মক্তব থেকে ফিরে, বেতে বোনা শের ভরে মুড়ি আর পাটালি খেজুরের গুড় নিয়ে টুল পেতে বসে যেতাম উঠানে। পিঠে রোদ লাগিয়ে মচমচ করে গুড়মুড়ি খেতাম আর পাঠশালার পাঠ ঠোঁটস্থ করতাম।
ইট-কাঠের শহরে শীতের হাওয়া বইছে। মফস্সল বা গ্রামাঞ্চলে শীতের শুরু থেকে ঠান্ডা অনুভূত হলেও এই দূষণ আর কার্বন ডাই-অক্সাইডের শহরে শীতের হাওয়া বয় অনেক দেরিতে। ডিসেম্বর রেইনের পর থেকেই শহরবাসী শীতের শীতল পরশ টের পাচ্ছে। সারা দিনের মিঠে রোদে মিশে থাকছে আলস্য। বেলা গড়ার সঙ্গে সঙ্গেই উত্তরের হিমেল হাওয়া এসে গায়ে ঠান্ডা পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে। রাস্তার পাশের ভ্রাম্যমাণ পিঠাপুলি আর মহল্লার মোড়ের চায়ের দোকানগুলোতে উপচেপড়া ভিড়, যেন উৎসব লেগেছে। শীত এলেই এসব দোকানে নিয়মিত খদ্দেরের পাশাপাশি মৌসুমি খদ্দেরের পদচারণে মুখর হয়ে ওঠে। শীতে উষ্ণতা খুঁজতে কেউ মুখ ডোবায় ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে, কেউবা আবার মশগুল থাকে চুলা থেকে সদ্য নামানো চিতই কিংবা ভাপা পিঠায়।
শীতে শহরের প্রকৃতি-পরিবেশের তেমন একটা পার্থক্য চোখে না পড়লেও গ্রামাঞ্চলের প্রকৃতি-পরিবেশে এক ভিন্নমাত্রা যুক্ত হয়। ধান কাটা, ধানমাড়াই করা, পৌষ-পার্বণের পিঠা তৈরি, শীতের সবজি চাষ, বিয়ের ধুম, চড়ুইভাতি, যাত্রাপালাসহ আরও নানা কাজে মানুষ মেতে থাকে। মফস্সলে থাকার কারণে খুব গভীরে শীত উপভোগ করার সুযোগ হয়েছে। কত সুখের স্মৃতি জড়িয়ে আছে শৈশবের শীত ঘিরে। কাকডাকা ভোরে যখন গাছের পাতা বেয়ে শিশির টুপ টুপ করে টিনের চালে পড়ত; আমরা কচিকাঁচার দল বরফধোয়া পানিতে অজু করে, কাঁপতে কাঁপতে মক্তবে যেতাম। আমাদের শরীরের কাঁপুনি দাঁতকপাটিতে লেগে কিটকিট আওয়াজ তুলে মিলিয়ে যেত ভোরের নিস্তব্ধতায়।
মক্তব থেকে ফিরে, বেতে বোনা শের ভরে মুড়ি আর পাটালি খেজুরের গুড় নিয়ে টুল পেতে বসে যেতাম উঠানে। পিঠে রোদ লাগিয়ে মচমচ করে গুড়মুড়ি খেতাম আর পাঠশালার পাঠ ঠোঁটস্থ করতাম। পাঠ ঠোঁটস্থ শেষে, গরম–গরম ভাতের সঙ্গে নানা পদের ভর্তা মেখে খেয়ে—হেলেদুলে চলে যেতাম পাঠশালায়। শুক্রবারের সকাল ভিন্ন আঙ্গিকে শুরু হতো। আমরা কচিকাঁচার দল ঘুম থেকে উঠে, চোখ কচলাতে কচলাতে মল্লিকদের বাগানে জড়ো হতাম; জলপাই, বরই কুড়িয়ে—কে কত বড় জলপাই, বরই কুড়িয়েছে, তা নিয়ে প্রতিযোগিতায় মেতে উঠতাম। কখনো কখনো খোলা মাঠে ঘন হয়ে পড়ে থাকা কুয়াশার ভেতর লুকোচুরি খেলতাম। কুয়াশা এত ঘন হয়ে পড়ে থাকত—১ ফুট দূরে কী আছে, তা দেখা যেত না। আমরা খুব সহজেই রূপকথার জাদুকরের মতো—অ্যাবরা–কা–ড্যাবরা বলে কুয়াশার বুকে হাওয়া হয়ে যেতাম। লুকোচুরি খেলা শেষে, স্যান্ডেলভর্তি একগাদা শিশিরভেজা মাটি নিয়ে বাড়ি ফিরতাম।
