মাত্র ২১ বছর বয়সে পেয়েছিলেন মৃত্যুর পরোয়ানা। দুরারোগ্য মোটর নিউরনে আক্রান্ত হওয়ায় চিকিৎসকেরা তাঁর আয়ু মাত্র দুই বছর বেঁধে দিয়েছিলেন। এরপর মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হওয়াটাই তো ছিল বুদ্ধিমানের কাজ! কিন্তু তা না করে বোকার মতো বাঁচার স্বপ্ন দেখলেন স্টিফেন হকিং নামের এক তরুণ। একে একে অকেজো হতে লাগল হাত, পা; তারপর পুরো শরীর। বন্দী হলেন হুইলচেয়ারের চার চাকায়। কিন্তু সেসব উপেক্ষা করেই শুধু সচল মগজ আর হৃদয়কে সম্বল করে চালিয়ে গেলেন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার প্রিয় গবেষণা। একসময় মুখের অস্পষ্ট কথাও কেড়ে নিল ঘাতক নিউমোনিয়া। তবু হার মানেননি তিনি। গোঁয়ার্তুমি বোধ হয় একেই বলে! ভাগ্যকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চরম কষ্ট সয়ে লিখে ফেললেন ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’। বইটি সর্বকালের সর্বোচ্চ বিক্রিত ও জনপ্রিয় বিজ্ঞান বইয়ের তালিকায় অন্যতম হিসেবে ঠাঁই করে নেয় ইতিহাসের পাতায়। ইতিহাসে ঠাঁই পান স্টিফেন হকিংও। রাতারাতি তারকায় পরিণত হন, আইনস্টাইনের পর আর কোনো বিজ্ঞানীর কপালে এমন খ্যাতি জোটেনি। এ সবকিছুই সম্ভব হয়েছে কেবল তাঁর অদম্য মানসিক শক্তির কারণে। তাই যুগ যুগ ধরে তরুণদের প্রেরণা আর অদম্য শক্তির প্রতীক হয়ে আছেন হকিং। নিজের জীবন আর গবেষণা নিয়ে অকপট তিনি লিখেছেন তাঁর আত্মজীবনী ‘মাই ব্রিফ হিস্ট্রি’তে। বইটির একটি অধ্যায় তরুণ পাঠকদের জন্য এখানে ছাপা হলো।
‘মাত্র ২১ বছর বয়সে আমার এএলএস (অ্যামিওট্রোফিক ল্যাটারাল স্কেলেরোসিস) রোগটি হওয়ার পর, একে খুবই অবিচার মনে হয়েছিল। এ রকম অবস্থা আমার কেন হবে? তখন মনে হয়েছিল, আমার জীবন একেবারেই শেষ হয়ে গেল। আমার ধারণা, নিজের ভেতর যে সুপ্ত সম্ভাবনা ছিল, তা কখনোই বুঝতে পারিনি আমি। তবে ৫০ বছর পর এখন জীবন নিয়ে আমি বেশ পরিতৃপ্ত। আমি দুবার বিয়ে করেছি, তিনটি চমৎকার আর গুণী সন্তান আছে আমার। আমার বৈজ্ঞানিক কর্মক্ষেত্রেও আমি সফলতা পেয়েছি। আমার মনে হয়, বেশির ভাগ তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীই একমত হবেন যে কৃষ্ণগহ্বর থেকে কোয়ান্টাম বিকিরণসংক্রান্ত আমার অনুমান ঠিক। অবশ্য এ তত্ত্ব থেকে আমি এখনো নোবেল পুরস্কার পাইনি। কারণ, এটি পরীক্ষামূলকভাবে প্রমাণ করা বেশ কঠিন। অন্যদিকে মূল্যবান মৌলিক পদার্থবিদ্যার অনেক পুরস্কার আমি পেয়েছি। আমার আবিষ্কারগুলো পরীক্ষামূলকভাবে নিশ্চিত না হওয়া সত্ত্বেও তাত্ত্বিক গুরুত্বের জন্যই এগুলো পেয়েছি।
আমার বৈজ্ঞানিক গবেষণায় আমার দৈহিক অক্ষমতা খুব বেশি অসুবিধায় ফেলতে পারেনি। আমার মনে হয়, আসলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই অক্ষমতা আমার জন্য মূল্যবান গুণ হিসেবে কাজ করেছিল। আমাকে কখনো আন্ডারগ্র্যাজুয়েটদের পড়াতে বা তাঁদের জন্য কোনো লেকচার দিতে হয়নি। আবার সময় নষ্ট করতে বিরক্তিকর কোনো কমিটিতেও কখনো বসতে হয়নি। কাজেই আমি পুরোটা সময় আমার গবেষণায় মনোযোগ দিতে পেরেছিলাম।
আমার সহকর্মীদের কাছে আমি শুধুই আরেকজন পদার্থবিদমাত্র। তবে জনসাধারণের কাছে আমিই সম্ভবত বিশ্বের সুপরিচিত বিজ্ঞানী। এর পেছনের আংশিক কারণ হলো, আইনস্টাইনকে বাদ দিলে বিজ্ঞানীরা রকস্টারদের মতো ব্যাপকভাবে পরিচিত নন। আমার জনপ্রিয়তার আরেকটি কারণ হলো, গৎবাঁধা প্রতিবন্ধী জিনিয়াস হিসেবে আমি বেশ মানানসই। পরচুলা ও কালো চশমা দিয়ে কোনো ছদ্মবেশ নিতেও পারতাম না আমি। কারণ, হুইলচেয়ারটাই আমার সবকিছু ফাঁস করে দিত।
