ছড়া-কবিতা কীভাবে লিখব

লেখালেখি, প্রতীকীছবি: রয়টার্স

আমাদের অনেকেরই খুব ইচ্ছা কবিতা-ছড়া লিখব। ছন্দ আর মিল দিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করব। কবিতা-ছড়া লিখে শামসুর রাহমান, সুকুমার বড়ুয়ার মতো খ্যাতিমান হব। কবি-ছড়াকার হিসেবে দেশজোড়া পরিচিতি পাব। এ আশায় কবিতা-ছড়া লিখব বলে প্রায়ই কাগজ-কলম নিয়ে বসি। হয়তো কখনো লিখেও ফেলি দু-চার লাইন। কিন্তু কাউকে বলি না, কাউকে দেখাই না, খাতা-কলম গুটিয়ে রাখি সংকোচে। মনে মনে ভাবি, লেখাটা কিছু হয়নি, দেখে সবাই হাসবে। আমি তো আর ছড়া-কবিতা লেখার কায়দাকানুন, কলাকৌশল কিছু জানি না। ভালো লিখব কী করে? হ্যাঁ, ছড়া-কবিতা লেখারও কায়দাকানুন, কলাকৌশল আছে। ভালো লিখতে হলে সেগুলো আগে ভালো করে জানা দরকার। আমরা যদি সত্যি কবিতা-ছড়া লিখতে চাই, তবে আগে সেগুলোর রূপ ও গঠনের সঙ্গে পরিচিত হতে হবে। অর্থাৎ আমাদের জানতে হবে—কাকে বলে কবিতা, কাকে বলে ছড়া। ছড়া ও কবিতা কেন এক নয়। ছড়া-কবিতা গঠনের পেছনে কোন কোন উপাদান কাজ করে। এসব বিষয় জানলেই লেখার জন্য তৈরি হতে পারব ভালোভাবে।

প্রথমে কবিতার কথা জানার চেষ্টা করি। কবিতা কাকে বলে, এ নিয়ে আলোচনার শেষ নেই। এখন বলা হয়, হৃদয়ের শুদ্ধ অনুভূতি ও আবেগের প্রকাশই কবিতা। কবির কল্পনা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি বা উপলব্ধি যখন সুনির্বাচিত শব্দসম্ভারে ছন্দোবদ্ধ অবস্থায় রসমতী রূপ লাভ করে, তখনই জন্ম হয় কবিতার। কবিতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে এডগার এলান পো বলেছেন, ‘কবিতা হলো সৌন্দর্যের ছন্দময় সৃষ্টি।’ ওয়ার্ডসওয়ার্থের বিবেচনায় ‘কবিতা হলো সমৃদ্ধ অনুভূতির স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বাসপ্রবাহ।’ কোলরিজের ভাষায়, ‘সর্বোৎকৃষ্ট শব্দ সর্বোৎকৃষ্টভাবে সাজানোর নামই কবিতা।’ শেলি বলেছেন, ‘কবিতা হলো পরিতৃপ্ত ও মনের পরিতৃপ্তি এবং শ্রেষ্ঠ মুহূর্তের বিবরণ।’

ওপরের সংজ্ঞাগুলো থেকে মোটামুটি একটি বিষয় পরিষ্কার যে কবিতার জন্য তিনটি বস্তু জরুরি। বস্তু তিনটি হলো—শব্দ, ছন্দ ও সৌন্দর্য। অর্থাৎ এ তিনটি বস্তুর সমবায়েই কবিতা গড়ে ওঠে। এখানে সৌন্দর্য বিষয়টি একটু ব্যাখ্যার দাবি রাখে। আমাদের মনে রাখতে হবে, সৌন্দর্য কোনো একক উপাদান নয়। কয়েকটি সূক্ষ্ম উপাদানের শব্দমালার সান্নিধ্যে সুমধুর ছন্দে যখন কোনো বিশেষ সৌন্দর্যের প্রকাশ ঘটে, তখন তাকে বলা যেতে পারে কবিতা। কিন্তু কবিরা শব্দে-ছন্দে কীভাবে এ সৌন্দর্যের প্রকাশ ঘটান?

