পল্লিকবি জসীমউদ্দীন বাংলা সাহিত্যের এক অসামান্য প্রতিভা। তাঁর সাহিত্যকর্মে গ্রামীণ জীবনের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে এবং সামাজিক ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে নারীপ্রেম ও জীবনযাত্রার গভীর সম্পর্ক তুলে ধরা হয়েছে। কবির আখ্যানমূলক কাব্য চারটি হচ্ছে—‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ (১৯২৯), ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ (১৯৩৩), ‘সকিনা’ (১৯৫৯) ও ‘মা যে জননী কান্দে’ (১৯৬৩)। সব কটি গ্রন্থেই নারী জীবনের চিত্র গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেছে। তাঁর সাহিত্যকর্মে নারীর সংগ্রাম, দুঃখ-কষ্ট ও আশা-নিরাশার চিত্র স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।
জসীমউদ্দীনের কবিতায় নারীর জীবনকে বিভিন্ন দিক থেকে উপস্থাপন করা হয়েছে। বিশেষত ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ তাঁর একটি অমর সৃষ্টি। যেখানে গ্রামীণ নারীদের সৌন্দর্য, দৈনন্দিন জীবনের দুঃখ-কষ্ট, স্বপ্ন-আশা, ত্যাগ-ভালোবাসা ও সামাজিক বাধাবিপত্তির কথা উঠে আসে। কবির প্রেমের অন্যতম দিক, যখন তাঁর মন মজে যায় গাঁয়ের মেয়ের সঙ্গে।
‘দেখেছি এই চাষী মেয়ের সহজ গেঁয়ো রূপ,
তুলসী-ফুলের মঞ্জরী কি দেব-দেউলের ধূপ!’
(নক্সী কাঁথার মাঠ-৩)
অথবা,
‘স্বামীর বাড়িতে একা মেয়ে সাজু কি করে থাকিতে পারে,
তাহার মায়ের নিকটে সকলে আনিয়া রাখিল তারে।
একটি বছর কেটেছে সাজুর একটি যুগের মতো,
প্রতিদিন আসি, বুকখানি তার করিয়াছে শুধু ক্ষত।
(নক্সী কাঁথার মাঠ-১৩)
এখানে কবি সাজুর বাড়ি থেকে দূরে থাকা এক স্ত্রীর জীবনের একটি বিশেষ দৃষ্টিকোণ চিত্রিত করেছেন। সাজু বাড়ি থেকে দূরে থাকতে পারে এবং একা থাকা সময়ে তার বুকখানি কত হাহাকার, কবি সেই কষ্টের কথা উপস্থাপন করেছেন। মা-সহ সবাই তার পাশে রয়েছে, যা একটি গ্রামীণ সমাজের মূল্যবোধ ও একজন মেয়ের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দিক।
জসীমউদ্দীনের সাহিত্যকর্মে নারীর সংগ্রাম ও ত্যাগের নানা দিক ফুটে উঠেছে। তাঁর কবিতায় নারীরা কখনো স্বপ্ন দেখে, কখনো জীবনের কঠিন বাস্তবতার সঙ্গে আপস করতে বাধ্য হয়। সেই সংগ্রামের মধ্যেও নারীর প্রতি অগাধ ভালোবাসা ও সৎ সাহসের চিত্র স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে।
‘পেটভরা সে যে পায় না আহার, পরনে ছিন্নবাস
দারুণ দৈন্য অভাবের মাঝে কাটে তার বারোমাস।’
(কবিতা: বস্তির মেয়ে)
জসীমউদ্দীন তাঁর কবিতায় ক্ষুধার্ত ও দরিদ্র নারীর চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন; যার পেটে খাবার নেই এবং পরনে ছেঁড়া কাপড়। নারীর প্রতি মমত্ববোধ ও দুরবস্থা দেখে তখন কবি মনে মনে ভাবেন।
‘বস্তির বোন তোমারে বাঁচাতে পারিব না কোনমতে?’
‘কে পোড়াবে এই অসাম্য-ভরা মিথ্যা সমাজ বাঁধ,
তার তরে আজ লিখিয়া গেলাম আমর আর্তনাদ।’
(কবিতা: বস্তির মেয়ে)
কবি সমাজের অবিচার, অসাম্য ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাঁর ক্ষোভ প্রকাশে সমাজের কাছে আর্তনাদ করেন। এই সমাজের অন্ধকার দিকগুলো কবে ভাঙবে, কবে সমাজে পরিবর্তন আসবে।
গ্রামীণ নারীর সাবলীলতা, সাদাসিধে ও শালীনতার সৌন্দর্য বর্ণনা করে জসীমউদ্দীন লেখেন—
‘হেতেই তারে মানিয়েছে যা তুলনা নেই তার
যে দেখে সে অমনি বলে দেখে লই আরবার।
ছিপ ছিপে তার পাতলা গঠন হাত চোখ মুখ কান
হেলছে দুলছে মেলছে গায়ে গয়না শতখান।’
(কাব্যগ্রন্থ: সোজন বাদিয়ার ঘাট)
এখানে কবি নারীর শারীরিক গঠনের অদ্ভুত সুন্দরতার কথা বলছেন; যার তুলনা কারও সঙ্গে করা সম্ভব নয়। নারীর সৌন্দর্য এতটাই প্রাকৃতিক ও নিখুঁতভাবে বর্ণনা করেছেন যে তার হাত, চোখ, মুখ, কান—সবকিছুই যেন এক সুন্দর সংগীতের মতো একে অপরের সঙ্গে মিলিত হচ্ছে। নারীর গয়না শাড়ির সঙ্গে হেলছে, দুলছে, যা নারীর জীবনযাপনের আনন্দ ও সৌন্দর্য প্রকাশ।
‘তাহারে কহিনু, সুন্দর মেয়ে! তোমারে কবিতা করি।’
(কবিতা: কবিতা, কাব্যগ্রন্থ: মাটির কান্না)
জসীমউদ্দীনের কবিতায় সাধারণত নারীর প্রতি অযথা অবিচার, নিষ্ঠুরতা ও সমাজের অমানবিক আচরণের চিত্র উঠে এসেছে। নারীর প্রতি দেওয়া কলঙ্ক ও বিভিন্ন সামাজিক অত্যাচার জীবনের অন্ধকার দিকগুলোকে প্রতিফলিত করে।
‘কেউ দিল তারে বিষের ভাণ্ড, কেউবা প্রবঞ্চনা
কেউ দিল ঘৃণা, কলঙ্ক কালি এনে দিল কোন জনা।’
(কবিতা: সকিনা, কাব্যগ্রন্থ: সকিনা)
‘বিষের ভাণ্ড’ বলতে কবি এমন কিছু বোঝাচ্ছেন, যা নারীর জীবনকে বিষাক্ত বা কঠিন করে তোলে। যেমন সমাজের অসহিষ্ণুতা, অবিচার বা নির্যাতন।
পল্লিকবি জসীমউদ্দীন বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য ধারার প্রতিফলন। তাঁর সাহিত্যজীবনের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি গ্রামের জীবন ও সাধারণ মানুষের যাতনা-আনন্দের মধ্যে যে মানবিক মূল্যবোধ ও সৌন্দর্যকে তুলে ধরেছেন। তাঁর সাহিত্য নারীদের সংগ্রাম, সৌন্দর্য ও অধিকারের ব্যাপারে সমাজে সচেতনতা সৃষ্টি করেছে।
তারাগঞ্জ, রংপুর