আমাদের নিজস্ব সবজিবাগান ছিল। প্রায় সব ধরনের শীতকালীন সবজি চাষ হতো সেখানে। ইচ্ছেমতো তরতাজা সবজি তুলে চড়ুইভাতির আয়োজন করতাম। এক পাশে চড়ুইভাতি আর অন্য পাশে মল্লিকদের বাগান থেকে কুড়িয়ে আনা জলপাই, বরইয়ের মিশেলে ভর্তা বানানোর আয়োজন চলত। খেত থেকে তুলে আনা তাজা ধনেপাতা দিয়ে মাখানো সেই ভর্তা, অমৃতের স্বাদকেও হার মানাবে বলে বিশ্বাস করতাম। আমাদের প্রচুর গোল আলু হতো, খাবার সুবিধার্থে—সেগুলোকে বাছাই করে বড় থেকে ছোট কয়েকটি ভাগে আলাদা করে রাখা হতো। বড় আকারের আলুগুলোকে মাটির চুলায় পুড়িয়ে খেতাম। রাতের রান্না শেষে, আলু পোড়াতে দিয়ে চুলার চারপাশে বসে আগুন পোহাতাম। আলু পোড়া হয়ে গেলে, সুন্দর একটা গন্ধ বের হতো। পোড়া আলুগুলোকে গরম ছাই থেকে তুলে ফুঁ দিয়ে দিয়ে খেতাম।
শীতের সবচেয়ে মজার দিক ছিল, পিঠাপুলি তৈরির উৎসব। প্রতিদিনই পাড়ায় কারও না কারও বাড়িতে পিঠার আয়োজন চলত। সকাল হতেই ইতি-উতি থেকে আসা ঢেঁকির শব্দে পাড়াসুদ্ধ গমগম করত। শীতে আমাদের বাড়িতে যখন ফুফা-ফুফুরা আসতেন, তখন খুব ঘটা করে পিঠার আয়োজন হতো। দিনের শুরু থেকেই সবাই নানা কাজে ব্যস্ত হয়ে যেতেন। বাজার করে আনা, ঢেঁকিতে চাল গুঁড়া করা, পিঠা তৈরির সরঞ্জাম গোছানোসহ আর কত কী! বাড়িতে উৎসবের হাওয়া বইত। মাঝরাত অব্দি চলত পিঠা তৈরির কাজ। সেদ্ধ-পুলি, দুধ-পুলি, দুধ-চিতই, মাংস-শিঙাড়াসহ আরও নানা পদের খাবার রান্না। আব্বার ভয়ে আমরা পড়ার টেবিলে বসে বই-খাতা নাড়াচাড়া করতাম। পিঠাপুলির গন্ধ নাকে সুড়সুড়ি দিয়ে ডাকত; কিন্তু পাঠ মুখস্থ না করে যাওয়া সাধ্য ছিল না। পাঠ মুখস্থ হলে, গলা অব্দি খেয়ে ঘুমিয়ে যেতাম।
ভোরবেলা হাঁড়ি-পাতিলের টুংটাং শব্দে ঘুম ভাঙত; বিছানায় শুয়েই টের পেতাম ভাপাপিঠা বানানো হচ্ছে। লোভ সামলাতে না পেরে, লেপের ওম ছেড়ে একঝটকায় উঠে পড়তাম; তারপর কলপাড়ে গিয়ে কোনোরকম চোখে-মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে সোজা চলে যেতাম পাকের ঘরে। দাদি প্লেটে গরম–গরম পিঠা তুলে দিতেন। আমরা দাদির পাশে পিঁড়ি পেতে বসে তুলতুলে নরম ভাপাপিঠা খেতাম। দাদির হাতে বানানো ভাপাপিঠার মতো পিঠা আর কোথাও খাইনি। পিঠা খাওয়া শেষে নতুন চালের ভুনাখিচুড়ির সঙ্গে ঝাল–ঝাল গরুর মাংস গাপুস-গুপুস পেটে চালান করে দিয়ে, উঠানের মিঠে রোদে পাটি পেতে শুয়ে থাকতাম।
দিনবদলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, পরিবর্তনের হাওয়া বইছে সর্বত্র। আবহাওয়া পরিবর্তনের পাশাপাশি পরিবর্তন এসেছে মানুষের জীবনযাত্রা, বাসস্থান, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক-পরিচ্ছদসহ আরও অনেক কিছুতে। এত এত পরিবর্তনের ভিড়ে স্মৃতিগুলোকে হাতড়ে বেড়াই। মানুষ স্মৃতিকাতর প্রাণী। তাই তো পরিবর্তনের মোড়কে মুড়িয়ে গেলেও ফেলে আসা সোনালি দিনগুলোর কাছেই ফিরে যেতে চায় বারবার।
বনশ্রী, ঢাকা