কিনু চোরা

ছবি: এআই/বন্ধুসভা

এক.
‘কী চোর?’
খানিকটা বিরক্ত হয়েই প্রশ্নটা করল মিতু। রোজকার এই তামাশা একেবারে অসহ্য হয়ে পড়েছে বাড়ির সবার কাছে।

মিতুর মা ফাতেমা বেগমের মাথায় একটু সমস্যা আছে! বাড়ির লোকের তাই ধারণা। তবে ফাতেমা বেগম বলেন, তিনি নাকি অধোতাত্ত্বিক ক্ষমতাসম্পন্ন। জিন, পরি, কালোজাদু নাকি নিমেষেই টের পান। প্রমাণ অবশ্য কেউ চাইতে যায়নি কখনো। ডাক্তার দেখানোর কথা বাবা রায়হান খানকে বেশ কয়েকবার বলেছিল মিতু। তিনি গা ছাড়া ভাব করে এড়িয়ে গেছেন। তার মতে, ‘তোমার মাকে কী বলে নেব ডাক্তারের কাছে? নিতে গেলেই বুঝে ফেলবে, অশান্তি বাড়বে।’

স্ত্রীর কাছে মিথ্যা বলেন না রায়হান খান। ফাতেমা এমনিতে দুর্বল হার্টের রোগী, তার ওপর বছরখানেক হলো রক্তে চিনির পরিমাণ অস্বাভাবিক মাত্রায় বেড়ে গেছে। ডাক্তার দুশ্চিন্তা করতে একদমই নিষেধ করেছেন; কিন্তু তা আর হচ্ছে কই!

ইদানীং মিতুরা ঢাকার পাট চুকিয়ে নিজেদের গ্রামে ফিরে এসেছে। এখানেই মিতু একটা সরকারি স্কুলে ইংরেজি পড়ায়। বাবা অবসর নিয়েছেন। আর আছে এক বড় ভাই, রাহাত। সে স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে থাকে খুলনা। ছুটিতে বাড়ি আসে। বাড়িতে ফাতেমা বেগম, রায়হান সাহেব, মিতু, কাজের খালা ফিরোজা, পাহারাদার পাচু মিয়া, তার বাবা রহমত মিয়া আর আছে একজন মাদ্রাসার অল্প বয়সী ছেলে। নাম হারুন। দালানের পূর্ব পাশের টিনের ঘরে থাকে। বেচারা এতিম; কিন্তু পড়াশোনায় ভালো। রায়হান সাহেব সব খরচ বহন করেন।

এ ছেলেটাই হলো সমস্যার উৎস। হারুন আসার পর থেকেই বাড়িতে অস্বাভাবিক সব ঘটনা ঘটতে লাগল। ফাতেমা বেগম সবকিছুর দোষ হারুনের ঘাড়ে দিতে লাগল। এই যেমন সেদিনের ঘটনা, গোসল করার জন্য গামছা আর লুঙ্গি নিয়ে রায়হান সাহেব গোসলখানায় ঢুকেছিলেন। পুরোনো আমলের গোসলখানা। গোসল শেষে হ্যাঙ্গারে হাত বাড়িয়ে দেখেন গামছা নেই! অথচ ওনার মনে আছে গামছা নিয়েছিলেন। মিতু বলল, ‘আহা, আব্বা ভুল তো হতেই পারে।’

ঘটনা সেদিন ওখানেই শেষ হতো! কিন্তু হুট করে রান্নাঘর থেকে ফাতেমা তড়িঘড়ি এসে বললেন, ‘আমি কইছিলাম যে ওই ছেলেই করে এসব। আগে তো এমন হতো না। আমিও ওই দিন দেখছি ডালায় পেঁয়াজ কম, লবণের ডাব্বা খোলা, ফ্রিজে ডিম ছিল তিনটি, একটি উধাও। এসব করে কিসে?’
মিতু বেশ বিরক্ত হলো। কারণ, এ কথাগুলো ওর কাছেই মা বেশি বলে। ফাতেমা বেগম আবারও বললেন ফিশফিশিয়ে। যেন কেউ শুনে ফেললে বিপদ!
‘ওই হারুনই করে, আমি বুঝতে পারি। ও আসলে ভেলকি জানে। ও মানুষ হইলে কী হবে, ও একটা কিনু চোর।’

শেষ কথাটায় মিতু ভড়কে গেল। এ আবার নতুন কোন জিনিস! বিরক্ত হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘কি চোর? কিনু চোর?’
রায়হান সাহেব ক্লান্ত হয়ে নিজের ঘরে চলে গেলেন।
ফাতেমা বেগম ভ্রু কুঁচকে বিরক্তি প্রকাশ করে কিছু একটা বলতেই যাচ্ছিল, এমন সময় নাকে পোড়া গন্ধ আসতেই মাথায় হাত দিয়ে জিভ কেটে তড়িঘড়ি আবার রান্নাঘরে চলে গেলেন। মিতু আপন মনে বিড়বিড় করতে করতে ছাদে গেল বাবার ভেজা কাপড়গুলো মেলে দিতে। গামছা আর পাওয়া যায়নি। খাবার পোড়ার দোষও গেল হারুনের ঘাড়ে!

