্পী হয়ে থাকবেন।

হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত