ওঙ্কার- আহমদ ছফা

ওঙ্কার- আহমদ ছফা

উপন্যাসটি মূলত ৬৯-এর গণ–অভ্যুত্থানের সামাজিক, পারিবারিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রচিত। লেখক চেয়েছেন, একটি গল্পের মাধ্যমে সেই সময়ের বাঙালির ত্যাগ, ভয়হীন পথচলা ও স্বাধীনতা পাওয়ার ক্ষেত্রে তপস্যার মিশেল দেখাতে। তবে কাহিনি এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাঁধাধরা নিয়ম মেনে চলেননি আহমদ ছফা। পাঠকের জন্য প্রতিটি প্লটেই রেখেছেন চমক!

গল্পের কথক বা নায়কের বাবা পৈতৃক সূত্রে অনেক জমি ও সম্পত্তি পেয়েছিলেন। সেগুলোর ব্যবহারও তিনি যেমন খুশি তেমনভাবে করেছেন। মানুষের ওপর যেমন নির্যাতন করতেন, তেমনি খারাপ ব্যবহারও করতেন। কথায় কথায় মেরে ফেলার হুমকিও দিতেন তিনি। খুব সহজে বললে নায়কের বাবা খুব অহংকারী একজন ব্যক্তি ছিলেন।

কথায় কথায় মেরে ফেলাতে চাওয়ায় একবার বিপদে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়ে যান তিনি। বিপদ এতটাই ছিল যে সারা বছর একমাত্র যে জমি থেকে ফসল আসত খাওয়ার জন্য, সেটিও বিক্রির উপক্রম হয়। তখন শেষ উপায় হিসেবে সমাধানে আসেন নায়কের বাবার মামলা–মোকদ্দমা পরিচালনা করা আবু নসর মোক্তার। তিনি নায়ককে তাঁর বোবা মেয়েকে বিয়ে করতে বলেন। বিনিময়ে সব সমস্যা সমাধান করার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।

নায়ক রাজি হয়ে যান কোনো কিছু না ভেবেই। মোক্তার সাহেবও তাঁর কথা রাখেন। সব সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি নায়ককে ভালো চাকরি ও বাড়ি করে দেন তিনি।
একসময় নায়কের মা-বাবা মারা যান। নায়কের ছোট বোন তাঁর সঙ্গে থাকে। নায়ক এতকিছু পেয়েও শান্তি পাচ্ছিলেন না। কারণ, তিনি নিজের বউয়ের সঙ্গে কথা বলতে পারতেন না। মাঝেমধ্যে মনে করতেন, এসব সুখ যদি শ্বশুরমশাইকে ফেরত দিয়ে বলা যেত, আমি শুধু একজন কথা বলা মানুষ চাই, আর কিছু না। আবার অফিসের নিপেন নামে এক সহকর্মী নতুন বিয়ে করা বউ বাড়িতে কী বলে না বলে, এসব এসে অফিসে সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতেন। এতে নায়ক প্রচণ্ড বিরক্ত হন।

নায়কের বোন গান শিখতে আগ্রহী বলে গানের মাস্টার রাখা হয় বাড়িতে। সেটি দেখে নায়কের বউ দরজা বন্ধ করে লুকিয়ে লুকিয়ে চেষ্টা করে উচ্চারণ করার, গান গাওয়ার। কিন্তু পারে না। কারণ, সে বোবা। নায়কের চোখে একদিন তা ধরা পড়ে। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, বউকে সময় দেবেন। কখনো অফিসে অনুপস্থিত না থাকা ব্যক্তিটি ছুটি নেন অফিস থেকে। দাম্পত্য জীবনে তিনি পুরোপুরিভাবে খুঁজে পান নিজেকে এ সময়ে।
তখন দেশে বিভিন্ন আন্দোলন চলে। অফিস থেকে ফেরার পথে নায়কের প্রায়ই ওই মিছিল চোখে পড়ে। এসব দেখে তাঁর বিরক্ত লাগে, ভয় হয়। নায়কের শ্বশুর আইয়ুব খানের আমলে সব সুযোগ-সুবিধা তৈরি করেছেন এবং নায়কও তা ভোগ করছেন। আইয়ুব খানের পতন হলে সব সুবিধা চলে যাবে। এ জন্য তিনি মিছিল ভয় পান। কিন্তু মনের কোথাও যেন আবার এ নিয়ে সাহস জেগে ওঠে, রক্ত গরম হয়, মিছিলে অংশগ্রহণ করতে চায়।

মিছিলের ইতিবাচক দিক পড়ে বোবা বউয়ের ওপর। মিছিলের জয়ধ্বনি আর আওয়াজ শুনে কথা বলার ব্যাকুলতা, আগ্রহ বাড়ে তীব্রভাবে। একসময় বোবা বউ দীর্ঘদিনের চেষ্টায় জানালায় দাঁড়িয়ে দেখা মিছিলের জয়ধ্বনি শুনে ‘বাঙলা’ শব্দটি উচ্চারণ করতে সক্ষম হয় এবং অজ্ঞান হয়ে যায়, মুখ দিয়ে রক্ত বের হয়ে আসে। নায়ক তাঁর বউকে অচেতন অবস্থায় দেখেন এবং একটি প্রশ্নের মাধ্যমে উপন্যাসটি শেষ হয়। প্রশ্নটি হলো, কোন রক্ত বেশি লাল, শহীদ আসাদের নাকি আমার বোবা বউয়ের?