দুই.
এ বাড়ির তিনজন লাঠিয়ালের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক রহমত মিয়া। মিতুর দাদার আমল থেকে আছেন তিনি। বয়স সত্তর পেরিয়েছে। চোখেও কম দেখেন; কিন্তু শরীরে তেজ আছে আগের মতোই। পাহারাদার পাচু হচ্ছে রহমত মিয়ার ছেলে। পালা করে মাঝেমধ্যে বাপ-ব্যাটা দুজনই বাড়ি পাহারা দেয়। আজকেও তা–ই করছে। প্রথম ভাগে পাচু মিয়া পাহারা শেষ করে ঘুমাতে গিয়েছে। এখন পাহারায় আছে রহমত মিয়া। লোকটার একটাই দোষ, সময় অসময় তাড়ি খায়। তাড়ি খেলে তাঁর হুঁশ থাকা দায়। আজও ব্যতিক্রম হলো না। এক ঘটি তাড়ি নিয়েই বসলেন উঠানের ওপরে রাখা চকিতে।

বেশ গরম পড়েছে। তার ওপরে আজ আবার মিতু চুলে তেল দিয়েছে। মাথা, ঘাড়, পিঠ ঘামে প‍্যাচপ‍্যাচ করছে। বাইরের খোলা হাওয়ায় বসে থাকলে গরম কমতে পারে। লোডশেডিংয়ে সারা বাড়ি ঘুটঘুটে অন্ধকার। শুধু রহমত মিয়া পায়ের কাছে একটা কুপিবাতি জ্বালিয়ে বসে আছে। খানিক নেশা ভাবও হয়েছে তাঁর। মিতু শাড়ির আঁচলে ঘাড় মুছতে মুছতে এসে বসল রহমত মিয়ার পাশে। গুনগুন করে গজল গাইছে সে। মিতু মুচকি হাসল। সত‍্যিই নেশায় ধরেছে রহমত মিয়াকে। সে প্রশ্ন করল— ‘আচ্ছা দাদা, তুমি কখনো কিনু চোর দেখেছ?’
প্রশ্নটা মিতু মজার ছলেই করল। কিন্তু নেশার ঘোরে রহমত বলল,
‘হু! হ দেখছি তো। আমাগের গিরামেই তো ছেলো। কিনে পাগলা। জ্ঞাতিগুষ্টি কেউ ছেলো না। কিন্তু ও ব‍্যাবাক খাইয়ে–পইরে ভালো ছেলো। সবাই কইয়ে বেড়াতো ওরে নাকি জিনে সব দেয়।’
মিতু বেশ মজা পেল। আবার জিজ্ঞেস করল,
‘তারপর!’
‘এক জ্যোৎস্না রাইতে গিরামে এক বিশাল গুইসাপ হানা দেলো। এর পালের হাঁস, ওর পালের ছাগল সব টাইনে নিয়ে যাতো। তোমাগে বাঁশবাগানে ছেলো আস্তানা। তোমার দাদা তখন পালা কইরে পাহারা বসাল। একদিন ভোরবেলা সূর্য উঠার ইট্টু আগে আমি, ঝন্টু আর মনার বাপ মিলে গুইসাপটারে মারলাম। এহনো আমার মনে আছে, ১৫ ফুট লম্বা আর ৯০ কেজি ওজন ছিল। আমরা ওরে ৪ ভাগ কইরে কাইটে বাঁশবাগানেই কবর দিয়ে দিছিলাম। এহন তার ওপর রক্তজবা গাছ আছে।’

এবার একটু গা শিউরে উঠল মিতুর। এমন অস্বাভাবিক আকৃতির সরীসৃপ তাদের বাড়িতেই ছিল! জবাগাছটা সে দেখেছে। সব সময়ই ফুল ফুটে লাল হয়ে থাকে। রহমত মিয়া আবার বলতে লাগলেন,
‘ওই দিন থেইকে কিনে পাগলারেও আর খুঁজে পাওয়া গেল না। আস্তে আস্তে সবার মনে হলো কিনে পাগলাই গুইসাপের ছুল ধইরে চুরি করত।’