আমাদের চারপাশের চেনাজানা জগৎকে আমরা সাধারণ চোখে যেভাবে দেখি, কবিরা ঠিক সেভাবে দেখেন না। যেমন আমরা প্রতিদিন সূর্যকে দেখি। আর সূর্যকে আমরা সূর্যই বলি। কিন্তু কবিরা সরাসরি তা বলেন না। তাঁদের কেউ সূর্যকে বলেন ‘আগুনের কলস’, আবার কেউ বলেন ‘এক চক্ষু চশমা’। চাঁদকে কবিদের কেউ কেউ বলেন ‘ঝলসানো রুটি’, কেউবা ‘দুধভরা ওই চাঁদের বাটি’। কখনো আবার কবিরা চাঁদকে তুলনা করেন গাছের ডগায় ঝুলে থাকা ডাবের সঙ্গে। আমরা যা দেখি না, কবিরা তা দেখতে পান বলে এবং দেখার বা ভাবনার অভিজ্ঞতা ও অনুভূতিকে কল্পনার রং মিশিয়ে শব্দ দিয়ে গেঁথে ছন্দ-সুরে জড়িয়ে ছবির মতো করে সাজিয়ে প্রকাশ করতে পারেন বলেই তাঁরা কবি।

কবিতা যেকোনো বয়সের পাঠকের জন্য লেখা হতে পারে। বড়দের জন্য যে ধরনের রচনাকে সরাসরি কবিতা বলে বোঝানো হয়, ছোটদের জন্য তাকে বোঝানো হয় ‘ছোটদের কবিতা’ বা ‘কিশোর কবিতা’ বলে । শব্দ, ছন্দ ও সৌন্দর্য—এই তিন শিল্পোপকরণের সুষ্ঠু সম্মিলনেই কবিতার মতো কিশোর কবিতাও গড়ে ওঠে। তবে কবিতার এই কয়টি অপরিহার্য শর্তের সঙ্গে কিশোর কবিতাকে আরেকটি বাড়তি শর্ত পূরণ করতে হয়, তা হলো কিশোর উপযোগিতা। কিশোর কবিতাকে হতে হয় অবশ্যই কিশোরদের উপযোগী, অর্থাৎ কিশোর পাঠকদের বোধগম্য মানের, সরল।

কবিতার তিন প্রধান উপাদানের অন্যতম ছন্দ। ছান্দসিকেরা বলেছেন ছন্দ হচ্ছে ‘গতি-সৌন্দর্য’। গতি যদি অনিয়ন্ত্রিত হয়, তাহলে তা কখনো সুন্দর হতে পারে না। ছন্দের গতি সুনিয়ন্ত্রিত। তাই ছন্দের গতিতে সহজেই একধরনের সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। ভাষা ও ছন্দের সমন্বয়ে কবির কোনো অনুভূতি যখন রসাত্মক বাক্যে রূপ পায়, তখনই জন্ম হয় সার্থক কবিতার। কাজেই উৎকৃষ্ট কবিতার রস সৃষ্টির ক্ষেত্রে ছন্দের ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

ছন্দ প্রধানত তিন প্রকার। স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্ত। ছড়া-কবিতায় নির্ভুল প্রয়োগের জন্য ছন্দের নিয়মকানুন জানা অত্যন্ত জরুরি। ছন্দে মাত্রা গণনার নিয়ম আছে। আবার ছন্দ গঠনেরও কতগুলো উপাদান আছে, অর্থাৎ কতগুলো উপাদানের ওপর ভিত্তি করে ছন্দ গঠিত হয়। তবে সব ছন্দে উপাদানগুলোর প্রয়োগ এক নিয়মে ঘটে না। যাহোক, উপাদানগুলো হলো অক্ষর, মাত্রা, যতি, ছেদ, পর্ব, চরণ, অন্ত্যমিল, স্তবক ইত্যাদি। এর সব কটিই আবার ছন্দের প্রধান উপাদান নয়। প্রধান বা মূল উপাদানগুলো হলো অক্ষর, মাত্রা, পর্ব, চরণ। এ উপাদানগুলো একটি আরেকটির ওপর নির্ভরশীল। অনেকটা সময় গণনার হিসাবের মতো। সময় গণনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে ছোট একক ধরা হয় সেকেন্ডকে, তারপর সেকেন্ড নিয়ে মিনিট, মিনিট নিয়ে ঘণ্টা, ঘণ্টা নিয়ে দিন—এভাবে মাস, বছর ইত্যাদি হয়।

ছন্দের বেলায়ও ছোট একক, বড় একক আছে। ছন্দের ক্ষুদ্রতম একক ‘অক্ষর’ আর বৃহত্তম একক ‘স্তবক’।

ছন্দের প্রথম উপাদান ‘অক্ষর’, বর্ণ নয়। ছন্দে অক্ষর কথাটি ব্যবহৃত হয় সিলেবল অর্থে। ইংরেজিতে সিলেবল বলতে উচ্চারণের ক্ষুদ্রতম ধ্বনি বোঝায়। আমরা যে শব্দ উচ্চারণ করি, তা সম্পূর্ণ হয় কতগুলো ধ্বনির সমন্বয়ে। ছোট-বড় যেকোনো শব্দকে একটু টেনে উচ্চারণ করলে আলাদা কতগুলো ধ্বনি বা অক্ষর স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আমাদের বাগ্‌যন্ত্রের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধ্বনি মিলে একটি পুরো শব্দ উচ্চারিত হয়। যেমন ‘ছড়া’ শব্দটি উচ্চারিত হয় ‘ছ’+‘ড়া’—দুটি ক্ষুদ্রতম ধ্বনির সমন্বয়ে। বাগ্‌যন্ত্রের এই একেকটি ক্ষুদ্রতম ধ্বনিকে ইংরেজিতে ‘সিলেবল’ ও বাংলায় ‘অক্ষর’ বলা হয়। ছান্দসিক প্রবোধচন্দ্র সেন সিলেবলকে বলেছেন ‘দল’। আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সিলেবলকে ‘ধ্বনি’ বলে ব্যবহার করেছেন।

অক্ষর দুই ধরনের হয়ে থাকে। স্বরান্ত অক্ষর বা মুক্তাক্ষর (ওপেন সিলেবল) ও ব্যঞ্জনান্ত অক্ষর বা বদ্ধাক্ষর (ক্লোজড সিলেবল)। মুক্তাক্ষরকে অযুগ্ম ধ্বনি ও বদ্ধাক্ষরকে যুগ্ম ধ্বনিও বলা হয়ে থাকে। যেসব অক্ষরের শেষে স্বরধ্বনি উচ্চারিত হয়, সেগুলোকে স্বরান্ত অক্ষর বলে। যেমন আ, ই; মা = ম + আ, টি = ট + ই। এসব অক্ষর উচ্চারণের শেষে মুখ খোলা বা মুক্ত থাকে বলে এগুলোর আরেক নাম মুক্তাক্ষর। যেসব অক্ষরের শেষে ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারিত হয়, সেগুলোকে ব্যঞ্জনান্ত অক্ষর বলে। যেমন নাচ, দিন ইত্যাদি। এসব অক্ষর উচ্চারণের শেষে মুখ বন্ধ হয়ে যায় বলে এগুলোর আরেক নাম বদ্ধাক্ষর। প্রতিটি শব্দে কেবল সব মুক্তাক্ষর বা কেবল সব বদ্ধাক্ষর থাকে, তা নয়। উভয় ধরনের অক্ষরের সমন্বয়েও শব্দ হতে পারে, বড় শব্দগুলো সাধারণত এ রকমই হয়। ধরা যাক, ‘কঠিন’ শব্দটি। এ শব্দকে উচ্চারণের ক্ষুদ্রতম ধ্বনি অনুসারে ভাগ করলে দাঁড়ায়—‘ক’+‘ঠিন্‌’। এখানে ‘ক’ মুক্তাক্ষর আর ‘ঠিন্‌’ বদ্ধাক্ষর। আবার প্রথমে বদ্ধাক্ষর আছে আর পরে মুক্তাক্ষর আছে, এমন শব্দও হতে পারে। যেমন ‘ছন’+‘দ’। এভাবে একটি শব্দে দুইয়ের অধিক উচ্চারণধ্বনি, অর্থাৎ অক্ষরও থাকতে পারে। যেমন নাগরদোলা—‘না’+ ‘গর্‌’+ ‘দো’+ ‘লা’।