সুপরিচিত হওয়া এবং সহজে চেনার ভালো ও মন্দ দুটি দিকই আছে। মন্দ দিকগুলোর মধ্যে খুবই সাধারণ কাজ, যেমন বাজার করতে গেলেও লোকজন ছবি তোলার জন্য চারদিকে ছেঁকে ধরে। আবার অতীতে খবরের কাগজগুলো আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে বেশ অযৌক্তিক আগ্রহও দেখিয়েছে। তবে আমার ক্ষেত্রে মন্দ দিকের চেয়ে ভালো দিকের পাল্লাই বেশি ভারী। লোকজন সত্যি সত্যিই আমাকে দেখে খুশি হতো। ২০১২ সালে লন্ডন প্যারা অলিম্পিক গেমসে আমি উপস্থাপকের দায়িত্ব পালন করেছিলাম। সেবারই সর্বোচ্চসংখ্যক দর্শক পেয়েছিলাম।
একটি পরিপূর্ণ আর পরিতৃপ্ত জীবন পেয়েছি আমি। আমার বিশ্বাস, অক্ষম বা প্রতিবন্ধী মানুষদের এমন কোনো কাজে মনোযোগ দেওয়া উচিত, যেখানে তাঁদের ত্রুটি কোনো বাধার সৃষ্টি করবে না। আবার তাঁরা যা করতে পারেন না, তার জন্য কোনো দুঃখ করাও উচিত নয়। আমার ক্ষেত্রে আমি যা করতে চেয়েছি, তার বেশির ভাগই করতে পেরেছি। আমি বিস্তর ঘুরে বেড়িয়েছি। সোভিয়েত ইউনিয়নেই গিয়েছি সাতবার। প্রথমবার এক শিক্ষার্থী দলের সঙ্গে গিয়েছিলাম, যাদের মধ্যে এক সদস্য ছিল ব্যাপ্টিস্ট। সে রুশ ভাষায় বাইবেল বিতরণ করতে চাচ্ছিল। সে কারণে সেগুলো পাচার করার অনুরোধ জানিয়েছিল আমাদের। অবশ্য আমরা কোথাও ধরা না পড়েই সেগুলো বহাল তবিয়তে পাচার করতে পেরেছিলাম। সেখান থেকে চলে আসার সময় কর্তৃপক্ষ আমাদের কৃতকর্ম আবিষ্কার করতে পেরেছিল। তখন আমাদের কিছুক্ষণের জন্য আটকে রাখা হয়েছিল। তবে বাইবেল পাচার করার অভিযোগ আনা আন্তর্জাতিক ঘটনার ও অসন্তোষের প্রচারণার কারণ হয়ে ওঠার আশঙ্কা ছিল। কাজেই তারা কয়েক ঘণ্টা পর আমাদের ছেড়ে দিয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নে অন্য ছয়বার যাওয়ার কারণগুলো ছিল রুশ বিজ্ঞানীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা। কারণ, সে সময় পশ্চিমের কোনো দেশে তাঁদের ভ্রমণের অনুমতি ছিল না। ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর, সে দেশের সেরা বেশ কিছু বিজ্ঞানী পশ্চিমের উদ্দেশ্যে দেশ ছেড়েছিলেন। তাই এর পর থেকে আমার আর রাশিয়ায় যাওয়া হয়নি।
আমি জাপানেও ছয়বার গেছি। চীনে তিনবার এবং অ্যান্টার্কটিকাসহ প্রতিটি মহাদেশে গেছি, ব্যতিক্রম একমাত্র অস্ট্রেলিয়া। দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, ভারত, আয়ারল্যান্ড, চিলি ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টদের সঙ্গে আমি দেখা করেছি। বেইজিংয়ের গ্রেট হলে এবং হোয়াইট হাউসে মানুষের সামনে বক্তৃতা দিয়েছি। সাবমেরিনে চেপে সাগরতলে গেছি, আকাশে উড়েছি হট এয়ার বেলুনে এবং জিরো গ্র্যাভিটি ফ্লাইটে চেপে। আবার ভার্জিন গ্যালাকটিকের সঙ্গে মহাকাশে যাওয়ার জন্য আগাম বুক করে রেখেছি। আমার শুরুর দিকের গবেষণা প্রমাণ করেছে, মহাবিস্ফোরণ এবং কৃষ্ণগহ্বরের পরম বিন্দুগুলোয় চিরায়ত সাধারণ আপেক্ষিকতা অকার্যকর হয়ে পড়ে। আর আমার পরের দিকের গবেষণা প্রমাণ করেছে, সময়ের সূচনা এবং সমাপ্তিতে কী ঘটে, তা কোয়ান্টাম তত্ত্ব কীভাবে অনুমান করতে পারে। বেঁচে থাকা এবং তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণার সময়টি ছিল আমার জন্য খুবই উপভোগ্য। বিপুল এই মহাবিশ্বকে উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে আমি যদি কোনো কিছু যোগ করে থাকি, তাহলে সেটি হবে আমার জন্য ভীষণ আনন্দের।’
প্রথম আলো বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের প্রকাশনা ‘তারুণ্য’, সপ্তম সংখ্যা, আগস্ট ২০১৮ থেকে নেওয়া।