কেমন যেন লাগল মিতুর। উঠে দাঁড়াল সে। সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎও এল। পেছন ফিরতে যাবে, তার আগেই রহমত মিয়া হো হো করে মিতুর সামনে এগিয়ে গেল। হাতে বিশাল লাঠি। আগেপিছে না ভেবে সে মাটি লক্ষ্য করে সজোরে একটি বাড়ি মারল। ফ‍্যাচ করে একটি শব্দ হলো। পেছল, মাংসজাতীয় কিছুতে আঘাত করলে যেমন শব্দ হয় তেমন। আচমকা এমন হওয়ায় মিতু খানিক ঘাবড়ে গেল। সামনে এগিয়ে এসে তাকাল মাটির দিকে। সঙ্গে সঙ্গে গা গুলিয়ে উঠল। বাড়ির পেছনে জ্বলতে থাকা হলুদ আলোয় দেখা গেল একটা তিন হাত মতো লম্বা, মোটা কালো রঙের সাপ পড়ে আছে নিচে। মাথাটা থেঁতলে গেছে। পিচ্ছিল তরল আশপাশে। মিতু তাকাতে পারল না আর। বমি করে দেওয়ার জোগাড়। শরীর এখন দ্বিগুণ ঘেমেছে। তেলমাখা চুল বেয়ে ঘাম পড়ছে টুপটুপ করে। মিতু সোজা ঘরের ভেতরে চলে গেল।

তিন.
‘এই ওঠ। কিরে! এমন ফ‍্যান না ছেড়ে, পা ঝুলিয়ে পাগলের মতো উপুড় হয়ে আছিস কেন?’

ফাতেমা বেগম বেশ বিরক্ত হলেন। জোরে একটা ধাক্কা দিলেন মিতুকে। তৎক্ষণাৎ নিজেই আঁতকে উঠলেন। মিতুর সারা শরীর পুড়ে যাচ্ছে। এত জ্বর কখন উঠল। বারবার নিষেধ করেছিলেন যাতে এই গরমে রাতে চুলে তেল না দেয়। কে শোনে কার কথা। তিনি আবার ডাকতেই যাচ্ছিলেন। তার আগেই মিতু নড়তে লাগল। ধীরে ধীরে উঠে বসল। মাথা প্রচণ্ড ব‍্যথা। ঘামে চুলও ভেজা। চোখ মেলে সামনে মাকে দেখেই চমকে উঠল। গত রাতের সব ঘটনা চোখের সামনে ভেসে উঠল। সহসাই প্রশ্নটা করে বসল সে—
‘হারুন কি বাড়ি আছে?’
ফাতেমা বেগম এমন প্রশ্ন আশাই করেননি। ভ্রু কুচকে বললেন,
‘জানি না। সকাল থেকে দেখিনি। ও কোথায় জেনে তু্ই কি করবি?’
‘দাদা যে কাল রাতে সাপটা মারল, ওটা কী করেছে?’
এবার ফাতেমা বেগমের মনে পড়ল যে তিনি তো এই কথা বলতেই এসেছিলেন; কিন্তু মিতু আগে থেকেই জানল কীভাবে? গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলেন,
‘তুই আবার রাতে বাইরে গিয়েছিলি? তোকে না আ...’
‘আহ! মা, যা বলছি তার উত্তর দাও।’
‘বাড়ির পেছনে একটা গর্ত করে চাপা দিয়েছে রহমত কাকা।’

মিতু দ্রুত উঠে দাঁড়াল। খোলা চুল খোঁপা করতে করতে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। সোজা গিয়ে ঢুকল হারুনের ঘরে। ফাঁকা ঘর। এক কোণে একটা পুরোনো মরিচা ধরা বাক্স। পাশে পড়ার টেবিলে বই, কোরআন শরিফ, পেস্ট, ব্রাশ, একটা ছোট আয়না, চিরুনি আর একটা ঘড়ি রাখা। কি মনে হতেই মিতু একটা ইটের টুকরা বাইরে থেকে এনে বাক্সের তালাটা ভেঙে ফেলল। সেই শব্দে বাকিরাও ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে। মিতুর তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই। বাক্সের ডালাটা খুলতেই সবাই আতঁকে উঠল; কিন্তু মিতুর চোখে যেন যুদ্ধ জয়ের হাসি। এত দিনের মানসিক যুদ্ধ অবশেষে সে জয় করেছে।

বাক্সে পাওয়া গেল তিন টুকরা সাপের খোলস আর রায়হান সাহেবের হারিয়ে যাওয়া সেই গামছা!

শিক্ষার্থী, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