এই যে উচ্চারণের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধ্বনি বা অক্ষর, এগুলো প্রতিটি উচ্চারণের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় প্রয়োজন হয়। ছন্দ ব্যাকরণে প্রতিটি অক্ষর উচ্চারণের এই সময়ের পরিমাণকে বলা হয় মাত্রা। অর্থাৎ অক্ষরের ওপর ভিত্তি করেই মাত্রা গণনা করা হয়। মাত্রা গণনার দুটি নির্দিষ্ট চিহ্ন আছে। মুক্তাক্ষরের জন্য ব্যবহৃত হয় অর্ধবৃত্ত চিহ্ন আর বদ্ধাক্ষরের জন্য ব্যবহৃত হয় ড্যাশ (—) চিহ্ন। যেমন ‘সকাল’ শব্দটাই আমরা ধরি, স+কাল অথবা ‘সূর্য’ শব্দ যদি ধরি, সুর+য। মুক্তাক্ষর সব ছন্দের ক্ষেত্রেই এক মাত্রার মর্যাদা পায়। কিন্তু বদ্ধাক্ষর কোনো কোনো ছন্দের ক্ষেত্রে দুই মাত্রার মর্যাদাও পেয়ে থাকে। ছন্দভেদে মাত্রা গণনার এই নিয়ম এখন আমরা জেনে নিতে পারি।

স্বরবৃত্ত ছন্দ
এই ছন্দে প্রতিটি মুক্তাক্ষর এক মাত্রা এবং প্রতিটি বদ্ধাক্ষরও এক মাত্রা। যেমন কদম = ক + দম্‌। ‘ক’ মুক্তাক্ষর ১ মাত্রা আর ‘দম্’ বদ্ধাক্ষর ১ মাত্রা। সুতরাং কদম (১ + ১) ২ মাত্রা। বিদ্যালয় = বিদ্ + দা + লয়। এখানে ‘বিদ্‌’ বদ্ধাক্ষর ১ মাত্রা, ‘দা’ মুক্তাক্ষর ১ মাত্রা, আর ‘লয়’ বদ্ধাক্ষর ১ মাত্রা। সব মিলিয়ে বিদ্যালয় (১ + ১ + ১) ৩ মাত্রা।

মাত্রাবৃত্ত ছন্দ
এই ছন্দে প্রতিটি মুক্তাক্ষর ১ মাত্রা এবং প্রতিটি বদ্ধাক্ষর ২ মাত্রা। যেমন কদম = ক + দম্‌। ‘ক’ মুক্তাক্ষর ১ মাত্রা আর ‘দম্’ বদ্ধাক্ষর ২ মাত্রা। সুতরাং কদম (১ + ২) ৩ মাত্রা। বিদ্যালয় = বিদ্ + দা + লয়। এখানে ‘বিদ্‌’ বদ্ধাক্ষর ২ মাত্রা, ‘দা’ মুক্তাক্ষর ১ মাত্রা, আর ‘লয়’ বন্ধাক্ষর ২ মাত্রা। সব মিলিয়ে বিদ্যালয় (২ + ১ + ২) ৫ মাত্রা।

অক্ষরবৃত্ত ছন্দ
এই ছন্দে প্রতিটি মুক্তাক্ষর ১ মাত্রা, বদ্ধাক্ষর যদি শব্দের শুরুতে ও মাঝে থাকে, তবে ধরা হয় ১ মাত্রা, কিন্তু যদি শব্দের শেষে থাকে, তাহলে ধরা হয় ২ মাত্রা। যেমন কদম = ক + দম্। ‘ক’ মুক্তাক্ষর ১ মাত্রা আর ‘দম্’ বদ্ধাক্ষর এবং শব্দের শেষে আছে, সে জন্য ২ মাত্রা। সুতরাং কদম (১ + ২) ৩ মাত্রা। বিদ্যালয় = বিদ্ + দা + লয়। এখানে ‘বিদ্‌’ বদ্ধাক্ষর শব্দের শুরুতে আছে, সে জন্য ১ মাত্রা, ‘দা’ মুক্তাক্ষর ১ মাত্রা, আর ‘লয়’ বদ্ধাক্ষর শব্দের শেষে আছে, তাই ২ মাত্রা। সব মিলিয়ে বিদ্যালয় (১ + ১ + ২) ৪ মাত্রা।

ছন্দের আরেকটি উপাদানের নাম যতি। কবিতা আবৃত্তিকালে নিশ্বাসের এই বিরতিকে বলা হয় যতি। যতি ছন্দের প্রয়োজনে উচ্চারণের বিরতি। যতি তিন প্রকার। যেমন পূর্ণ যতি, অর্ধযতি ও লঘু যতি। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক।
‘এইখানে তোর। দাদির কবর।। ডালিম গাছের। তলে।’

ওপরের পঙ্‌ক্তিটির শেষে, অর্থাৎ ‘তলে’-এর পরে আছে পূর্ণ যতি। ‘কবর’-এর পরে অর্ধযতি এবং ‘তোর’ ও ‘গাছের’ পরে আছে লঘু যতি। এই লঘু যতির ভিত্তিতেই ছড়া-কবিতার পঙ্‌ক্তিতে গঠিত হয় ‘পর্ব’।

ছন্দভেদে প্রতি পর্বে মাত্রাবিন্যাস বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। স্বরবৃত্ত ছন্দে সাধারণত পর্ব হয় ৪ মাত্রার। যেমন—
‘বৃষ্টি পড়ে। টাপুর টুপুর। নদেয় এলো। বান’

মাত্রাবৃত্ত ছন্দে ৫, ৬ ও ৭ মাত্রায়ও পর্ব গঠিত হয়। ৬ মাত্রা পর্বের একটি জনপ্রিয় পঙ্‌ক্তি হলো—
‘নীল নবঘনে। আষাঢ় গগনে। তিল ঠাঁই আর। নাহিরে’

৭ মাত্রা পর্বের একটি উদাহরণ হতে পারে—
‘খাঁচার পাখি ছিল। সোনার খাঁচাটিতে। বনের পাখি ছিল। বনে’

অক্ষরবৃত্ত ছন্দে সাধারণত ৮ মাত্রার পর্ব দিয়ে পঙ্‌ক্তি শুরু হয়। এর পর থাকে ৬ বা ৪ মাত্রার পর্ব। অক্ষরবৃত্ত ছন্দে ৮ + ৬ মাত্রার চালের একটি নিজস্ব নাম আছে। এর নাম পয়ার। আধুনিক কবিরা নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় অক্ষরবৃত্ত ছন্দকে প্রতিনিয়ত পরিপুষ্ট করে চলেছেন। এখন কেবল ৮ + ৬ মাত্রায় নয়, ৮ + ৮ + ৬ বা ৮+৬ + ৪ মাত্রার পর্ববিন্যাসেও রচিত হয়, যা মহাপয়ার হিসেবে পরিচিত। যেমন—
‘আবার আসিব ফিরে। ধানসিঁড়িটির তীরে—। এই বাংলায়।
হয়তো মানুষ নয়। হয়তো বা শঙ্খচিল। শালিকের বেশে;।
হয়তো ভোরের কাক। হয়ে এই কার্তিকের। নবান্নের দেশে।
কুয়াশার বুকে ভেসে। একদিন আসিব এ। কাঁঠাল ছায়ায়
(মাত্রাবিন্যাস ৮+৮+৬)

স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্ত—এ তিন ছন্দই পদ্যছন্দ। স্বরবৃত্ত দ্রুত লয়ের ছন্দ। এ ছন্দ ছড়ার জন্য খুব উপযোগী। মাত্রাবৃত্ত চলে মন্থর গতিতে। ফলে এতে সুরেলা আমেজের সৃষ্টি হয়। কাহিনি ও বর্ণনাধর্মী কবিতা এ ছন্দে বাড়তি প্রাণ পায়। অবশ্য ছড়া ও ছোটদের কবিতা রচনায় স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্ত উভয় ছন্দই বেশি ব্যবহৃত হয়। অক্ষরবৃত্ত ছন্দে সাধারণত ধীর লয়ে গুরুগম্ভীর বিষয়ের কবিতা লেখা হয়ে থাকে। বাংলা ছন্দে যুগে যুগে অনেক পালাবদল ঘটেছে। শেষ যুগান্তকারী পালাবদলের নাম গদ্যছন্দ বা গদ্যকবিতা। পদ্যছন্দের কৃত্রিম ও গাণিতিক বন্ধন থেকে মুক্ত করে কবিতাকে মৌখিক শব্দবিন্যাসে প্রকৃত জীবনধর্মী করার জন্যই কবিরা গদ্যছন্দকে বেছে নেন। এখন নবীন প্রজন্মের আধুনিক কবিদের প্রথম পছন্দ এ ছন্দ। তবে তা বড়দের কবিতার ক্ষেত্রে বেশি প্রযোজ্য।

কিন্তু গদ্যের আবার ছন্দ কী? হ্যাঁ, গদ্যেরও ছন্দ আছে। ভাষার স্বাভাবিক বাগ্‌ভঙ্গিই গদ্যের ছন্দ। তবে তা পদ্যের মতো নয়। পদ্যে যেমন মাত্রা, পর্ব, যতি, অন্ত্যমিল ইত্যাদির সমন্বয়ে ছন্দ সৃষ্টি হয়, গদ্যে ঠিক তেমনভাবে হয় না। পদ্যছন্দ নিয়মের শৃঙ্খলে আবদ্ধ আর গদ্যছন্দ মুক্ত। যতি, মাত্রা, পর্ব, অন্ত্যমিল—এসব বন্ধন গদ্যছন্দে থাকে না। তাই গদ্যের ছন্দ অস্ফুট, অপর দিকে পদ্যের ছন্দ প্রস্ফুট। পদ্যছন্দের বিন্যাস হয় নিয়মিত আর গদ্যছন্দের বিন্যাস হয় পরিমিত।

গদ্যছন্দে যতি, মাত্রা, পর্ব, অন্ত্যমিল ইত্যাদি বন্ধন থাকে না বলে এ ছন্দের গতি থাকে সব সময় অব্যাহত। এ ছন্দ এগিয়ে যেতে পারে বাধাহীনভাবে। আসলে গদ্য রচিত হয় অসম পর্বে। তাহলে সাধারণ গদ্য আর কবিতার গদ্যের মধ্যে তফাত কোথায়? তফাত অবশ্যই আছে। কোনটা গদ্য রচনা আর কোনটা গদ্যের ছাঁচে কবিতা, তা প্রথম নির্ভর করে বিষয়ের ওপর এবং বিষয় ও লক্ষ্যের উপযোগী প্রকাশপদ্ধতির ওপর, ব্যাকরণগত বিশেষ শ্রেণির বাক্যগঠনের ওপর নয়।
যেমন—
কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখেনি
ছেলেবেলায় এক বোষ্টমি তার আগমনী গান হঠাৎ থামিয়ে বলেছিল
শুক্লা দ্বাদশীর দিন অন্তরাটুকু শুনিয়ে যাবে
তারপর কত চন্দ্রভূক অমাবস্যা চলে গেল কিন্তু সেই বোষ্টমি
আর এলো না
পঁচিশ বছর প্রতীক্ষায় আছি।...
[কেউ কথা রাখেনি: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়]

সাধারণভাবে ছোটদের কবিতা বা কিশোর কবিতা, ছড়া ও পদ্যে ছন্দের পাশাপাশি অন্ত্যমিলের দাবিও উপেক্ষা করা যায় না। ছন্দ ছড়া-কবিতায় আনে সুরময়তা আর অন্ত্যমিল আনে ধ্বনিময়তা। অন্ত্যমিল নিয়ে নিরীক্ষা বড় হয়ে না উঠলে ছোটদের কবিতা–ছড়া-পদ্যে পঙ্‌ক্তির শেষে অন্ত্যমিলের আয়োজন রাখা ভালো। আসলে ছন্দ ও অন্ত্যমিলের যথার্থ প্রয়োগ ছাড়া কি ছোটদের কবিতা-ছড়া-পদ্যে প্রাণসঞ্চার করা সম্ভব? আমার তো বরাবরই অসম্ভব মনে হয়।

ছন্দ ও অন্ত্যমিলের সৌন্দর্য শ্রুতিগ্রাহ্য হয় আবৃত্তির মাধ্যমে—তা হতে পারে কবিতা, ছড়া বা পদ্য। ছন্দ ও অন্ত্যমিলের কারণে কবিতা, ছড়া ও পদ্যকে সাধারণভাবে এক মনে হলেও আসলে তিনটি আলাদা শাখা। তিন শাখার মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। একটু সচেতন হলে এ পার্থক্য বোঝা যায় এবং মানা যায়।

ছড়ারও একটা নিজস্ব ভাষা আছে। রবীন্দ্রনাথের কথায় ছড়া ‘গাম্ভীর্য নয়, অর্থের মারপ্যাচ নয়’, অর্থাৎ সহজ কথায় লেখা। এ কারণে কিছুটা অর্থপূর্ণ গাম্ভীর্য কবিতায় প্রশ্রয় পেতে পারে, পদ্য বা ছড়ায় কখনোই নয়। পদ্য কী? সাধারণভাবে ছন্দোবদ্ধ বাক্য বা পদগুলোর নাম পদ্য। পদের সঙ্গে পদ মিলিয়ে এসব রচিত হতো বলে এ শ্রেণির রচনাকে আখ্যা দেওয়া হতে থাকে পদ্য। পদ্য কাব্য-অলংকারহীন সাদামাটা।

অন্যদিকে কবিতার গঠনকৌশলের প্রথম উপাদান ভাব। এই ভাবের আশ্রয় আবার ভাষা। আর ভাষা তো হলো শব্দেরই সমষ্টি। কবিরা তাই কেবল কল্পনার সম্রাটই নন, শব্দের জাদুকরও। কবিরা যে শব্দের সহযোগে তাঁদের ভাবনারাশি ছন্দে গেঁথে দেন, সেই শব্দমালাই কবিতা। সুতরাং কবিতায় শব্দ চয়নের গুরুত্বও অনেকখানি। ভাবকে বহন করার যথোপযুক্ত শব্দ ব্যতিরেকে কবিতা হয় না। সংগীত যেমন বাণীর মর্ম প্রচারের জন্য খোঁজে সুর, চিত্রকলা যেমন খোঁজে রং, তেমনি কবিতা খোঁজে শব্দ। তবে যেকোনোভাবে ব্যবহৃত শব্দগুচ্ছ কবিতা পদবাচ্য হয় না। কবিতার শব্দগুলোকে এমনভাবে ব্যবহার করতে হয়, যাতে সেগুলো জোনাকির মতো জ্বলে ওঠে। অর্থাৎ কবিতা হয়ে ওঠার জন্য বাক্যের শব্দসমষ্টির একটি বিশেষ উজ্জ্বলতা থাকা চাই। সে উজ্জ্বল গুণটার নাম কাব্যগুণ বা শিল্পগুণ। কাব্যগুণ কী? কাব্যগুণ হলো শব্দের সৌন্দর্য সৃষ্টির ক্ষমতা। কবিতায় ভাবকে ফুটিয়ে তোলার জন্য সুসমমাত্রায় শব্দের পর শব্দ গেঁথে উপমা-উৎপ্রেক্ষা-চিত্রকল্প যোজনার মাধ্যমে কবিকে সৌন্দর্য নির্মাণ করতে হয়। কবি বুদ্ধদেব বসু তাঁর ‘চিল্কায় সকাল’ কবিতায় যখন বলেন—
‘আকাশে সূর্যের বন্যা, তাকানো যায় না।’

তখন আমাদের অতিপরিচিত ‘আকাশ’, ‘সূর্য’, ‘বন্যা’ শব্দগুলো আক্ষরিক অর্থের খোলস থেকে বেরিয়ে আমাদের সামনে এমন ছবি হাজির করে, যা আমরা চোখ বন্ধ করলেও দেখতে পাই এবং এ ছবির ঔজ্জ্বল্য ও বিশালতা আমাদের কল্পনাকে হার মানায়। কবিতায় সুনির্বাচিত দুই বা ততোধিক শব্দের সহযোগ এভাবে অর্থের নবতর রূপান্তর ঘটায়। কবির সাফল্য সম্পূর্ণ নির্ভর করে মূলত শব্দের সহযোগের ওপর। এভাবে ক্রমশ কথার পিঠে অর্থের দোলা লেগে প্রকাশ পায়। একটি পরিপূর্ণ ভাব বা বিষয়। কবিতা এমনই।

আধুনিক কালের কবিতা-ছড়ার প্রধান উপজীব্য সমকালীন জীবন ও সমাজবাস্তবতা। কিন্তু একজন কবি বা ছড়াকার বাস্তবতার কতটুকু প্রকাশ করবেন তাঁর রচনায়? কবি-ছড়াকার কোনো ঘটনা বা দৃশ্য বাস্তবে যেভাবে প্রত্যক্ষ করলেন, তা শব্দের মালা গেঁথে হুবহু প্রকাশ করলে কি ছড়া-কবিতার অন্যান্য শর্ত পূরণ হয়? এ প্রশ্নের জবাব আমরা খুঁজে পেতে পারি কবি পাবলো নেরুদার একটি উক্তি থেকে। তিনি বলেছেন, ‘যে কবি বাস্তববাদী নন, তিনি মৃত, আর যে কবি শুধুই বাস্তববাদী তিনি ততোধিক মৃত।’ কবিতায় বাস্তবের প্রত্যক্ষ প্রতিফলন যেমন কবিতা নয়, তেমনি কল্পনাবিলাসও কবিতা নয়। প্রকৃত কবিতা হলো কল্পনা ও বাস্তবের মিশ্রণ, সুনির্বাচিত শব্দবিন্যাসে যা সবার কাছে হৃদয়গ্রাহী হয়ে ওঠে। এ কবিতা বড় বা ছোট—যাদের জন্যই লেখা হোক না কেন, এর নির্মাণকৌশল সব সময়ই হবে এ রকম। ছড়ার ক্ষেত্রে এ শর্ত কিছুটা শিথিলযোগ্য। ছড়ায় বাস্তব অবস্থার সঙ্গে কল্পনার মিশ্রণ জরুরি নয়। অতিমাত্রায় কল্পনার খাদ ছড়ার ছড়াত্ব ক্ষুণ্ন করতে পারে।

ছড়া-কবিতায় নির্দিষ্ট কিছু পঙ্‌ক্তি–কাঠামোর ভেতর পুরো একটি ভাব-অবয়বকে মূর্ত করে তুলতে হয়। তাৎক্ষণিক বা যান্ত্রিকভাবে এ কাজ করা সম্ভব হয় না। তবে এ কথাও সত্য, কবিতা কোনো পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ধীরেসুস্থে তৈরি হয়ে ওঠে না; প্রবল কোনো ঘটনা বা উপলব্ধির অভিঘাতে কবি যখন মুহ্যমান, তখন তার সেই বিবশ ও আচ্ছন্ন অবস্থার মধ্যেই কবিতা জন্ম নেয়। কবিতার উৎসভূমি যা-ই হোক, কবিতা লিখতে হয় অনুভূতি জেগে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে। তা না হলে অনুভূতি উত্তাপ হারিয়ে বুদ্‌বুদের মতো মিলিয়ে যায়। অন্নদাশঙ্কর রায় তা-ই বলেছেন, ‘কবিতা হচ্ছে তপ্ত লুচি।’ অনুভূতির উত্তাপ থাকতে থাকতেই কবিতার বিমূর্ত অবয়বকে মূর্ত করে তুলতে হয়। কবি শেষ পর্যন্ত সক্রিয় থাকলে তা অলৌকিকভাবে মূর্ত হয়ে ওঠে। এই অভিজ্ঞতাকে কবি আল মাহমুদ প্রকাশ করেছেন অত্যন্ত সুন্দরভাবে। তিনি বলেছেন, ‘লেখার সময় মনে হয় কিছুই হচ্ছে না, তারপর আবার একসময় মনে হয় কবিতাটি একটি সুন্দর রঙিন প্রজাপতি।’

তাহলে আমার–আপনার–তোমার লেখা কবিতাটি কেন প্রজাপতি হয়ে উঠবে না? অবশ্যই রঙিন প্রজাপতি হয়ে উঠবে। এবার শুরু করা যাক কবিতা লেখা আর ছড়া লেখা, মেতে ওঠা যাক ছন্দ-মিলের মধুর খেলায়।

সুজন বড়ুয়া: শিশুসাহিত্যিক

লেখাটি ২০১৫ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের ‘তারুণ্য’ ম্যাগাজিনের পঞ্চম সংখ্যা থেকে নেওয়া।